সুদানের আকাশ আজ ধোঁয়া, ধুলো এবং রক্তের গন্ধে ভারাক্রান্ত। শিশুদের কান্না, মায়েদের আর্তনাদ, শহরের ধ্বংসাবশেষের নীচে চাপা পড়া মানবতার অবশেষ—এই দৃশ্য আমাদের সময়ের অন্যতম ভয়াবহ অধ্যায়। রাস্তায়, ঘরবাড়ি ধ্বংসের ভগ্নিপর্যায়ে, হাসপাতালের মরীচিকায়—সব জায়গায় মানবিকতার অবনতি স্পষ্ট। কিন্তু প্রশ্ন একটাই—সুদানে আসলে কারা এই গণহত্যা চালাচ্ছে? কার স্বার্থে এই মৃত্যুর রাজনীতি? ইতিহাস, ভূরাজনীতি, ধর্ম, এবং ক্ষমতার প্রতিযোগিতার জটিল বয়ন না বুঝে এই প্রশ্নের উত্তর সহজে মিলবে না। সুদানের ইতিহাসে বিভাজন কখনোই নতুন নয়। বিংশ শতকের শেষ দিকে আফ্রিকার এই বৃহত্তম দেশটি দ্বিধাবিভক্ত—উত্তরে আরব বংশোদ্ভূত মুসলিম সম্প্রদায়, দক্ষিণে কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকান সম্প্রদায়। ভাষা, সংস্কৃতি, জীবনদর্শন—সবকিছুই ভিন্ন। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকরা দেশটিকে আলাদা অংশে ভাগ করে রেখেছিল, স্বাধীনতার পরও সেই বিভাজন মুছে যায়নি; বরং সময়ের সঙ্গে তা গভীর হয়েছে। দক্ষিণ সুদানের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন, দারফুরের হত্যাযজ্ঞ, সেনা অভ্যুত্থান—সব মিলিয়ে সুদান হয়ে উঠেছে দীর্ঘস্থায়ী ট্র্যাজেডির প্রতীক।
আজকের হত্যাযজ্ঞের কেন্দ্রবিন্দু হলো দুটি শক্তি—সুদানের সেনাবাহিনী এবং র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস (আরএসএফ)। প্রথমটি রাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিক সামরিক বাহিনী, দ্বিতীয়টি মূলত জঞ্জাওয়িদ মিলিশিয়াদের দ্বারা গঠিত—যারা ২০০৩ সালে দারফুরে গণহত্যার জন্য অভিযুক্ত। এক সময় তারা রাষ্ট্রের আনুগত্যে ছিল, এখন রাষ্ট্রের প্রতিদ্বন্দ্বী। তাদের নেতৃত্বে আছেন দুই প্রভাবশালী ব্যক্তি—জেনারেল আব্দেল ফাত্তাহ আল-বুরহান (সেনাপ্রধান) এবং মোহাম্মদ হামদান দাগালো বা হেমেদতি (দ্রুত প্রতিক্রিয়া বাহিনী নেতা)।
২০২৩ সালের এপ্রিল মাসে এই দুই জেনারেল ক্ষমতার দ্বন্দ্বে লিপ্ত হন, তখন খার্তুমের আকাশ থেকে আগুন ঝরে। হাসপাতাল, মসজিদ, স্কুল, এমনকি জাতিসংঘের ত্রাণকেন্দ্র পর্যন্ত ধ্বংসের মুখোমুখি হয়। আলজাজিরা, বিবিসি, রয়টার্স ও দ্য গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে—প্রায় ২০,০০০ মানুষ নিহত, ৭০ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত, ২৫ মিলিয়ন মানুষ খাদ্য ও চিকিৎসাহীন অবস্থায় মানবিক বিপর্যয়ের মুখে। জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনার ভলকার টুর্ক একে বলেছেন, “এটি শুধু গৃহযুদ্ধ নয়; এটি রাষ্ট্র ও মিলিশিয়ার যৌথ পরিকল্পিত গণহত্যা।”
