সোনাগাজীতে এইচএসসি পরীক্ষায় আবারও ফল বিপর্যয় ঘটেছে। পরপর তিন বছর জেলার তলানীতে রয়েছে উপজেলাটি। তবে বিপরীতে আলিম পরীক্ষায় মাদ্রাসাগুলোর শিক্ষার্থীরা অর্জন করেছে ঈর্ষণীয় সাফল্য। গতকাল বুধবার এইচএসসি ও সমমানের ফলাফল প্রকাশের পর এমন চিত্র ফুটে উঠেছে।

প্রকাশিত ফল বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত কয়েক বছর ধারাবাহিকভাবে এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল বিপর্যয় হয়ে সোনাগাজী জেলার সর্বশেষ অবস্থান অর্জন করে। জেলায় বরাবরের মতো ২০২৫, ২০২৪ এবং ২০২৩ সালে সর্বশেষ অবস্থানে রয়েছে এই উপজেলা। এবার উপজেলার চারটি কলেজ থেকে মোট ৯৫২ জন পরীক্ষায় অংশ নেন। এরমধ্যে ২৫৭ জন উত্তীর্ণ হয়েছেন। জিপিএ-৫ পেয়েছেন ৩ জন। পাশের হার দাঁড়িয়েছে ২৭ দশমিক ২০ শতাংশ।

এর আগে ২০২৪ সালের এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফলে সোনাগাজীতে ৩৯ দশমিক ২০ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করেছিল। সেবছর উপজেলার ৪টি কলেজের ১ হাজার ১৪৮ জন এইচএসসি পরীক্ষা দিয়ে পাস করেছে ৪৪৮ জন, জিপিএ-৫ পেয়েছে ৩ জন। ২০২৩ সালে এসব কলেজে পাসের হার ছিলো ৩৭ দশমিক ৪১ শতাংশ। অর্জনের দিক থেকে সেই বছরও জেলায় সর্বশেষ অবস্থানে ছিলো এই উপজেলা। সেসময় এই ৪টি কলেজ হতে ১ হাজার ২৬৭ জন অংশ নিয়ে পাস করেছিল ৪৭৪ জন। জিপিএ-৫ পেয়েছিল ৩ জন।

কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী কলেজভিত্তিক ফলাফলে দেখা যায়, ফল বিপর্যয়ের তলানিতে আছে বক্তারমুন্সি শেখ শহীদুল ইসলাম ডিগ্রী কলেজ, ১৬৮ জন পরীক্ষা দিয়ে পাস করেছে ২৬ জন, নেই জিপিএ-৫ এবং পাশের হার ১৫ দশমিক ৪৮ শতাংশ। এ কলেজে ২০২৪ সালে পাসের হার ছিল মাত্র ২২ দশমিক ৪৩ শতাংশ।

সোনাগাজী সরকারি কলেজে ৬১৯ জন পরীক্ষা দিয়ে পাস করেছে ১৪৪ জন, জিপিএ-৫ পেয়েছে দুইজন এবং পাসের হার ২৩ দশমিক ২৬ শতাংশ। ২০২৪ সালের পাসের হার ছিল ৩৭ দশমিক ৩২ শতাংশ।

আমিরাবাদ বিসি লাহা স্কুল এন্ড কলেজের ২৫ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে পাস করেছে ১৩ জন এবং পাসে হার ৫২ শতাংশ। এ কলেজে ২০২৪ সালে পাসের হার ছিল ৭০ শতাংশ।

এনায়েত উল্লাহ মহিলা কলেজে এ বছর ১৪০ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে পাস করেছে ৭৪, জিপিএ-৫ পেয়েছে একজন এবং পাসের হার ৫২.৮৬ শতাংশ। ২০২৪ সালে পাসের হার ছিল ৬৪ দশমিক ৬৪ শতাংশ।

এদিকে উপজেলা শিক্ষা অফিস সূত্র জানায়, অন্যবারের ন্যায় এ বছরও কলেজ থেকে ফলাফলে এগিয়ে রয়েছে উপজেলার মাদ্রাসার আলিম শিক্ষার্থীরা। এবারের ফলাফলে উপজেলার ৬টি মাদ্রাসা থেকে ৩০৭ জন আলিম পরীক্ষার্থী অংশ নেন। এর মধ্যে ২৮৮ জন উত্তীর্ণ হয়েছে। পাশের হার ৯৩ দশমিক ৮১ শতাংশ এবং সর্বমোট জিপিএ-৫ পেয়েছে ৭ জন শিক্ষার্থী।

