দরজায় কড়া নাড়ছে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা। এবার জেলায় ১৪৬টি পূজামণ্ডপে আয়োজন করা হচ্ছে হিন্দুধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় এ ধর্মীয় উৎসবটি। গতবার আয়োজন করা হয়েছিল ১৪৭টি মন্ডপে। বুধবার (২ অক্টোবর) মহালয়ার মাধ্যমে দুর্গাপূজার ক্ষণগণনা শুরু হয়েছে। দুর্গাপূজার উৎসবকে ঘিরে ফেনীতে শেষ মুহুর্তের ব্যস্ততায় সময় পার করছেন প্রতিমা শিল্পীরা। পাশাপাশি কেনাকাটায় ব্যস্ত সময় পার করছে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা। তবে জানা গেছে, বন্যায় আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় অন্যবারের তুলনায় এবার পূজার আমেজ ও জৌলুস কিছুটা কমেছে।

জেলা পূজা উদযাপন পরিষদ সূত্রে জানা গেছে, এবার ফেনী সদরে ৪৭টি, ফেনী পৌর এলাকায় ১২টি, ফুলগাজী উপজেলায় ৩৩টি, সোনাগাজী উপজেলায় ২৩টি, দাগনভূঞা উপজেলায় ১৯টি, পরশুরাম উপজেলায় ৭টি ও ছাগলনাইয়া উপজেলায় ৫টি মন্দিরে শারদীয় দুর্গাপূজার আয়োজন করা হচ্ছে।

এ বিষয়ে জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি হীরা লাল চক্রবর্তী বলেন, ‘এবার জেলার ১৪৬টি পূজা মণ্ডপে দুর্গাপূজার আয়োজন করা হয়েছে। নিরাপদে পূজা উদযাপনে প্রশাসনের সাথে আলোচনা করে সব প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। সেনাবাহিনী, র‌্যাবসহ গোয়েন্দা সংস্থা ও রাজনৈতিক দলেরসাথে আলোচনা হয়েছে। উপজেলা নেতৃবৃন্দের সাথে বর্ধিতসভা করে পূজা উদযাপন পরিষদ সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছে৷

তিনি আরও জানান, ফেনীতে সরকার পরিবর্তনের কারনে পূজার আনন্দে তেমন ভাটা পড়েনি। তবে বন্যার কারণে আমরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত।

রোববার (৬ অক্টোবর) সরেজমিনে শহরের বিভিন্ন পূজামণ্ডপ ঘুরে দেখা গেছে, প্রতিমায় চলছে সাজসজ্জার কাজ। রঙের আঁচড়ে দেবী দুর্গাকে সাজিয়ে তোলা হচ্ছে নানা রঙে। পূজা ঘনিয়ে আসায় এখন রাত দিন ব্যস্ত সময় পার করছে শিল্পীরা। প্রতিটি প্রতিমাকে রঙ-তুলির নিপুণ আঁচড়ে রাঙাতে ব্যস্ত শিল্পীরা। চলছে সাজ-সজ্জার কাজও। দেবী দুর্গার সাথে সাজিয়ে তোলা হচ্ছে কার্তিক, গণেশ, লক্ষ্মী আর সরস্বতী দেবীকেও। যেন দম ফেলার ফুসরত নেই শিল্পীদের।

দুর্গা প্রতিমা তৈরীর কাজে ব্যস্ত শিল্পীরা জানান, এ বছর পূজায় আমেজ কম। দেশের পরিবর্তীত পরিস্থিতি ও বন্যার কারণে মানুষের মনে কিছুটা ভয়ভীতি রয়েছে। যার কারনে আগের থেকে কাজ কমেছে। বিভিন্ন জায়গা থেকে অর্ডার আসলে বন্যার কারনে কাজ শুরু করতে না পারায় শেষ মুহুর্তে রাত-দিন কাজ করতে হচ্ছে। প্রতিমার মাটির কাজ প্রায় শেষ। এখন রং-তুলিসহ সাজ-সজ্জার কাজ চলছে।রং ও সাজ-সজ্জার কাজ শেষ হলে এখান থেকে প্রতিমাগুলো জেলার বিভিন্ন পূজা মণ্ডপে পাঠানো হবে বলে জানান তারা। তারা বলেন, শুধুমাত্র অর্থ উপার্জন নয় ধর্মীয় অনূভুতি থেকে তারা এসব প্রতিমা তৈরীর কাজ করেন।

