কিসের মধ্যে কী-এর মতো একটা অবস্থা গোটা রাজনীতির পথপরিক্রমায়। আল্লাহ ছাড়া কেউ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন ঠেকাতে পারে না বলে প্রত্যয় আছে সরকারের দিক থেকে। সমান্তরালে ব্যক্ত করা হয়েছে মহাগণ্ডগোলের শঙ্কাও। তাও স্বয়ং প্রধান উপদেষ্টার বরাতে। ‘নির্বাচন বানচালের চেষ্টা হচ্ছে, হঠাৎ আক্রমণ আসতে পারে’-আনুষ্ঠানিক ব্রিফ করে তার এমন শঙ্কার জানান দিয়েছেন প্রেস সচিব। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত নির্বাচনী প্রস্তুতিসংক্রান্ত উচ্চপর্যায়ের বৈঠক নিয়ে সাংবাদিকদের ব্রিফ করছিলেন তিনি। এমন উচ্চ পর্যায় থেকে আসা কোনো কথা বা শঙ্কার ওজন বেশি হওয়াই স্বাভাবিক। রাজনৈতিক সচেতনদের কাছে এর গুরুত্বটা আরেকটু বেশি। তারওপর গণ্ডগোল পেকেছে সনদ, গণভোট, ঐকমত্যের কিছু প্রস্তাবনা নিয়ে।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রতিবেদনের একটি সহজবোধ্য বই প্রস্তুত করে দেশের মানুষের জন্য উন্মুক্ত করার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টার কাছে আট খণ্ডের প্রতিবেদন হস্তান্তর করেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্যরা। এ প্রতিবেদনে ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশ, সভা ও কার্যবিবরণীর বিস্তারিত রয়েছে। এ সময় প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘এই প্রতিবেদন সাধারণের সহজবোধ্য সংস্করণে প্রস্তুত করতে হবে। বই আকারে প্রকাশ করতে হবে, যাতে সাধারণ মানুষ, স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা পড়ে বুঝতে পারে এবং অন্যদেরও বোঝাতে পারে।’ বইটি ইংরেজি ও বাংলা দুই ভাষাতেই প্রকাশের আহ্বান জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘ভবিষ্যতে বইটি যেন শিক্ষার্থীদের জন্য অবশ্যপাঠ্য হয়, সেটিও বিবেচনায় রাখতে হবে। তরুণ প্রজন্ম বইটি পড়বে, নিজেরা জানবে এবং এতে কী আছে, তা তাদের মা-বাবাকেও জানাবে।’
প্রধান উপদেষ্টার এমন আহ্বানের মাঝেই নির্বাচন কমিশন থেকে বলা হয়েছে, নভেম্বরে বা ফেব্রুয়ারিতে সংসদ ইনর্বাচনের দিনই একসঙ্গে গণভোটের বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেবে সরকার। তা জানানো হয় আসন্ন সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়ে সম্পৃক্ত মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিব এবং অধিদপ্তর ও কর্তৃপক্ষের মহাপরিচালক, চেয়ারম্যানদের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকের পর। নানা আলোচনা ও নাটকীয় ঘটনার পর দিনটিতেই অবশেষে নির্বাচন কমিশনের সংরক্ষিত নির্বাচনী প্রতীকের তালিকায় যুক্ত হয়েছে ‘শাপলা কলি’। ইসির তালিকায় একশ ১৯টি প্রতীকের মধ্যে ১০২ নম্বরে যুক্ত করা হয় মার্কাটি। এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারিও হয় দ্রুত সময়ের মধ্যে। নির্বাচন কমিশনের দেয়া এমন প্রজ্ঞাপনের, তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে জাতীয় নাগরিক পার্টি - এনসিপি। শাপলা প্রতীকের ব্যাপারে আপোসহীন দলটির মুখ্য সংগঠক নাসির উদ্দিন পাটোয়ারী বলেন, বিএনপিকে বাড়তি সুবিধা দিতে নির্বাচন কমিশনের এমন অপচেষ্টা। এ থেকে সরে না এলে নির্বাচন কমিশন ঘেরাওয়ের হুঁশিয়ারিও দেন তিনি। কমিশন এবং এনসিপির রশি টানাটানির মধ্যে ফের কেবল শাপলা নয়, নির্বাচন, সনদ, ঐকমত্য কমিশন সব কিছুতেই ভর করেছে অনিশ্চয়তার বোঝা। কথা এবং দোষারোপে কেউ কাউকে একটুও ছাড়ছে না। বিএনপি-জামায়াত মিলে দেশকে সংকটের মধ্যে ফেলছে বলেও অভিযোগ ছোঁড়া হয়েছে এনসিপি থেকে। গণভোট আগে না পরে? এটিকে বিএনপি-জামায়াতের কুতর্ক মন্তব্য করে এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক নাসিরুদ্দীন পাটোয়ারি বলেছেন, তারা এ কুতর্কে যাবেন না।
