২০২০-২১ সালে করোনা মহামারি, এবছর ভয়াবহ বন্যায় বিপর্যস্ত সোনাগাজীসহ ফেনীর কৃষক। সোনাগাজী উপজেলা কৃষি অফিসের তথ্যমতে, এবারের বন্যায় ১৭৭ কোটি ১৫ লাখ টাকা ক্ষতির ওপর দাঁড়িয়ে নতুন করে স্বপ্ন দেখছে কৃষক। সোনাগাজীর কৃষিতে যুক্ত হয়েছে নবোদ্যক্তা। এখন কৃষিতে এটিই প্রধান ইতিবাচক দিক বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, সোনাগাজী উপজেলায় আবাদি জমির পরিমাণ ২১ হাজার ৮৫০ হেক্টর। কিন্তু মৎস্য চাষ, মাটি বিক্রি এবং সরকারি প্রকল্পের কারণে আবাদি জমি ক্রমাগত কমলেও বাড়ছে কৃষকের সংখ্যা। করোনার আগে উপজেলায় নিবন্ধিত কৃষকের সংখ্যা প্রায় ৩০ হাজার থাকলেও গত চার বছরে এর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪০ হাজারের বেশি। তবে কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, কৃষি অফিসের কার্ডধারী কৃষকের বাইরে এই সংখ্যা আরও বেশি।
কৃষি অফিস সংশ্লিষ্টদের তথ্যমতে, বর্তমানে শিক্ষিত মানুষরাও কৃষিখাতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন। নতুন নতুন ফসল উৎপাদনে কৃষি বিভাগের পরামর্শ নিচ্ছেন। তাদের মাধ্যমে চাষ করে সাফল্যের মুখ দেখছেন তারা। উপজেলায় বর্তমানে স্কোয়াশ, ক্যাপসিকাম, বিষমুক্ত তিতা করলা, রেড ক্যাভেজ, ব্রকলি, সূর্যমুখী, লতিরাজ কচু, ওলকচু, জিঙ্ক সমৃদ্ধ বঙ্গবন্ধু ১০০ ধান, বিনা ধান ২৫ (বাসমতি), বন্যা সহনশীল ৫১-৫২ ধান, লবণাক্ত এবং খরা সমৃদ্ধ ধান চাষে আগ্রহ অনেক বেড়েছে। পূর্বে উপজেলায় এগুলো চাষ করা হতো না। এসব ফসল আবাদে লক্ষ্যমাত্রাও পূরণ হচ্ছে।
কৃষিকাজে নতুন উদ্যোক্তাদের আগ্রহ কেন বাড়ছে এ প্রশ্নের জবাবে উপজেলার উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা প্রতাপ চন্দ্রনাথ বলেন, কৃষকদের উৎসাহ দিতে সরকার সার, বীজসহ অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি দিচ্ছে। সরকারি প্রণোদনা হিসেবে প্রতিবছর বিভিন্ন সময়ে ১১-১২ হাজার কৃষকের মাঝে সার, বীজসহ কৃষি উপকরণ বিতরণ করা হচ্ছে। কৃষি অফিস বিভিন্ন ইউনিয়নে কৃষক মাঠ স্কুল পরিচালনায় করার কারণে সাধারণ মানুষ এবং কৃষকরা বাড়ির আঙ্গিনাসহ পতিত ভুমিতে চাষ করা শুরু করেছে। উপজেলা কৃষি অফিসের উদ্যোগে আশ্রয়ণে, সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে এবং কৃষকদের পতিত জমি আবাদের আওতায় আনা হচ্ছে। সেই লক্ষ্য পূরণ হয়েছে, বর্তমানে উপজেলায় ৪ শতাধিক পরিবার পারিবারিক পুষ্টি বাগান করছে। ছায়ার নিচে কোন ফসল না হলেও আমরা এই জায়গাগুলোতে প্রায় ৩০ হেক্টরে আদা ও হলুদ চাষে আওতায় এনেছি। চলতি মৌসুমে আদা-হলুদ চাষের লক্ষ্যমাত্রা আরো বাড়বে। এছাড়াও সুপারি, নারিকেল চারা রোপনের জন্য প্রায় ৩ হাজার চারা বিতরণ করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, এই উপজেলায় বিষমুক্ত ফসল উৎপাদনের চেষ্টা করছে চাষীরা। সর্বশেষ ১০ একর বিষমুক্ত করলা চাষ হয়েছে। এসব ফসল অর্থকরী ফসল বিধায় আমাদের কৃষকেরা এগুলোর গাছ নিজ বাড়ির আঙিনায় লাগানোয় এর মাধ্যমে তাদের যে আয় হচ্ছে, তা সচ্ছল জীবনযাপনের সহায়ক হচ্ছে। এভাবে সোনাগাজীর কৃষিতে নববিপ্লবের শুরু হয়েছে।
