বাংলাদেশের রাজনীতি যেন এক অনন্ত দোলাচল। মুখ পাল্টায়, দল পাল্টায়, কিন্তু রক্তে মিশে থাকা পদ-পদবি ও ক্ষমতার তৃষ্ণা পাল্টায় না। ৫ আগস্টের আগেও যারা স্লোগান দিতো পরিবর্তনের, তারাই আজ আবার নতুন মুখোশে সেই পুরোনো সিংহাসনে বসেছে। রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতরে ক্ষমতার হিসাব এখন নীতির চেয়ে বড়। পদ না পেলে অভিমান, নমিনেশন না পেলে বিদ্রোহ। অথচ সাধারণ জনগণের জন্য কোনো রিভিউ বোর্ড নেই, কোনো আপিলের পথ নেই। ক্ষমতাবানদের রিভিউ আবেদন যায় দলের হাইকমান্ডে, কিন্তু সাধারণ মানুষের আবেদন ফেরে নীরব শূন্যতায়। আমরা জিজ্ঞাসা করতে পারি—এই দেশ কার? আওয়ামী লীগের? বিএনপির? জামাতের? নাকি নতুন দলগুলোর? আসলে এদেশ কারও নয়, এদেশ এখন ক্ষমতাবানদের অলিখিত যৌথ সম্পত্তি।
প্রশাসনের প্রতিটি স্তরে আজ এক অদৃশ্য রাজতন্ত্র কাজ করছে। যে দপ্তরে যার চেয়ার, সে-ই যেন রাজা। দায়িত্ব এখন আর দায়িত্ব নয়, তা পরিণত হয়েছে সুবিধা ভোগের লাইসেন্সে। হাসপাতালের ডাক্তার, বিদ্যালয়ের শিক্ষক, থানার কর্মকর্তা কিংবা অফিসের পিয়ন—সবাই যেন নিজ নিজ পরিসরে এক-একজন শাসক। সাধারণ মানুষ সেখানে প্রজা। বিশ্বব্যাংকের গবেষণায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশের প্রশাসনিক জবাবদিহি দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে নিচে। অথচ এই আমলাতন্ত্রের ওপরই দাঁড়িয়ে আছে জনগণের জীবনযাত্রা, ন্যায়বিচার, মৌলিক অধিকার। আমরা নীরবে শুধু দেখি—অধিকারহীনতার অন্ধকারে রাষ্ট্রের আলো ক্রমশ নিভে যাচ্ছে।
রাজনীতি আজ আদর্শের নয়, ট্যাগের রাজনীতি। কে কোন দলে, কে কোন ব্যানারে, কে কোন পতাকার নিচে—এই পরিচয়ই নির্ধারণ করে মানুষটির ভবিষ্যৎ। নিরপেক্ষ হওয়াই এখন অপরাধ। কেউ সত্য কথা বললে বলা হয়, সে হয়তো কোনো পক্ষের এজেন্ট। অথচ গণতন্ত্রের প্রকৃত সৌন্দর্য নিরপেক্ষতার ভেতরেই নিহিত। ৫ আগস্টের আগেও যারা পরস্পরের শত্রু ছিল, ৫ আগস্টের পরেও তারা একই মঞ্চে এসে নিজেদের ভাগাভাগি নিয়ে লড়ছে। মুখ বদলেছে, কিন্তু চরিত্র বদলায়নি। রাজনীতি এখন নাটক, যেখানে দৃশ্যের পরিবর্তন আছে, কিন্তু অভিনেতারা একই।
এই দেশে দুর্নীতি এখন শুধু রাজনীতির রোগ নয়, এটি সমাজের রক্তে মিশে গেছে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের তথ্য অনুযায়ী, দেশের ৯৩ শতাংশ নাগরিক বিগত এক বছরে কোনো না কোনো দপ্তরে ঘুষ দিতে বাধ্য হয়েছে। রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রতিটি চাকায় মিশে আছে সুবিধাবাদ। যে বেশি দেয়, সে-ই পায় আগে। যে বেশি কাছে থাকে ক্ষমতার, সে-ই নিরাপদ। উন্নয়নের বুলি যত জোরে উচ্চারিত হচ্ছে, ততই বাড়ছে বৈষম্যের গভীর খাদ। শহরে রাতের আলো বাড়ছে, কিন্তু গ্রামের শিশুর মুখের আলো নিভে যাচ্ছে। প্রতিটি উন্নয়ন যেন এক নতুন অবিচারের সিলমোহর।