দারফুর অঞ্চলের নিধনযজ্ঞের ইতিহাস পুরনো। ২০০৩ সালে আরব মিলিশিয়ারা কৃষ্ণাঙ্গ গ্রামগুলো পুড়িয়ে দিয়েছিল, আজও একই কৌশল, একই নিষ্ঠুরতায় চালাচ্ছে আরএসএফ। আল-জিনাইনা ও নিয়ালা শহরে হাজার হাজার নারী ধর্ষিত, শিশু হত্যা করা হচ্ছে চোখের সামনে। রয়টার্সের এক বেঁচে ফেরা নারী বলেছেন, “আমার স্বামীকে মসজিদের ভিতরে হত্যা করা হলো, তারপর আমাকে ও আমার মেয়েকে ধরে নিয়ে গেল।” মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ জানাচ্ছে, আজ আরএসএফ আধুনিক অস্ত্র, ড্রোন ও মর্টার ব্যবহার করছে—যার উৎস সম্ভবত বাহ্যিক শক্তি। এই বাহ্যিক শক্তিগুলো কারা? আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, সুদান আজ “আঞ্চলিক প্রতিযোগিতার যুদ্ধক্ষেত্র”। সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মিশর, রাশিয়া এবং ওয়াগনার গ্রুপ—সবাই এখানে স্বার্থ খুঁজছে। রাশিয়া লাল সাগরের উপকূলে নৌঘাঁটি স্থাপন করতে চায়, বিনিময়ে আরএসএফকে অস্ত্র দিচ্ছে। মিশর সমর্থন দিচ্ছে সুদানের সেনাবাহিনীকে, কারণ তারা বাহিনীর উত্থানকে নিজেদের নিরাপত্তার জন্য হুমকি মনে করছে। ফলে, এই যুদ্ধ শুধু সুদানের নয়—এটি আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতির ছায়াযুদ্ধ।
সৌদি আরব ও বাহরাইনে কয়েক দফা শান্তি আলোচনা হলেও ব্যর্থ হয়েছে। উভয় পক্ষ যুদ্ধবিরতিতে অনিচ্ছা দেখিয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সুদানের সংঘাতের প্রতি বৈশ্বিক আগ্রহ কম। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি জানিয়েছে, ২ কোটি ৪০ লাখ মানুষ চরম খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার মুখে। এসব কারণে সুদানের সংঘাত আজ বিশ্বের ‘বিস্মৃত যুদ্ধ’ হিসেবে পরিচিত। নির্বাচিত শহরগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে উত্তর দারফুর রাজ্যের রাজধানী এল-ফাশের। রাস্তায় পড়ে আছে শত শত লাশ। কবর দেওয়ার মতো কেউ নেই। শহরটি দখল করেছে আরএসএফ। এ সময় কমপক্ষে ১,৫০০ মানুষ নিহত হয়েছে। শুধু একটি হাসপাতালে নিহত হয়েছেন প্রায় ৪৬০ জন। জাতিসংঘ জানাচ্ছে, শহরটিতে আটকে থাকা সাধারণ মানুষ মারাত্মক বিপদের মধ্যে। আহতরা খোলা আকাশের নিচে পড়ে আছেন। শহর থেকে প্রায় ৩৬,০০০ মানুষ ৭০ কিলোমিটার দূরের তাভিলা শহরে পালিয়েছে, যেখানে ইতিমধ্যে ৬ লাখ ৫০ হাজারের বেশি বাস্তুচ্যুত মানুষ আশ্রয় নিয়েছে।।হায়াত নামে এক নারী জানান, সাতজন আরএসএফ সদস্য তাদের বাড়িতে ঢুকে লুটপাট চালায় এবং তার ১৬ বছর বয়সি ছেলেকে তার সামনেই হত্যা করে। তিনি বলেন, “আমরা রাস্তায় অসংখ্য লাশ পড়ে থাকতে দেখেছি, আহতদের কেউ উদ্ধার করতে পারেনি।” আরেক বেঁচে যাওয়া ব্যক্তি হুসেইন বলেন, এল-ফাশেরের পরিস্থিতি ভয়াবহ। মৃতদেহগুলো রাস্তায় পড়ে আছে, তাদের কবর দেওয়ার মতো কেউ নেই। অন্যদিকে, তাভিলা শরণার্থী শিবিরে কর্মরত নরওয়েজিয়ান রিফিউজি কাউন্সিল জানায়, পালিয়ে আসা মানুষের সংখ্যা এখনও অনেক কম। তারা আশঙ্কা করছেন, যারা রওনা দিয়েছিল, তাদের অনেকেই পথেই মারা গেছে।