উপজেলা কৃষি বিভাগ জানিয়েছে, বন্যার আগে উপজেলার ১২ হাজার ৮৫৭ হেক্টর জমিতে আবাদ করা হয়। আগস্টে ভয়াবহ বন্যায় সোনাগাজীর ৯৩ দশমিক ২৯ শতাংশ ফসলি জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যার পরিমাণ ১১ হাজার ৯৯৪.৫ হেক্টর। বন্যার পানি নামার সঙ্গে সঙ্গেই উপজেলার কৃষকরা ১১ হাজার ৫৫০ হেক্টর জমিতে আমন রোপন করেন। আশানুরূপ ফল না পেলেও ইতোমধ্যে ৫৪ শতাংশ ফলন অর্জন হয়েছে এবং গবাদিপশুর খাদ্য খড় পাওয়া গেছে।
একই অফিসের তথ্যমতে, পূর্বে কৃষকরা ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে কৃষিকাজ করলেও বর্তমানে এসেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। যার ফলে বেড়েছে আগ্রহ এবং উৎপাদনও বেড়েছে। এসব যন্ত্রের মাধ্যমে বর্তমানে প্রায় সকল কৃষক উপকৃত হচ্ছেন। সোনাগাজী উপজেলায় ৬৩ টি আধুনিক কর্ষণ যন্ত্র, ২টি ফসল রোপন যন্ত্র (ট্রান্সপ্লান্টার), ২২টি ফসল কর্তন যন্ত্র (কম্বাইন্ডার হারভেস্টার) এবং রিপার ৮টি, ৪টি ফসল মাড়াই যন্ত্র (পাওয়ার থ্রেসার) রয়েছে। এছাড়াও ৪১২টি সেচ যন্ত্রের মাধ্যমে প্রতি বছর ১৬ হাজার ৭৪৬ হেক্টর জমিতে সেচ দেওয়া হয়। এতে উপকারভোগী কৃষকের সংখ্যা ১২ হাজার ২৫ জন।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মাইন উদ্দিন আহমেদ বলেন, বন্যার পরবর্তী সোনাগাজীর কৃষকরা সরকারি ও বেসরকারিভাবে সহযোগিতা পাওয়ার পাশাপাশি নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে চাষাবাদ শুরু করেছেন। বিপর্যস্ত পরিস্থিতি সামাল দিয়ে কৃষকরা ঘুরে দাঁড়াতে সফল হচ্ছেন। আমরা ৩ হাজার ২২০ জন কৃষককে রবি মৌসুমের (শীত) সার, বীজ প্রনোদনা দিয়েছি। এছাড়াও ৪ হাজার ৭০৪ জনকে নগদ ১ হাজার টাকাসহ উফশী সবজি বীজ, ৯ হাজার ৫০০ জনকে নগদ ১ হাজার টাকাসহ হাইব্রিড সবজি ব্রীজ, ৪ হাজার ৫০০ জনকে উফশী ও হাইব্রিড বোরো ধান সহায়তা দেওয়া হয়েছে। বঙ্গবন্ধু কৃষি বিশ্ব বিদ্যালয় ও রাজশাহীর বিশ্ববিদ্যালয় পৃথকভাবে ধানের চারা, বীজসহ কৃষি উপকরণ দিয়েছে। এছাড়া জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) আমিরাবাদ, সদর ইউনিয়নে ৭৬০ জন কৃষককে কৃষি উপকরণ দিয়েছে।
প্রান্তিক পর্যায়ে কৃষকরা জানিয়েছেন, যে ফসল উৎপাদন করে তারা লাভবান হচ্ছেন, পরের বছর একই ফসল উৎপাদনে উদ্যোগী হচ্ছেন কৃষক। এভাবে একজনকে লাভবান হতে দেখে অন্যজন একই ফসল উৎপাদনে আগ্রহী হয়ে উঠছেন। ফলে উপজেলায় কৃষকের সংখ্যা বেড়ে চলেছে।
এ ব্যাপারে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা বলেন, করোনার পর উপজেলার শিক্ষিত ও তরুণ যুবকেরা কৃষিতে মনোযোগী হওয়ায় উপজেলায় নতুন ফসলের চাষাবাদ বাড়ছে। বন্যার পর আগের চেয়ে আবাদ বেড়েছে।