“জাহান্নামের উষ্ণতম স্থানগুলি তাদের জন্য সংরক্ষিত যারা মহা নৈতিক সংকটের সময়ে তাদের নিরপেক্ষতা বজায় রাখে।” এই বিখ্যাত উক্তিটি ইতালীয় কবি দান্তে আলিগিয়েরিুর নামে বহুল উদ্ধৃত। আমি এই বাক্যটি বহুবার পড়েছি। প্রতিবারই মনে হয়েছে- এটি অন্যদের জন্য লেখা। ক্ষমতাবানদের জন্য, নিষ্ঠুরদের জন্য, যারা অন্যায় করে তাদের জন্য। আজ বুঝি, এটি আমার জন্যও। কারণ আমি নিরপেক্ষ ছিলাম। আমি জানতাম, তবু চুপ ছিলাম। আমি দেখেছি, তবু পাশ কাটিয়ে গেছি। আর এই নিরপেক্ষতাই আমার অপরাধ।
বাংলাদেশে বড় কোনো অন্যায় ঘটলে আমি প্রথমে খবর পড়েছি, তারপর চা খেয়েছি। মনে মনে বলেছি- খারাপ লাগছে। এরপর জীবন স্বাভাবিক রেখেছি। আমি প্রতিবাদ করিনি, প্রশ্ন তুলিনি, ঝুঁকি নিইনি। নিজেকে বোঝাতে চেয়েছি- আমি তো ক্ষমতায় নেই, আমি কী-ই বা করতে পারি? এই আত্মপ্রবঞ্চনাই আমাকে নিরপেক্ষতার আরামদায়ক চেয়ারে বসিয়েছে।
আমি দেখেছি মানুষ নিখোঁজ হয়, গুম হয়, খুন হয়, মতপ্রকাশের কারণে শাস্তি পায়, ভোটাধিকার প্রশ্নবিদ্ধ হয়। দেখেছি শিক্ষক ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়িয়ে একা হয়ে যান, সাংবাদিক সত্য লিখে চাকরি হারান, ছাত্ররা প্রশ্ন করে শাস্তি পায়। আমি তখনও নিরপেক্ষ ছিলাম। কারণ আমার চাকরি ছিল, আমার নিরাপত্তা ছিল, আমার ভয় ছিল। আমি বেছে নিয়েছিলাম সুবিধা।
আমি নিজেকে বলেছি- রাজনীতি নোংরা। কিন্তু নোংরা রাজনীতিই তো আমার নীরবতার ওপর ভর করে আরও শক্ত হয়েছে। আমি বলেছি- আমি দল করি না। কিন্তু অন্যায় তো দল দেখে না। অন্যায় কেবল নীরবতা দেখে- আর সেখানেই ঘাঁটি গড়ে।
এই দেশে নিরপেক্ষতা এক ধরনের সামাজিক মর্যাদা। চুপ থাকা মানে “বুদ্ধিমান”, “পরিণত”, “বাস্তববাদী” হওয়া। কথা বলা মানে ঝামেলা ডাকা। আমিও সেই সংস্কৃতির অংশ ছিলাম। অন্যায় নিয়ে বিতর্ক এলে বিষয় পাল্টেছি। সামাজিক ঝুঁকি এড়াতে সত্য এড়িয়ে গেছি। আমি জানতাম- কিন্তু জানাটাই যথেষ্ট মনে করেছি।
একসময় বুঝলাম, জানাই যদি যথেষ্ট হতো, ইতিহাস বদলাত না। ১৯৭১ সালে যারা নিরপেক্ষ ছিল, তারা স্বাধীনতার পক্ষে ছিল না। ১৯৯০ সালে যারা চুপ ছিল, তারা স্বৈরাচারের পতন চায়নি। ২০২৪ সালে যারা চুপ ছিলো পরে তারা সুবিধাবাজ, হাদি হত্যার পর যারা চুপ তারাও । নিরপেক্ষতা কখনো শূন্যস্থান নয়; এটি সব সময় ক্ষমতার দিকেই ঝোঁকে।
আমি তরুণদের দিকে তাকাই। তাদের বলি- সফল হও, টিকে থাকো। কিন্তু আমি কি তাদের বলি- সাহসী হও? না। কারণ সাহস ঝুঁকির। আর ঝুঁকি আমি নিজে নিতে পারিনি। এই দ্বিচারিতাই আমাদের সমাজকে ভেতর থেকে ক্ষয় করছে। আমরা নৈতিকতার ভাষা জানি, কিন্তু নৈতিকতার মূল্য দিতে চাই না।
আমার সবচেয়ে বড় ভয় ছিল- আমি কথা বললে কী হবে? সেই প্রশ্নটাই আমাকে থামিয়েছে। কিন্তু আজ বুঝি- আমি কথা না বললে কী হয়েছে? অন্যায় আরও স্বাভাবিক হয়েছে। রাষ্ট্র আরও নির্দয় হয়েছে। আর আমি ধীরে ধীরে নিজের কাছেই ছোট হয়ে গেছি।
নিরপেক্ষতা আমাকে নিরাপত্তা দেয়নি; দিয়েছে দীর্ঘ অনুশোচনা। কারণ অন্যায় থামে না। আজ সে অন্যের দরজায়, কাল আমার। তখন প্রশ্ন আসে- তুমি তখন কোথায় ছিলে? আমি তখন নিরপেক্ষ ছিলাম- এই উত্তর ইতিহাস গ্রহণ করে না।
এই লেখা কোনো বীরত্বের ঘোষণা নয়। এটি স্বীকারোক্তি। আমি নিরপেক্ষ ছিলাম, তাই দায়ী। আমি চুপ ছিলাম, তাই অংশীদার। আজ যদি আমি লিখি, বলি, দাঁড়াই- তাতে হয়তো দেরি হয়েছে, কিন্তু দেরি হলেও শুরু দরকার। কারণ নীরবতা আর সহ্য হয় না।
আমি জানি, একটি লেখা রাষ্ট্র বদলায় না। কিন্তু একটি লেখা একজন মানুষ বদলাতে পারে। আজ আমি নিজেকে বদলাতে চাই। আর যদি আমার এই স্বীকারোক্তি আরেকজনকে ভাবায়- তবেই এর অর্থ আছে। জাহান্নাম কোনো দূরবর্তী ধারণা নয়। এটি এই দেশেই তৈরি হয়- যখন আমরা অন্যায়কে স্বাভাবিক হতে দিই। আর স্বর্গও দূরে নয়- যখন কেউ একজন হলেও বলে ওঠে, “না, এটা ঠিক নয়।” আজ আমি নিরপেক্ষ নই। আজ আমি পক্ষ নিই- ন্যায়ের পক্ষে। দেরিতে হলেও।
লেখক ও সংগঠক