তাহলে জুলাই বিপ্লবের অর্থ কী ছিল? যদি দুর্নীতি, অনিয়ম, সুবিধাবাদ, ক্ষমতার দাপট—সব আগের মতোই চলতে থাকে, তবে কি আমরা শুধু শাসকের নাম বদলেছি? জনগণ যখন আশা করেছিল ন্যায় ও সমতার সমাজ আসবে, তখন রাজনীতি আবার নতুন বিভাজনের জন্ম দিয়েছে। এখন আর জনগণ রাজনীতির কেন্দ্র নয়, বরং রাজনীতি জনগণের উপরে বসা এক ছায়ারাজ্য। আমরা ক্রমশ দেখছি—জুলাইয়ের আগুন এখন নিভে গিয়ে ধোঁয়ায় পরিণত হয়েছে, যে ধোঁয়া আড়াল করে রাখছে পুরোনো অন্যায়েরই ধারাবাহিকতা।
এই ধারাবাহিকতার সবচেয়ে বড় শিকার সাধারণ মানুষ। চা-ওয়ালা, রিকশাচালক, পথশিশু, টোকাই—তাদের জীবনে রাজনীতি মানে বঞ্চনা। কৃষক আজও ক্ষেতে দাঁড়িয়ে থাকে বৃষ্টির আশায়, জেলে ফেরে শূন্য হাতে, দিনমজুর সন্ধ্যায় ফিরে আসে না খেয়ে। তাদের জন্য কোনো নীতি নেই, কোনো প্রকল্প নেই। দেশের ৪ কোটি মানুষ এখনও দারিদ্র্যসীমার নিচে, তাদের জন্য সংসদে কোনো প্রশ্ন ওঠে না। সমাজে সবচেয়ে নিচে থাকা মানুষেরাই রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় বিনিয়োগকারী—তারা তাদের শ্রম, ঘাম, সময়, এমনকি স্বপ্নও দিয়ে গেছে, তবুও তারা সবচেয়ে বঞ্চিত।
আরেকটি ভয়ংকর বাস্তবতা হলো শিক্ষিত বেকারত্ব। দেশে আজ প্রায় ৪৫ লাখ উচ্চশিক্ষিত বেকার। প্রতিদিন নতুন নতুন ডিগ্রি যোগ হচ্ছে, কিন্তু কমছে কর্মসংস্থান। একজন স্নাতক যুবক যখন প্রবাসে ক্লিনার হওয়ার স্বপ্ন দেখে, তখন বুঝতে হয়—রাষ্ট্রের শিক্ষা নীতিই ব্যর্থ হয়েছে। উন্নয়ন কেবল তখনই সার্থক, যখন তা মর্যাদার কর্মে রূপ নেয়। কিন্তু আমাদের দেশে শিক্ষিত তরুণেরা কাজের অভাবে হতাশ হয়ে আত্মহত্যা করছে, অনেকে হয়ে যাচ্ছে মাদকাসক্ত, কেউ আবার রাজনীতির নামে ভাড়াটে সন্ত্রাসে জড়িয়ে পড়ছে। এ এক ভয়ংকর সামাজিক ট্র্যাজেডি, যা আমাদের ভবিষ্যৎকে অন্ধকারে ঠেলে দিচ্ছে।
আমরা পরিবর্তন চাই—কিন্তু সেই পরিবর্তন যেন রঙ বদলের নয়, মন বদলের হয়। পদ নয়, নীতি হোক রাজনীতির মূল ভিত্তি। ক্ষমতার মঞ্চে নয়, মানুষের হৃদয়ে ফিরুক রাজনীতি। দেশটাকে ফেরাতে হবে মানবিকতার পথে, দায়িত্বকে ফেরাতে হবে কর্তব্যের স্থানে। চেতনার শ্লোগান নয়, বাস্তব কর্মে চাই পুনর্জাগরণ। এই অশান্তি, এই হিংসা, এই ক্ষমতার কামড়াকামড়ি আর ভালো লাগে না। আমরা চাই শান্তির বৃষ্টি—যেখানে সবাই সমান মর্যাদায় বাঁচবে, কেউ কারও দাস হবে না, এবং এই প্রিয় বাংলাদেশ হবে সত্যিকারের জনগণের দেশ—যেখানে রাজনীতি নয়, মানুষই হবে আসল শক্তি।
