শৈশবে বাংলা ব্যাকরণ বইয়ের সারাংশ-সারমর্ম অধ্যায়ে পড়া ডা. লুৎফর রহমানের এই বাক্যটি তখন আমাদের কাছে ছিল নিছক একটি উদ্ধৃতি। পরীক্ষার খাতায় সুন্দর করে লিখে নম্বর পাওয়ার জন্য মুখস্থ করা কয়েকটি লাইন। তখন আমরা বুঝিনি-এই একটি বাক্যের ভেতর লুকিয়ে আছে সভ্যতার উত্থান ও পতনের ইতিহাস, একটি জাতিকে ধ্বংস করার সবচেয়ে নির্ভুল কৌশল।
সময় মানুষের সামনে এমন সব আয়না ধরে, যেখানে পুরোনো কথাগুলো নতুন আলোয় ঝলমল করে ওঠে। আজ বুঝি, এটি কোনো সাহিত্যিক অলংকার নয়, কোনো অতিশয়োক্তি নয়- এটি একটি নির্মম ঐতিহাসিক সত্য। সভ্যতা ধ্বংস করতে কখনোই প্রথমে বোমা লাগে না, লাগে না সৈন্যদল। আগে আঘাত আসে চিন্তায়, জ্ঞানে, বইয়ে।
ইতিহাস তার সাক্ষ্য বহন করে। আলেকজান্দ্রিয়ার গ্রন্থাগার পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল, কারণ সেখানে জমা ছিল মানবজাতির স্মৃতি। বাগদাদ দখলের পর টাইগ্রিস নদীতে বই ফেলে পানি কালো করে দেওয়া হয়েছিল, কারণ বই মানেই প্রশ্ন, আর প্রশ্ন মানেই শাসকের ভয়। নাৎসি জার্মানিতে প্রকাশ্য চত্বরে বই পোড়ানো হয়েছিল, কারণ হিটলার জানতেন- বই বাঁচলে স্বৈরশাসন টিকবে না। তখন আগুন ছিল দৃশ্যমান, ধ্বংস ছিল প্রকাশ্য।
আজ আগুন নেই, ধোঁয়া নেই। কিন্তু ধ্বংস আরও নিখুঁত, আরও নীরব। বই পোড়ানো হয় না, বইকে অপ্রয়োজনীয় বানানো হয়। নিষিদ্ধ করা হয় না, উপেক্ষা করা হয়। এটি আধুনিক সময়ের সবচেয়ে ভয়ংকর সাংস্কৃতিক হত্যাকাণ্ড।
আজকের বাংলাদেশে দাঁড়িয়ে এই বাস্তবতা আরও স্পষ্টভাবে ধরা দেয়। আমরা এমন এক সমাজে বাস করছি, যেখানে বই রাখা দোষ নয়, কিন্তু বই পড়া অদ্ভুত। যেখানে লাইব্রেরি আছে, কিন্তু পাঠক নেই। যেখানে বইমেলা হয় উৎসবের মতো, কিন্তু উৎসব শেষে বইগুলো পড়ে থাকে নিঃসঙ্গ। এই বোধ আরও তীব্র হয়ে উঠেছিল গতকাল সন্ধ্যায় দৈনিক ফেনীর সম্পাদক ও প্রকাশক, সজ্জন ও মননশীল মানুষ আরিফ রিজভীর সঙ্গে এক আলাপচারিতায়। কথার এক পর্যায়ে গভীর হতাশার সুরে তিনি বললেন- মানুষ বই কিনছে না। পাঠক কমছে। বইয়ের দোকানগুলো টিকে থাকার লড়াইয়ে একে একে হেরে যাচ্ছে। তিনি বলছিলেন, পাঠক যদি মাসে মাত্র একটি বইও কেনে, তবে সে শুধু নিজের মনের খোরাক জোগায় না- সে একটি পুরো সমাজকে বাঁচিয়ে রাখে। একটি বইয়ের দামের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে কত মানুষের জীবন ও শ্রম। বই বিক্রেতা, প্রকাশক, ছাপাখানার শ্রমিক, মুদ্রণকারী, প্রচ্ছদশিল্পী, পরিবেশক- এবং সবশেষে লেখক। সেই লেখক, যিনি সামান্য রয়্যালটির টাকায় সংসার চালান, আবার নতুন করে লেখার সাহস সঞ্চয় করেন।