ফেনী গুরুচক্র মন্দিরের প্রতিমা তৈরীর কাজ করছেন শিল্পী সুশীল পাল। তিনি বলেন, এবার ২০টি মণ্ডপের প্রতিমা তৈরী করছেন তিনি। বন্যার কারনে মাটি, বাঁশ খড় পাওয়া যায়নি ঠিকভাবে। প্রতিটি প্রতিমাতে খরচ বাড়লেও কম দামে দিতে হচ্ছে। কারন সরকার পরিবর্তন, বন্যা সবকিছুর পরে মানুষের পূজা আনন্দে কিছুটা ভাটা পড়েছে। উপযুক্ত দাম না পেলেও ধর্মীয় অনূভুতি থেকে তারা কাজ করে যাচ্ছেন বলে জানান তিনি।

আরেকজন শিল্পী নরেণ পাল বলেন, ‘এখন কষ্ট করছি, কিন্তু দূর্গা মা যখন সম্পূর্ণ সাজে মণ্ডপে বসবে তখন সকল কষ্ট দূর হবে। নিজেকে স্বার্থক মনে হবে। তবে এ বছরের চিত্র ভিন্ন। অনেকের মনে ভয়ভীতি কাজ করছে, বন্যা পরবর্তীতে আর্থিকভাবেও পিছিয়ে গেছে। অনেক জায়গায় পূজা অনুষ্ঠিত হচ্ছেনা। যার কারনে আগের চাইতে কাজ ও কমে গেছে।

তিনি বলেন, বন্যা পরবর্তীতে খড় পাওয়া যায়নি অন্য জায়গা থেকে আনতে হয়েছে। কারিগরদের বেতন বেশি। প্রতিবছর ৪০টা প্রতিমার কাজ করলেও এবার ২০টার কাজ করছি৷ আমাদের খরচ বেশি পড়লেও অন্যবারের তুলনায় চাহিদা অনেক কম।

আগামী ৮ তারিখ ৬ষ্ঠী পূজার মধ্যে দিয়ে শুরু হয়ে ১২ তারিখ বিজয়া দশমীর মাধ্যমে এ পূজা শেষ হবে।



অপেক্ষা প্রহর গুনছেন সনাতন ধর্মালম্বীরা
পূজা উদযাপনের বিষয়ে গুরুচক্র মন্দিরের পুরহিত সুভাষ চক্রবর্তী বলেন, এইবার মা ঘোটকে করে আসবে নৌকা করে যাবে। ৬ষ্ঠী পূজার মাধ্যমে পূজার আনুষ্ঠানিকতা শুরু হবে। বিকালে অধিবাস হবে। সপ্তমীতে প্রথমদিনের পূজা উদযাপন হবে। পরে অষ্টমী, নবমী পূজা উদযাপন শেষে বিজয়া দশমীর মাধ্যমে পূজা শেষ হবে। পূজায় দেশ ও জাতির মঙ্গলকামনায় প্রার্থনা করা হবে বলে জানান তিনি।

তিনি বলেন, এবার পূজার আনন্দ ১৪ আনা কমে গেছে। অনেক জায়গায় প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। এতে করে ভয়ভীতি কাজ করে অনেকের মধ্যে। সবাই সার্বজনীনভাবে পূজা উদযাপনে প্রশাসনের সহযোগিতা কামনা করেন তিনি।

বিমল দেবনাথ নামে ফুলগাজীর একজন বলেন, আমাদের এলাকায় নির্বিঘ্নে পূজা উদযাপনে সব প্রস্তুতি নিয়েছি। প্রশাসন ও রাজনৈতিক দলগুলো সহযোগিতা করছে। আশা করি ভালো একটা পূজা হবে।

পূজা উদযাপন উপলক্ষ্যে উচ্ছ্বসিত সনাতন ধর্মাবলম্বী শিক্ষার্থীরা। প্রিতুই চক্রবর্তী নামে একজন শিক্ষার্থী বলেন, পূজাতে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ। ঘরে ঘরে আনন্দ উৎসব হবে। সবাই মিলে পূজার প্রস্তুতি নিচ্ছি। নতুন জামাকাপড় কেনাকাটা করছি। পিঠাপুলি ও মিষ্টান্ন বানানোর জন্য সবাই মিলেমিশে কাজ করছি৷ এবার পূজাতে আনন্দ কিছুটা ভাটা পড়েছে। বন্যায় অনেকের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে সেগুলো কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে অনেকে। এরমধ্যে সরকার পতন হয়েছে সবমিলিয়ে কিছুটা আনন্দ কম এবার অন্যবারের চাইতে। তিনি বলেন, আমাদের সকলের যে প্রার্থনা তা মায়ের কাছে করবো।

অনিক মোহন নামে আরেকজন বলেন, পূজাতে সকল আত্মীয় স্বজনদের সাথে দেখা হয়, সবাই বেড়াতে আসে।।একসাথে পূজা দেখতে যাই। ব্যস্ততার কারনে সারাবছর কারও সাথে দেখা না হলেও পূজার এ সময়টা খুব বেশী উপভোগ করি।সবার সাথে আনন্দ ভাগাভাগি করতে পারি বলেই এটি শারদীয় দূর্গোউৎসব। দুর্গা মায়ের কাছে পার্থনা করব উনি যাতে আমাদের সবাইকে ভালো রাখে।



