বাংলাদেশ আজ এমন এক ভূ-বাস্তবতার মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে, যার গভীরতা আমাদের চোখে দেখা যায় না, কিন্তু যার প্রতিধ্বনি অনুভূত হয় বারবার। ভূমিকম্প কখনো শব্দ করে আসে না; এটি আসে নীরবে, কিন্তু আঘাত করে প্রচণ্ড শক্তিতে। ২০১৭ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ভূকম্পনের যে ধারাবাহিক বৃদ্ধি দেখা গেছে, তা শুধু ভূতাত্ত্বিক পরিসংখ্যান নয়-এটি আগাম সতর্কসংকেত। ২০২৫ সালের ২১ নভেম্বর নরসিংদীর ঘোড়াশালে ৫ দশমিক ৫ মাত্রার ভূমিকম্প সেই সতর্কবার্তাকে আরও স্পষ্ট করেছে। বাইরে যা শান্ত, ভেতরে তা নয়-এই সত্য আমরা প্রায়ই ভুলে যাই। ভূগর্ভে যে শক্তি জমছে, তা যেন এক অদৃশ্য টাইমার, যা থামার নামে থামে না। আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকেরা বহু বছর ধরে বলছেন, দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-প্লেটগুলো এমনভাবে সরে যাচ্ছে, যার প্রভাব সরাসরি বাংলাদেশের ওপর পড়ছে। আর আমাদের নগর কাঠামো সেই চাপ সামলানোর জন্য প্রস্তুত কি না-এই প্রশ্নের উত্তর এখনো হৃদয়-ভাঙা নীরবতা।

বাংলাদেশের এই ঝুঁকির পেছনে রয়েছে জটিল ভূতাত্ত্বিক প্রক্রিয়া। আমাদের দেশ পৃথিবীর তিনটি বড় ভূ-প্লেটের সন্ধিস্থলে অবস্থিত-ভারতীয় প্লেট, ইউরেশীয় প্লেট এবং বার্মা মাইক্রোপ্লেট। এই তিন শক্তির সংঘর্ষে ভূগর্ভের চাপে সঞ্চিত শক্তির পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে। বিজ্ঞানীদের মতে, বাংলাদেশের সবচেয়ে বিপজ্জনক দুটি ফল্ট হচ্ছে মধুপুর ফল্ট এবং ডাউকি ফল্ট। মধুপুর ফল্ট যদি বড় মাত্রায় সরে যায়, তবে ঢাকার ওপর তা ভয়াবহ আঘাত আনবে-এ কথা বহু গবেষণা ও আন্তর্জাতিক বৈজ্ঞানিক প্রতিবেদনেই উঠে এসেছে। আন্তর্জাতিক প্রবন্ধে ঢাকা শহরকে ‘‘বিশ্বের সবচেয়ে অপ্রস্তুত মহানগরী’’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। নগর বিশেষজ্ঞদের মতে, আমাদের সবচেয়ে বড় বিপদ ‘ভূমিকম্প’ নয়, ‘প্রস্তুতিহীনতা’। আমরা যে শহরটি গড়ে তুলেছিÑসেটি ভূমির চেয়ে আকাশের দিকে বেশি বিস্তৃত; কিন্তু সেই উল্লম্ব বৃদ্ধির কোনো বৈজ্ঞানিক নিরাপত্তা-মানদণ্ড ছিল না। নগর অবকাঠামো ভাগ্য-নির্ভর হলে যে বিপদ আসে, তাকে সামলানো অসম্ভব হয়ে পড়ে।

ঢাকা আজ এক অগোছালো কংক্রিট নগর। এখানে রয়েছে লক্ষাধিক পুরনো ভবন, অসংখ্য অনুমোদনহীন স্থাপনা, সংকীর্ণ রাস্তা, গলির ওপর গলি—যেখানে উঁচু-নিচু বৈদ্যুতিক তারের জঙ্গল ঝুলে থাকে। গবেষণা বলছে, মাত্র ৭ মাত্রার একটি ভূমিকম্পে ঢাকায় প্রায় ৭২ হাজার ভবন ধসে পড়তে পারে। এই সংখ্যা কোনো কল্পনা নয়; এটি একটি সরকারি কমিশনের গবেষণা-নথিভুক্ত বাস্তবতা। শুধু ভবন ধসই নয়, এক সঙ্গে ঘটবে আগুন, বিস্ফোরণ, গ্যাসলাইনে ফাটল, পানির লাইন ছিন্ন হওয়া, সড়ক অচল হয়ে যাওয়া-সব মিলিয়ে রাজধানী এক অচল শহরে পরিণত হবে। সাভারের একটি ভবন ধসের উদ্ধার অভিযানই যখন সাত দিন ধরে চলে, তখন ভাবা যায়-একসঙ্গে শত শত ভবন ধসে পড়লে কী ঘটবে। চিকিৎসা, জরুরি সেবা, উদ্ধার-কিছুই কার্যকরভাবে কাজ করতে পারবে না। যে শহরের দুটি প্রধান সড়কই কয়েক মিনিটে অচল হয়ে যায়, সেই শহর একটি বড় ভূমিকম্পে স্থবিরতার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হবে।