তিনি একনাগাড়ে বলছিলেন। আর আমি শুধু শুনছিলাম না- আমি গিলছিলাম। মনে হচ্ছিল, তিনি বইয়ের কথা বলছেন না; তিনি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা বলছেন। তিনি সমাজের বুদ্ধিবৃত্তিক মৃত্যুর আশঙ্কা উচ্চারণ করছেন। সেই মুহূর্তেই উপলব্ধি হলো- এই প্রসঙ্গে না লিখলে তা হবে দায়িত্বহীনতা। তাই এই লেখা।
আমরা এখন তথ্যপ্রযুক্তির যুগে বাস করি। আমাদের পকেটে স্মার্টফোন, চোখের সামনে স্ক্রিন, আঙুলের ডগায় পৃথিবী। ইউটিউব, ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, টিকটক- জীবন যেন অসংখ্য ছোট ছোট ক্লিপে বিভক্ত। এই যুগে প্রায়ই প্রশ্ন ওঠে- বইয়ের প্রয়োজন কী? এই প্রশ্নটাই আমাদের সময়ের সবচেয়ে বড় সংকটের প্রমাণ। কারণ বই কেবল তথ্য দেয় না, বই মানুষ তৈরি করে। সোশ্যাল মিডিয়া আপনাকে কী ভাবতে হবে বলে দিতে পারে, কিন্তু বই শেখায় কীভাবে ভাবতে হয়। ইউটিউব আপনাকে হাসাতে পারে, উত্তেজিত করতে পারে, ক্ষুব্ধ করতে পারে- কিন্তু বই আপনাকে ধীরে ধীরে বদলায়। একটি ভিডিও কয়েক সেকেন্ডে শেষ হয়ে যায়, কিন্তু একটি বই মানুষের ভেতরে বছরের পর বছর আলো জ্বালিয়ে রাখে।
আজ আমরা তথ্যের সাগরে ডুবে আছি, কিন্তু জ্ঞানের তৃষ্ণায় ভুগছি। আমরা মতামত দিচ্ছি, কিন্তু মনন করছি না। আমরা প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে উঠছি, চিন্তাশীল হয়ে উঠছি না। বই পড়া মানে ধৈর্যের অনুশীলন, মনোযোগের সাধনা, গভীরতার সঙ্গে নিজের ভেতরে নামার সাহস। আর এই যুগের মানুষ ধৈর্যহীন, মনোযোগহীন, গভীরতা-বিমুখ।
বাংলাদেশের বাস্তবতায় এই সংকট আরও বহুমাত্রিক। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা পরীক্ষাকেন্দ্রিক ও মুখস্থনির্ভর। পাঠ্যবই শেষ করাই সাফল্য, কিন্তু পাঠাভ্যাস গড়ে তোলা কোনো লক্ষ্য নয়। লাইব্রেরি মানেই পুরোনো ভবন, ধুলোপড়া তাক, নীরব অবহেলা। বইমেলা হয় উৎসবের মতো, কিন্তু পাঠচর্চা হয় না আন্দোলনের মতো।
অভিভাবকের স্বপ্ন সন্তানের চাকরি, ডিগ্রি, পদবি। চিন্তাশীল, সংবেদনশীল, মানবিক মানুষ হওয়া সেই স্বপ্নের তালিকায় খুব নিচে। ফলে শিশুর হাতে বই আসার আগেই মোবাইল আসে। গল্প শোনার বদলে তারা ভিডিও দেখে। ধীরে ধীরে বই তাদের কাছে হয়ে ওঠে অচেনা, বিরক্তিকর, অপ্রয়োজনীয় বস্তু। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অর্থনৈতিক বাস্তবতা। অনেকেই বলেন- বই কেনার সামর্থ্য নেই। কিন্তু আমরা যদি সৎভাবে হিসাব করি, মাসে কত টাকা খরচ হয় অপ্রয়োজনীয় ভোগে? সমস্যাটি অর্থের নয়, সমস্যাটি অগ্রাধিকারের। বই আমাদের জীবনে গুরুত্ব হারিয়েছে বলেই আমরা তাকে সময় দিই না, অর্থ দিই না।
