বন্যায় বিপর্যস্ত ফেনী জনপদ। বন্যায় ফেনীর উত্তরাঞ্চলের উপজেলা ফুলগাজী বন্যায় মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তারমধ্যে সবথেকে বেশি ক্ষয়ক্ষতি দেখা গেছে উপজেলার দরবারপুর ইউনিয়নের জগতপুর গ্রামে। এ গ্রামের মুহুরী নদীর পাশ্ববর্তী একটি সড়কের ১৭টি স্থানে ভেঙে গেছে। ধ্বসে পড়েছে বহু ঘরবাড়ি, নষ্ট হয়েছে ফসলি জমি। মারা গেছে হাঁস-মুরগীসহ গৃহপালিত পশু গরু ছাগল।
জগৎপুর গ্রামের বাসিন্দা হাজেরা বেগম। সড়ক ভেঙে পানি স্রোতে ধ্বসে যায় তার বসতঘর। ছেলে সন্তান ও বৃদ্ধ শাশুড়ি নিয়ে মানবেতর দিন পার করছেন তিনি। আকুতি জানিয়েছেন, আমি আর কিচ্ছু চাইনা শুধু ঘরটি ঠিক করে দেন।
বন্যাকালীন সময়ে নিজের দুর্বিষহ স্মৃতি তুলে ধরেন হাজেরা বেগম। বলেন, আমার তিনটা বাচ্চা, দুইটাই শিশু, শাশুড়ি বৃদ্ধ। যখন পানি আসছে আমরা তো হাহাকার শুরু করছি। আমরা বাঁচার জন্য ছাদে উঠছি। আমি সাঁতার জানি না। একটা নৌকা করে স্কুলে গেছি। আমার শাশুড়ি ভাবছে আমরা মারা গেছি। এজন্য আমার শাশুড়ি পানিতে ডুবে আত্মহত্যা করতে গেছে। জীবন বাঁচাতে পারলেও আমার বাচ্চাদের কিছুই বাঁচাতে পারিনি। সব শেষ হয়ে গেছে। এ জীবন রেখে আর কী হবে। আমার বাচ্চাগুলোর কী হবে, কেমনে চলব?
পানির স্রোতে বিলীন হওয়া বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে এভাবে আহাজারি করছিলেন তিনি। বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া মুহুরি নদীর পানির চাপে সড়ক ভেঙে স্রোতে ভেসে যায় হাজেরার সখের আসবাবপত্র, ভেঙে যায় থাকার ঘরসহ ৪টি ঘর। ছাগল, হাঁস, মুরগি সবই চলে গেছে বানের জলে। এখন তিন সন্তান নিয়ে বিপাকে পড়েছেন তিনি। ঘর ঠিক করার সম্বলটুকুও নেই তার।
কৃষি কাজ করে তিলে তিলে এই সংসার গড়েছেন হাজেরা ও তার স্বামী ওমর ফারুক। তিন সন্তান ও বৃদ্ধ শাশুড়ির মিলে সুখের সংসার ছিল তাদের। বন্যায় বিলীন হয়ে পথে বসেছে হাজেরার পরিবার৷
হাজেরা বেগম বলেন, এক নিমিষেই পানি গলা সমান উঠে যায়৷ আমার তিনটা সন্তান। একটা পাঁচ বছরের শিশু, একটা ৮ বছরের শিশু ও মেয়েটা ১৫ বছর হইছে। কেউ আমরা সাঁতার জানি না। প্রথমে এসে আমার ঘরের সামনের অংশে লাগে পানি চাপ। আমরা বের হতে হতে পানি কোমর সমান। চোখের সামনে সব কিছু চলে গেলো। তখন ভেবেছিলাম এ জীবন রেখে কী করব। জীবন মানেই তো যুদ্ধ। তো পানির সাথে যুদ্ধ করে মরে যাই।
তিনি বলেন, এখন ঘরে দাঁড়াবো সে জায়গাটাও নেই৷ আমার খাট নেই, চেয়ার নেই, কাঁথা নেই, বালিশ নেই। কীভাবে কাজ করব। আমার ছেলে মেয়েরে কী দেবো? ওদের তো বইখাতা সবডি ভাসি গেছে। বাচ্চারা মানষের বাড়িত আছে। আপনারে কাছে অনুরোধ আপনেরা যে সাহায্য করেতে পারেন। এখন সাহায্য ছাড়া আমগো আর কোনো উপায় নাই৷ দয়া করে আমার ঘরটা ঠিক করে দেন, যাতে থাকতে পারি আর কিছু চাই না জীবনে। শুধু ঘরটাই ঠিক করে দেন।
হাজেরা বেগমের প্রতিবেশী মর্জিনা আক্তারের ঘরও ভেসে গেছে স্রোতে। সাথে ভেসে গেছে আসবাবপত্র ও প্রয়োজনীয় সকল জিনিসপত্র। রান্নাঘরও ভেঙে গেছে। থাকার ঘরের অবস্থা নাজুক। সব হারিয়ে নিঃস্ব মর্জিনা বেগম৷ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন মর্জিনার স্বামী নুরুল আমিন। তিন সন্তানে ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত মর্জিনাও এখন অন্যের সাহায্যের অপেক্ষায়।
মর্জিনা বেগম বলেন, চাইল ডাইল বেজ্ঞুন ভাসি গেছি হানির (পানির) স্রোতে। যে ক্ষয়ক্ষতি হইছে বাই (ভাই) কিচ্ছু নাই অ্যার। ব্যাক কিছু নষ্ট অই গেছে। হাকঘরডাও (রান্নাঘর) টানি নিছে, কিচ্ছু নাই আর৷ এখন আপনেরা যদি সাহায্য করেন আন্ডা বাঁচি। আপনেরা সাহায্য করেন। আন্ডা খুব অসহায়।
মর্জিনার মত জগতপুর গ্রামে অন্তত ৫০টি পরিবারের সব কিছু বিলীন হয়েছে বন্যায়। বন্যার পানি নেমে গেলেও ঘরবাড়ির বিধ্বস্ত অবস্থা দেখে সইতে পারছেন না স্থানীয় মানুষরা। শোকে কেউ কেউ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। কেউ বুকে পাথর বেঁধে নির্বাক তাকিয়ে আছেন লণ্ডভণ্ড হওয়া ঘরবাড়ির দিকে। এখন সাহায্য ও পুনর্বাসন ছাড়া ঘুরে দাঁড়ানোর উপায় নেই পরিবারগুলোর।
জগতপুর দরবার বাড়ি এলাকার হাসেম উদ্দিন বলেন, আমার ২টা ছাগল ভেসে গেছে, হাঁস-মুরগি সব গেছে৷ ২০ মণ ধান তাও গেছে। দক্ষিণের ঘরের শুধু পিলারগুলো আছে। এখন খাব যে তার উপায় নাই। বাজার করব তার টাকা নাই। এখন ভিক্ষুকের মতো বসে আছি সাহায্যের জন্য, কে আসবে সাহায্য করবে।
বন্যায় বানভাসি এসব মানুষের বিষয়ে কথা হয় ফেনী জেলা প্রশাসক মুছাম্মৎ শাহীনা আক্তারের সাথে। তিনি বলেন, ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণের জন্য দফতরগুলোকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। খুব দ্রুতই তালিকা। করে দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে৷ এছাড়া আমাদের ত্রাণ কার্যক্রম চলমান আছে। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ আসলে পুনর্বাসনের কাজ খুব দ্রুত শুরু হবে৷