সিলেট, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার অঞ্চলের বাস্তবতা আরও ভয়াবহ। সিলেট বহু বছর ধরে মৃদু কম্পনের অভিজ্ঞতা অর্জন করছে-যা গবেষকদের মতে বড় ভূমিকম্পের পূর্বলক্ষণ। ডাউকি ফল্ট পৃথিবীর অন্যতম সক্রিয় ফল্টলাইন হিসেবে শনাক্ত। অন্যদিকে, চট্টগ্রাম-মায়ানমার সীমান্তবর্তী অঞ্চল একটি ‘‘মেগা-থ্রাস্ট জোন’’- যেখানে ৮ থেকে ৯ মাত্রার ভূমিকম্প হওয়ার শঙ্কা কয়েক দশক ধরে উল্লেখ করছেন আন্তর্জাতিক ভূগোল বিশেষজ্ঞরা। এই অঞ্চলে বড় কম্পন হলে শুধু ভবন ধ্বস নয়-সুনামির আশঙ্কাও প্রবল। কক্সবাজার-টেকনাফ উপকূলীয় অঞ্চলটি এমন এক এলাকায় অবস্থিত যেখানে সামান্য ঢেউও প্রকৃত দুর্যোগে রূপ নিতে পারে। গবেষণা বলছে, বঙ্গোপসাগরের তলদেশের যে অংশে চাপ জমছে, তার প্রভাব সরাসরি বাংলাদেশের উপকূলীয় ভূখণ্ডে এসে আঘাত হানতে পারে।

কিন্তু ভূমিকম্পের ভয়াবহতা শুধু ভূতত্ত্বের বিষয় নয়; এটি সমাজ, রাষ্ট্র এবং মানুষের আচরণেরও গভীর পরীক্ষা। দুর্যোগকে আমরা অনেক সময় হাসির বিষয় বানাই-মৃদু কম্পনেই সামাজিক মাধ্যমে স্ট্যাটাস, ভিডিও, কৌতুক। অথচ ভূমিকম্প এমন একটি দুর্যোগ, যার প্রতি অবহেলা মানে আত্মহনন। জাপান, চিলি, তুরস্কের মতো দেশগুলো দেখিয়েছে-ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি কমানো যায়, যদি নাগরিকদের প্রস্তুতি থাকে, রাষ্ট্রের পরিকল্পনা থাকে এবং দুর্নীতিমুক্ত নির্মাণমানদণ্ড থাকে। জাপানি শিশুরা স্কুলজীবন থেকেই ভূমিকম্প মোকাবিলার প্রশিক্ষণ পায়। মহড়া তাদের দৈনন্দিন জীবনের অংশ। অথচ বাংলাদেশে এমন প্রশিক্ষণ নেই বললেই চলে। জনসংখ্যার আধিক্য, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিপুল বৈষম্য, সামান্য ঘটনা নিয়ে সামাজিক আতঙ্ক-সব মিলিয়ে আমরা প্রস্তুতিহীনতার অচলায়তনে আবদ্ধ।

অর্থনৈতিক দিক থেকেও একটি বড় ভূমিকম্প বাংলাদেশকে পেছনে ঠেলে দিতে পারে কয়েক দশক। বুয়েট এবং জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির গবেষণা অনুযায়ী, যদি মধুপুর ফল্টে ৬ দশমিক ৯ মাত্রার ভূমিকম্প হয়, ৮ লাখ ৬৫ হাজারেরও বেশি ভবন ধসে যেতে পারে। অর্থনৈতিক ক্ষতি হতে পারে ২৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি। ধসে পড়বে বাণিজ্যিক অবকাঠামো, ক্ষতিগ্রস্ত হবে প্রধান প্রধান শিল্প, বৈদেশিক বাণিজ্য থমকে যাবে। ঢাকা শহরে একসঙ্গে ৫০ হাজার আহত মানুষের চিকিৎসার সক্ষমতা নেই-এমন পরিস্থিতিতে দেশব্যাপী চিকিৎসা ও উদ্ধার সহজেই ধসে পড়তে পারে। বিদ্যুৎ, পানি, যোগাযোগ-সবই হয়ে উঠতে পারে শুন্য।

এই ভয়াবহ সম্ভাবনার বিরুদ্ধে এখনই আমাদের কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। পুরনো ও ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলোর কাঠামোগত অডিট বাধ্যতামূলক করতে হবে। ভবন নির্মাণ বিধিমালা কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে হবে। সিটি করপোরেশন, ফায়ার সার্ভিস, সশস্ত্র বাহিনী, সিভিল ডিফেন্স ও স্বাস্থ্য খাতকে সমন্বিত দুর্যোগ-পরিকল্পনার অধীনে কাজ করতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বারবার মহড়া চালু করতে হবে; গণমাধ্যমে সচেতনতা প্রচার বাড়াতে হবে; স্থানীয় পর্যায়ে প্রশিক্ষিত স্বেচ্ছাসেবক কাঠামো তৈরি করতে হবে। এগুলো কেবল প্রকল্প নয়-জাতীয় নিরাপত্তার মৌলিক স্তম্ভ।

শেষ পর্যন্ত ভূমিকম্প আমাদের মনে করিয়ে দেয়-মানুষ প্রকৃতির তুলনায় কত নগণ্য এবং আমাদের সভ্যতা কত ভঙ্গুর। অল্প সময়ের কম্পনে শত বছরের পরিশ্রম, স্থাপত্য, স্বপ্ন, পরিশ্রম ভেঙে পড়তে পারে। তাই সঠিক সময়ের প্রস্তুতি শুধু প্রয়োজন নয়, এটি আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়া, প্রকৃতির প্রতি বিনয়ী হওয়া এবং বৈজ্ঞানিক পরিকল্পনা গ্রহণ-এসব একত্রে না হলে ভবিষ্যৎ নিরাপদ হবে না। বাংলাদেশ এখন একটি প্রতিফলন-বিন্দুতে দাঁড়িয়ে-আমরা প্রস্তুতির পথে হাঁটব, নাকি বিপদের অপেক্ষায় থাকব-এটাই এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। সময় আছে, কিন্তু খুব বেশি নয়। এখনই আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে-জীবনকে বাঁচাবো, নাকি অবহেলাকে আঁকড়ে ধরে নিজেরাই নিজেদের দুর্বল করব।

: লেখক ও সংগঠক