এর আগে ২০২৪ সালে এসব মাদ্রাসা থেকে ২৯০ জন আলিম পরীক্ষা দিয়ে পাস করেছিল ২৭৮ জন, পাসের হার ছিল ৯৬ দশমিক ৮৬ শতাংশ। সেবছর জিপিএ-৫ পেয়েছে ২৫ জন।

অপরদিকে উপজেলায় ৬টি মাদ্রাসা থেকে অংশ নিয়ে ভাল ফল অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে আলিম পরীক্ষার্থীরা। বখতারমুন্সী ফাজিল মাদ্রাসার ৬৩ জন পরিক্ষার্থীর মধ্যে ৩ জন জিপিএ-৫সহ সকলে পাস করেছে। ওসমানিয়া আলিম মাদ্রাসার ২৬ জন পরীক্ষার্থী সবাই পাস করেছে। সোনাগাজী ইসলামিয়া কামিল মাদ্রাসার ১৩২ জন পরিক্ষার্থীর মধ্যে ৪ জন জিপিএ-৫সহ ১২৯ জন পাস করেছে এবং পাসের হার ৯৭ দশমিক ৭৩ শতাংশ, যেখানে ২০২৪ সালে পাসের হার ছিল ৯৭ দশমিক এক শতাংশ। চর লক্ষ্মীগঞ্জ নাজেরিয়া ফাজিল মাদ্রাসার ৩৬ জন পরিক্ষার্থীর মধ্য ২৯ জন উত্তীর্ণ হয়েছে। দারোগারহাট আল জামিয়াতুদদীনিয়া ফাজিল মাদ্রাসার ৩৩ জন পরিক্ষার্থীর মধ্যে ২৮ জন উত্তীর্ণ হয়েছে এবং আমিরাবাদ মোশারফ মোয়াজ্জেম ইসলামিয়া আলিম মাদ্রাসার ১৭ জন পরিক্ষার্থীর মধ্যে ১৩ জন উত্তীর্ণ হয়েছে।

প্রতিবছর সোনাগাজীতে এইচএসসি পরীক্ষার ফল বিপর্যয়ের পিছনে শিক্ষাঙ্গনে রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা ও অনলাইন আসক্তিকে দায়ী করেছেন অভিবাবকরা। শিক্ষাঙ্গনের পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে ও ভাল ফল অর্জনে শিক্ষকদের রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি এবং গভর্নিংবডিতে যোগ্য নেতৃত্বের স্থান নিশ্চিত করাসহ অভিবাবকদের আরও সচেতন থাকা প্রয়োজন বলে মনে করেন তারা।

এদিকে ফলাফল প্রকাশের পর অভিভাবক ও স্থানীয় সচেতন নাগরিকদের মধ্যে হতাশা দেখা দিয়েছে। তারা বলছেন, সোনাগাজীর শিক্ষার মান দিনদিন নিম্নমুখী হচ্ছে, যা শুধু শিক্ষার্থীর নয়- গোটা সমাজের জন্য উদ্বেগজনক বার্তা।

স্থানীয় অভিভাবক মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, আমাদের সন্তানরা এখন পড়াশোনার চেয়ে বেশি সময় মোবাইলফোনে কাটায়। অনলাইন গেম আর সোশ্যাল মিডিয়া তাদের মনোযোগ নষ্ট করে দিচ্ছে। শিক্ষকরা যদি শিক্ষার্থীদের ক্লাসে পড়া আদায় ও মনোযোগী করাতে না পরেন, তাহলে এমন ফলাফল হবেই।

উপমা বিদ্যানিকেতনের প্রধান শিক্ষক রহিম উল্লাহ চৌধুরী বলেন, সোনাগাজীর অনেক কলেজেই শিক্ষার পরিবেশ নেই। শিক্ষক সংকট, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও অনিয়মিত ক্লাসের কারণে ফলাফল খারাপ হচ্ছে। গভর্নিং বডিতে অভিজ্ঞ ও শিক্ষাবান্ধব নেতৃত্ব না থাকলে উন্নতি সম্ভব নয়। পাশাপাশি মোবাইল আসক্তি থেকে শিক্ষার্থীদের সরিয়ে আনতে অভিভাবকসহ শিক্ষকরা কঠোর ভূমিকা রাখতে হবে।