জাতিসংঘের মহাসচিবের মুখপাত্র স্টিফেন ডুজারিক জানিয়েছেন, দারফুরে ত্রাণ কার্যক্রম জোরদারের জন্য সেন্ট্রাল ইমার্জেন্সি রেসপন্স ফান্ড থেকে ২০ মিলিয়ন ডলার সহায়তা অনুমোদন করা হয়েছে। তিনি বলেন, ৪৫০ জনেরও বেশি মানুষকে হত্যার ঘটনায় আমরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। তাদের মধ্যে রোগী, স্বাস্থ্যকর্মী ও বেসামরিক নাগরিক ছিলেন। সুদান বিশেষজ্ঞ শায়না লুইস বলেন, দারফুরে এ হত্যাযজ্ঞ অত্যন্ত মর্মান্তিক। “আমরা এক বছরেরও বেশি সময় ধরে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এই গণহত্যার ঝুঁকি সম্পর্কে সতর্ক করেছিলাম, কিন্তু তেমন সাড়া পাওয়া যায়নি। মহাকাশ থেকে পাওয়া স্যাটেলাইট চিত্রেও রক্তাক্ত দৃশ্য দেখা যাচ্ছে—বিশাল এলাকায় লালচে রঙে ঢেকে আছে মাটি এবং মৃতদেহের মতো ছায়া ফুটে উঠছে।” সহিংসতায় জর্জরিত এল-ফাশের শহরে এখনো খাদ্য, পানি ও ওষুধের চরম সংকট। মানবিক সংগঠনগুলো বলছে, এটি সাম্প্রতিক সময়ের অন্যতম ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে কূটনীতিক ও শীর্ষ কর্মকর্তারা তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন। সাম্প্রতিক দিনগুলোতে জাতিগত হত্যার বিস্তৃত রিপোর্টের পর যুক্তরাজ্য জরুরি বৈঠকের আহ্বান জানায়। আফ্রিকার জন্য জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব মার্থা আমা আকইয়া পবি বলেন, “পরিস্থিতি এক কথায় ভয়াবহ। বিভিন্ন এলাকায় গণহত্যা ও বাড়ি বাড়ি তল্লাশির সময় নির্বিচারে হত্যার বিশ্বাসযোগ্য তথ্য রয়েছে। মানুষ শহর ছাড়ার চেষ্টা করলেও কেউ নিরাপদ নয়।”
জাতিসংঘের মানবিক বিষয়ক সহকারী মহাসচিব টম ফ্লেচার বলেন, “এল ফাশের এমনিতেই মানবিক বিপর্যয়ের কেন্দ্রস্থল ছিল, এখন এটি আরও ভয়াবহ নরকে পরিণত হয়েছে।” সৌদি মাতৃত্ব হাসপাতাল এলাকায় প্রায় ৫০০ জন নিহত হওয়ার ঘটনাকে তিনি “অত্যন্ত নিন্দনীয়” হিসেবে বর্ণনা করেছেন। হাজার হাজার মানুষ তাভিলায় পালিয়ে যাচ্ছে, যেখানে নারী ও শিশুরা নির্যাতন, অপহরণ ও চাঁদাবাজির শিকার হচ্ছেন। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ একটি বিবৃতিতে জানিয়েছে, সাম্প্রতিক সহিংসতা বেসামরিক জনগণের ওপর ভয়াবহ প্রভাব ফেলেছে। পরিষদের সদস্যরা আরএসএফের হাতে বেসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে সংঘটিত হত্যাযজ্ঞ, নির্বিচার আটক ও তাৎক্ষণিক মৃত্যুদণ্ডের নিন্দা জানিয়েছেন।
যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী স্টিফেন ডাউটি বলেছেন, “আরএসএফের অগ্রযাত্রায় বেসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে সংঘটিত হত্যাযজ্ঞ ও জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতি ভয়াবহ ও গভীর উদ্বেগজনক।” লিবারেল ডেমোক্র্যাট দলের ক্যালাম মিলার সকল অস্ত্র রপ্তানি সাময়িকভাবে বন্ধ রাখার আহ্বান জানান। ‘দ্য গার্ডিয়ান’-এর প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্রিটিশ সামরিক সরঞ্জাম ব্যবহারের প্রমাণ জাতিসংঘে উপস্থাপিত হয়েছে।
আমিরাত সরকার বারবার জানিয়েছে, তারা আরএসএফকে কোনো সামরিক সহায়তা দেয়নি। মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ আমিরাত নেতৃত্বের ওপর লক্ষ্যভিত্তিক নিষেধাজ্ঞার আহ্বান জানিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্র্যাট সিনেটর ক্রিস ভ্যান হোলেন আমিরাতের কাছে অস্ত্র বিক্রি নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব দিয়েছেন। গত মাসে যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরব, মিশর ও ইউএই নিয়ে গঠিত ‘কোয়াড’ শান্তি রোডম্যাপ প্রকাশ করে। প্রস্তাবনায় তিন মাসের মানবিক যুদ্ধবিরতি, স্থায়ী অস্ত্রবিরতি এবং নয় মাসের মধ্যে বেসামরিক নেতৃত্বাধীন সরকার প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করা হয়েছিল। তবে তা বাস্তবায়িত হয়নি।
এই ভয়াবহ পরিস্থিতি শুধু সুদানের নয়, এটি আমাদের যুগের নৈতিক ব্যর্থতার প্রতীক। মানবতার মূল্যবোধ ও ন্যায়বোধের অবক্ষয় সেখানে চোখে পড়ছে। আমরা যদি এই ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা না নিই, আগামী প্রজন্ম আমাদের ক্ষমা করবে না। ইতিহাস বারবার প্রমাণ করেছে—যেখানে মানুষকে অবজ্ঞা করা হয়, সেখানেই সভ্যতা ধ্বংস হয়।
তবুও আশা হারানো যায় না। ইতিহাস সাক্ষী, প্রতিটি গণহত্যার পর মানবতা ফিরে এসেছে প্রতিবাদের রূপে। আজ যদি বিশ্বের মানুষ একত্রে বলে—“সুদানে গণহত্যা বন্ধ করো, ওরাও মানুষ”—তবেই এই অন্ধকার ভেদ করা সম্ভব। ইসলামী দেশগুলোরও উচিত মুসলিম জনগোষ্ঠীর দুর্দশায় বাস্তব উদ্যোগ নেওয়া, কেবল বিবৃতি নয়। কারণ, এক মুসলমানের রক্ত মানে পুরো মানবতার ক্ষত। পৃথিবীর কোথাও অন্যায় ঘটলে, আর আমরা নীরব থাকি—তাহলে সেই নীরবতাই একদিন আমাদের কণ্ঠ রুদ্ধ করবে। সুদানের রক্তমাখা মাটিতে প্রতিটি মুহূর্তে লেখা হচ্ছে ইতিহাস—কে পাশে দাঁড়ালো, আর কে মুখ ফিরিয়ে নিল।
-লেখক ও সংগঠক