নিরাপত্তা নিশ্চিতে সমন্বিত পদক্ষেপ
দুর্গাপূজায় মন্ডপে নিরাপত্তা নিশ্চিতে সমন্বিত পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এ প্রসঙ্গে পুলিশ সুপার হাবিবুর রহমান জানান, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও ভাতৃত্ববোধ বজায় রেখে সরকারি সব নির্দেশনা যথাযথভাবে অনুসরণ করে শান্তিপূর্ণভাবে দুর্গোৎসব উদযাপন করতে জেলা পূজা উদযাপন পরিষদ নেতৃবৃন্দকে অনুরোধ করা হয়েছে। এছাড়া মন্দিরের সার্বিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদারের লক্ষ্যে পূজামণ্ডপে সিসি ক্যামেরা স্থাপন, স্বেচ্ছাসেবক ও সামাজিক কমিটি এবং পূজা মন্দিরে পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা করতে বলা হয়েছে।

তিনি আরও জানান, সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পূজা মন্দিরে পালাক্রমে দায়িত্ব ব্যবস্থা করার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে। কোথাও কোনো সমস্যা হলে দ্রুত সংশ্লিষ্ট ইউনিয়নের বিট অফিসার, থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, পুলিশ সুপারকে অবহিত করার জন্য সবাইকে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, প্রতিটি মন্দিরে কঠোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে। পূজামণ্ডপে র‌্যাব ও পুলিশ ছাড়াও আনসার সদস্যরা নিরাপত্তায় থাকবে।

পূজার নিরাপত্তা প্রসঙ্গে জেলা প্রশাসক মুছাম্মৎ শাহীনা আক্তার জানান, শান্তিপূর্ণ পরিবেশে শারদীয় দুর্গোৎসব সুন্দরভাবে সম্পন্ন করতে ইতোমধ্যে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে সভা করে করণীয় নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। নিরাপত্তায় পুলিশ, র‌্যাব, আনসার সদস্য দায়িত্বপ ালন করবেন। পাশাপাশি জেলাপ্রশাসক কার্যালয়ের নিয়ন্ত্রণ কক্ষ সার্বক্ষণিক খোলা থাকবে।

ফেনী জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের বর্ধিত সভার প্রতিটি পূজা মন্দিরের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদককে কেন্দ্রীয় ২৩টি নির্দেশনা মেনে সাত্ত্বিক পূজা করতে বলা হয়েছে।

ফেনী পৌর পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক সুরঞ্জিত নাগ বলেন, পৌর এলাকায় ১২টি পূজার মধ্য সব মন্দিরের প্রস্তুতি প্রায় শেষ পর্যায়ে। শেষ মূহুর্তে রঙ তুলির আঁচ দেওয়ার কাজ চলছে। তিনি বলেন, একটা বছর আমরা এ পূজার জন্য অপেক্ষা করি। এখন পরিবর্তীত পরিস্থিতিতে নির্বিঘ্নে যাতে পূজা উদযাপনের বিষয়টি প্রশাসনকে নিশ্চিত করতে হবে।


সহযোগিতা করবে বিএনপি-জামায়াত
ইতোমধ্যে ফেনীর পূজা উদযাপন পরিষদের সাথে মতবিনিময় করে মন্দিরের নিরাপত্তায় সহযোগিতা করার কথা জানিয়েছে দিয়েছে জেলা বিএনপি-জামায়াতের নেতারা। এতে পূজামন্ডপে নিরাপত্তায় পাহারাসহ উভয় দলের পক্ষ থেকে সবধরনের সহযোগিতার আশ^াস দেওয় হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে জেলা বিএনপির আহবায়ক শেখ ফরিদ বাহার বলেন, পূজার বিএনপির পক্ষ থেকে অনুদান প্রদান করা হচ্ছে৷ পাশাপাশি নিরাপত্তাজনিত কোন আশঙ্কা নেই। পূজা উদযাপন পরিষদ নেতৃবৃন্দের সাথে আলোচনা হয়েছে। পূজা নির্বিঘ্নে উদযাপনে আমরা সব ধরনের সহযোগিতা করবে বিএনপি।

ইতোপূর্বে জেলা জামায়াতের আমির একেএম শামছুদ্দীন জানান, দুর্গাপূজায় নিরাপত্তা নিশ্চিতে জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা মন্দির পাহারা দেওয়ার কাজ করবে। পাশাপাশি কোন কুচক্রী মহল যাতে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের উপর অবিচার করতে না পারে সে বিষয়ে জামায়াত-শিবির সতর্ক অবস্থানে থাকবে।