বাংলাদেশের রাজনীতি এখন আর কোনো প্রস্তুতিপর্বে নেই; এটি দাঁড়িয়ে আছে ইতিহাসের এক চূড়ান্ত মুহূর্তে। এই সময়টি এমন, যেখানে কৌশল, সমঝোতা কিংবা ধোঁয়াশা ভাষা আর কার্যকর থাকে না। ইতিহাসের এই সন্ধিক্ষণে রাজনীতি কথা বলে অবস্থান দিয়ে, ঝুঁকি নিয়ে এবং ত্যাগের প্রস্তুতি দেখিয়ে। নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষকের চোখে সবচেয়ে স্পষ্ট যে সত্যটি ধরা পড়ে, তা হলো—বাংলাদেশের রাজনৈতিক নৈতিকতা আবার গভীর প্রশ্নের মুখে দাঁড়িয়ে, এবং এই প্রশ্নের উত্তর আর বিলম্ব সহ্য করে না। রাজপথ ও রাষ্ট্র—এই দুইয়ের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা বর্তমান সময়ই নির্ধারণ করবে, বাংলাদেশ ভবিষ্যতে কেবল একটি ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাষ্ট্র হবে, নাকি একটি ন্যায়ভিত্তিক ও সার্বভৌম রাষ্ট্রে রূপ নেবে।
জুলাই বিপ্লব কোনো আকস্মিক বিস্ফোরণ ছিল না। এটি ছিল দীর্ঘদিনের ভয়, দ্বিধা ও নীরবতার দেয়াল ভাঙার ফল। ৫ আগস্ট ২০২৪—শেখ হাসিনার পতনের দিন—শুধু একটি সরকারের পতন ঘটেনি; রাষ্ট্রীয়ভাবে উন্মোচিত হয়েছিল জনগণের জমে থাকা ক্ষোভ এবং ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ বিনির্মাণের একটি স্পষ্ট আকাঙ্ক্ষা। সেই দিন রাজপথে যে ভাষা উচ্চারিত হয়েছিল, তা কেবল ক্ষমতা বদলের আকাঙ্ক্ষা নয়; বরং ছিল সার্বভৌমত্ব, জবাবদিহি এবং মর্যাদাপূর্ণ রাষ্ট্রচিন্তার দাবি। এই প্রেক্ষাপটেই নতুন রাজনৈতিক কণ্ঠ দৃশ্যমান হয়—যাদের ভাষা ছিল ভিন্ন, দাবি ছিল মৌলিক, এবং উপস্থিতি ছিল প্রচলিত রাজনীতির জন্য অস্বস্তিকর।
এই ভিন্ন কণ্ঠগুলোর মধ্যে ওসমান হাদি হয়ে ওঠেন একটি স্বতন্ত্র রাজনৈতিক উচ্চারণ। আপসহীন ভাষায় তিনি কথা বলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের পক্ষে; স্পষ্টভাবে উচ্চারণ করেন ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে অবস্থান। ক্ষমতার শূন্যতায় যখন বহু রাজনৈতিক শক্তি নিজেদের ভবিষ্যৎ হিসাব-নিকাশে ব্যস্ত, হাদি তখন কথা বলছিলেন রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ কাঠামো নিয়ে। তার বক্তব্যে দলীয় সংকীর্ণতা ছিল না; ছিল একটি প্রজন্মের আত্মমর্যাদার ভাষা। এই স্বতন্ত্র অবস্থানই তাকে দ্রুত জনপ্রিয় করে তোলে, আবার একই সঙ্গে প্রচলিত রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্য গভীরভাবে অস্বস্তিকর করে তোলে।
এরপর আন্দোলনের ধারায় আসে একটি জটিল বাঁক। নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদ ও মাহফুজ আলম—প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের কাঠামোয় যুক্ত হন। এই সিদ্ধান্ত সমাজে দ্বিমুখী প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। একদিকে আশা জন্ম নেয়—রাষ্ট্রের ভেতর থেকে সংস্কারের সুযোগ তৈরি হবে; অন্যদিকে প্রশ্ন ওঠে—রাজপথের নৈতিক শক্তি কি এতে ক্ষয়প্রাপ্ত হচ্ছে? অনেক বিশ্লেষকের মতে, ক্ষমতার বাইরে থেকে চাপ সৃষ্টিকারী শক্তি হিসেবেই আন্দোলনটি আরও কার্যকর থাকতে পারত। এই দ্বন্দ্ব থেকেই সমন্বয়কদের ঘিরে গড়ে ওঠা ঐক্যে ধীরে ধীরে দেখা দেয় নীরব ফাটল, যা আন্দোলনের গতি ও বিশ্বাসযোগ্যতাকে প্রভাবিত করে।
তবে রাজনীতিতে শেষ পর্যন্ত উদ্দেশ্য নয়, পরিণতিই বিচার্য হয়। ২০২৬ সালের নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার আগমুহূর্তে তিন উপদেষ্টার পদত্যাগ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার সঙ্গে আন্দোলনের আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক ছিন্ন করে দেয়। তারা ফিরে আসেন রাজপথের বাস্তবতায়। ঠিক এই সন্ধিক্ষণেই আসে সবচেয়ে ভয়াবহ ঘটনা—১২ ডিসেম্বর ২০২৫, ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র ওসমান হাদি গুলিবিদ্ধ হন। প্রশ্ন ওঠে—কে গুলি করল? আওয়ামী লীগ, বিএনপি না জামায়াত? কিন্তু এই প্রশ্ন যতটা দলভিত্তিক মনে হয়, বাস্তবে তা ততটাই কাঠামোগত। এটি কোনো একক দলের কাজ নয়; এটি দীর্ঘদিন ধরে লালিত একটি দমনমূলক রাজনৈতিক সংস্কৃতির ফল, যেখানে স্বাধীন কণ্ঠ সব দলের কাছেই অস্বস্তিকর।