আরেকটি গভীর সংকট হলো লেখক ও বুদ্ধিজীবীদের সামাজিক অবমূল্যায়ন। যে সমাজ লেখককে জীবিত অবস্থায় সম্মান দেয় না, সে সমাজ বইও পড়ে না। আমরা লেখককে স্মরণ করি মৃত্যুর পর, কবিকে আবিষ্কার করি প্রয়াণের দিনে। জীবিত অবস্থায় তাদের সংগ্রাম, অনিশ্চয়তা, আর্থিক টানাপোড়েন আমাদের বিচলিত করে না। ফলে নতুন লেখক তৈরি হয় না, পুরোনোরা নীরবে হারিয়ে যায়।
তবু এই অন্ধকারের মাঝেও আলো নিভে যায়নি। উত্তরণের পথ এখনো খোলা- যদি আমরা চাই।।এই উত্তরণ শুরু হতে পারে পরিবার থেকে। শিশুর ঘরে একটি ছোট বইয়ের তাক থাকুক। ঘুমানোর আগে গল্প পড়ার অভ্যাস গড়ে উঠুক। বই যেন শাস্তি না হয়ে আনন্দের হয়। একটি শিশুকে যদি বইয়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব করিয়ে দেওয়া যায়, সে বড় হয়ে বইকে কখনো পরিত্যাগ করবে না।
রাষ্ট্রের দায়িত্ব আরও বড়। প্রতিটি উপজেলায় কার্যকর ও আধুনিক লাইব্রেরি, স্কুলে পাঠাভ্যাস কর্মসূচি, স্থানীয় লেখকদের বই কিনে লাইব্রেরিতে সরবরাহ- এসব কোনো বিলাসিতা নয়। এগুলো রাষ্ট্র গঠনের মৌলিক বিনিয়োগ। কর্পোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতায় বই ও লাইব্রেরিকে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। গণমাধ্যম নিয়মিত বই নিয়ে আলোচনা করতে পারে, লেখককে সমাজের আলোচনায় ফিরিয়ে আনতে পারে।
সবচেয়ে বড় দায়িত্ব আমাদের ব্যক্তিগত। আমরা যারা লিখি, পড়ি, কথা বলি- আমাদেরই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আমি কি মাসে অন্তত একটি বই কিনতে পারি না? আমি কি একটি ভালো বই উপহার দিতে পারি না? আমি কি সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি বইয়ের কথা লিখতে পারি না?
সভ্যতা হঠাৎ করে ধ্বংস হয় না। ধীরে ধীরে, নীরবে, অবহেলায় ক্ষয়ে যায়। আজ আর বই পোড়ানোর আগুন দরকার হয় না। যথেষ্ট হলো- বই না পড়া।
ডা. লুৎফর রহমানের এই বাক্য- তাই আজ আরও ভয়ংকরভাবে প্রাসঙ্গিক। যদি আমরা নিজেদের সভ্য রাখতে চাই, সন্তানদের মানুষ করতে চাই, রাষ্ট্রকে সুস্থ রাখতে চাই- তবে বইয়ে ফিরতেই হবে।
বইয়ে ফেরা মানে অতীতে ফেরা নয়।
বইয়ে ফেরা মানে ভবিষ্যৎকে রক্ষা করা।
একটি বই কিনুন।
একটি বই পড়ুন।
একটি জাতিকে বাঁচান।
-লেখক ও সংগঠক