হাদির শরীরে বিদ্ধ গুলি আসলে একজন মানুষকে নয়, একটি সম্ভাবনাকে আঘাত করেছে। তিনি প্রতিনিধিত্ব করছিলেন এমন একটি প্রজন্মকে, যারা বাংলাদেশকে কারও প্রভাববলয়ের ছায়ায় নয়, নিজের পায়ে দাঁড়ানো রাষ্ট্র হিসেবে কল্পনা করে। এই ঘটনার গুরুত্ব অনুধাবন করে অন্তর্বর্তী সরকার ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট—ফেজ ২’ শুরু করেছে। এটি নিঃসন্দেহে একটি শক্ত বার্তা। তবে নিরপেক্ষ বিশ্লেষকের প্রশ্ন থেকেই যায়—এই অভিযান কি কেবল প্রতীকী হবে, নাকি সত্যিই রাজনৈতিক সহিংসতা ও সন্ত্রাসের শিকড় পর্যন্ত পৌঁছাতে পারবে? রাষ্ট্র যদি এই প্রশ্নে ব্যর্থ হয়, তবে হাদির রক্ত কেবল আরেকটি রাজনৈতিক পরিসংখ্যানে পরিণত হবে।
এই উত্তাল বাস্তবতার মধ্যেই নতুন একটি খবর রাজনীতির অঙ্গনে আলোড়ন তুলেছে—দীর্ঘ নির্বাসনের পর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ২৫ ডিসেম্বর লন্ডন থেকে দেশে ফেরার সম্ভাব্য ঘোষণা। এটি নিঃসন্দেহে বিএনপির জন্য একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত। কিন্তু একই সঙ্গে এটি বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য একটি বড় পরীক্ষা। কারণ ঠিক এই সময়েই দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে। একদিকে মায়ের শয্যাশায়ী নীরবতা, অন্যদিকে ছেলের প্রত্যাবর্তনের প্রতীক্ষা—এই দৃশ্যটি কেবল পারিবারিক নয়, বরং গভীর রাজনৈতিক প্রতীক। এটি ক্ষমতা, ত্যাগ ও দায়বদ্ধতার প্রশ্নকে নতুনভাবে সামনে নিয়ে আসে।
তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তন যদি কেবল ক্ষমতার পুনর্গঠনের কৌশল হয়, তবে তা ইতিহাসে আরেকটি সুযোগ নষ্ট হিসেবে চিহ্নিত হবে। কিন্তু যদি তিনি হাদি-পরবর্তী এই রক্তাক্ত বাস্তবতায় রাজনীতির ভাষা বদলাতে পারেন—সহিংসতার বিরুদ্ধে স্পষ্ট অবস্থান নিতে পারেন, স্বাধীন কণ্ঠের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রশ্নে আপসহীন হন—তবে এই প্রত্যাবর্তন একটি নতুন রাজনৈতিক অধ্যায়ের সূচনা করতে পারে। একইভাবে, খালেদা জিয়ার অসুস্থতা আজ বিএনপির জন্য শুধু আবেগের বিষয় নয়; এটি দলটির নৈতিক উত্তরাধিকারের প্রশ্নও সামনে এনে দিয়েছে।
এই মুহূর্তে হাদি জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। তিনি ফিরলে তা হবে মহান আল্লাহর অশেষ মেহেরবানি। আর না ফিরলে—এই ঘটনা আর ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডি হিসেবে সীমাবদ্ধ থাকবে না; তা হয়ে উঠবে একটি জাতির নৈতিক মামলা। তখন আর অতীতের কৌশলগত ভুল নিয়ে বিতর্কের অবকাশ থাকবে না। কারণ জাতি ইতোমধ্যেই বুঝে গেছে—রাজনৈতিক ভুল সংশোধনযোগ্য, কিন্তু গুলি অমার্জনীয়। এই উপলব্ধিই আবার রাজপথকে জাগিয়ে তুলেছে। সামনে দাঁড়িয়ে আছে নির্মম সমীকরণ—ঘরে ফিরলে নিশ্চিত মৃত্যু; রাজপথে থাকলে—হয় মৃত্যু, নয় বিজয়।
চূড়ান্ত মুহূর্তে ইতিহাস কোনো ব্যাখ্যা চায় না—সে শুধু নাম লেখে। কে দাঁড়িয়েছিল, আর কে নীরব ছিল। হাদি ফিরুক বা না ফিরুক, তারেক রহমান ফিরুন বা না ফিরুন, খালেদা জিয়া সুস্থ হোন বা না হোন—এই সময়টি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইশতেহার রচনা করে দিচ্ছে। কারণ কিছু রক্ত ইতিহাসে থামার কারণ হয় না; হয়ে ওঠে এগিয়ে যাওয়ার নির্দেশ। আর ইতিহাস—শেষ পর্যন্ত—সেই নির্দেশই মেনে চলে।
লেখক ও সংগঠক