কিছু শঙ্কা-সন্দেহ-কানাঘুষা থাকলেও নির্বাচনের মাস তিনেক আগে এমন একটা অবস্থা কাম্য ছিল না। টানা না হলেও মাঝেমধ্যে বিরতি দিয়ে ২৭০ দিন আলোচনার পরও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এক চরম অনৈক্য। সনদ কিভাবে বাস্তবায়ন হবে, তা প্রধান উপদেষ্টা দ্রুতই ঠিক করবেন বলে জানিয়েছেন আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল। যে যাই বলুক ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবেই বলে আবারো নিশ্চিত করেন তিনি। রাজনৈতিক দলগুলোর চরম অনৈক্য সরকারের কাজকে কঠিন করে তুলছে তাও জানান। সেইসঙ্গে যোগ করেন: নির্বাচনের পরিবেশ ঠিক রাখার দায়িত্ব শুধু সরকারের নয়, রাজনৈতিক দলগুলোরও। জুলাই সনদ ও সনদের বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সৃষ্ট চরম বিরোধ নিয়ে আলোচনা হয় প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনুসের সভাপতিত্বে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে। জুলাই সনদ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো ঐক্যমতে না পৌছালে ২৭০ দিন পর তা স্বয়ংক্রিয় ভাবে কার্যকর হবে, না সনদের পুরো বিষয়টি নির্বাচিত সংসদের ওপর নির্ভর করবে, গণভোট হলে কখন হবে- রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিবাদ - এসব বিষয় নিয়ে উপদেষ্টা পরিষদে আলোচনা হলেও, কোন সিদ্ধান্ত হয়নি।
আন্দোলন, ফ্যাসিস্ট পতন, বিজয়োল্লাস করা রাজনৈতিক দলগুলোর পারস্পরিক চরম এ বিরোধে জুলাই চেতনার ছাপ নেই। বরং তা জুলাই চেতনার চরম খেলাপ। বিএনপির দিক থেকে অনেক দিন ধরে অনেক কিছু সয়ে চলা, মানিয়ে নেয়ার প্রবণতায়ও দিন কয়েক ধরে ব্যতিক্রম। নির্বাচনের দিন গনভোটের বাইরে অন্য কোনো সিদ্ধান্ত বিএনপি মানবে না বলে সাফ জানিয়ে দেয়া হয়েছে। দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের ভাষায়: জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাব একপেশে ও জবরদস্তিমূলকভাবে জাতির ওপর চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা হয়েছে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন আহমেদ জানান, সংবিধান সংস্কার সংশোধন পরিষদ গঠনের কোনো আলোচনা না হলেও এ বিষয়ে অযৌক্তিক সুপারিশ করেছে ঐকমত্য কমিশন। সংবাদ সম্মেলন করে তারা দলের অবস্থান জানিয়েছেন। বলেছেন, ঐক্যমত্য কমিশনের আলোচনায় বিভিন্ন বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর দেয়া মতামত, ভিন্নমত ও নোট আব ডিসেন্ট গণভোটে উপস্খাপনের সুযোগ রাখা হয়নি। এর আগে বুধবার রাতে বিএনপির স্থায়ী কমিটি জরুরি বৈঠক করেছে। ওই বৈঠকের কথাগুলোই জানানো হয়েছে সঙবাদ সম্মেলনে। তা হলে সনদে সই করলেন কেন? সেই জবাবও দিয়েছেন। জানান, ১৭ অক্টোবর কেবলমাত্র আলোচনার মাধ্যমে প্রণীত জুলাই জাতীয় সনদের অঙ্গীকারনামায় বিএনপি স্বাক্ষর করেছে। সেদিন সনদের চূড়ান্ত অনুলিপি উপস্থাপন করা হয়নি। এমনকি পরবর্তীতে যেটি পুস্তক আকারে তাদের দেয়া হয়েছে তাতে ঐকমত্যের ভিত্তিতে কয়েকটি দফা তাদের আগোচরে আবার সংশোধন করা হয়েছে। বিএনপির সমমনাদের প্রতিক্রয়াও এমনই। নাগরিক ঐক্য থেকে বলা হয়েছে, কোন দলের সাথে আলোচনা না করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন জুলাই সনদ পরিবর্তন করেছে। উপদেষ্টাদের কারণে দেশ বিপদে পড়তে যাচ্ছে অভিযোগ করে বলা হয়, ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন না হলে দেশ অরাজকতার দিকে যাবে। বিএনপির রাজপথের সাথী, দীর্ঘদিনের সঙ্গী জামায়াতের মতিগতি একদম বিপরীত। দিনটিতে তারাও সংবাদ সম্মেলন করে বিএনপিকে দূষেছে। বিএনপির নির্বাচনের দিন গণভোট আয়োজনের প্রস্তাবের সমালোচনা করে ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের বলেন, গণভোটকে গলাটিপে হত্যা করতেই নির্বাচনের দিন গণভোট চায় বিএনপি। জনগণের নয়, নিজেদের লাভ হিসাব করে বিএনপি সংস্কার চায় বলেও মন্তব্য করেন তিনি। জামায়াত চায় প্রত্যেক দল তাদের নাম ও নিজস্ব প্রতীকে নির্বাচন করুক। প্রতীক নিয়ে নির্বাচন কমিশনকে বিতর্কিত না করার আহবানও জানান আব্দুল্লাহ মো. তাহের।
ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু না হলে তা বাতিল করা হবে, প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছ থেকে এমন ঘোষণা চাইছে জামায়াতে ইসলামী। ভিন্ন আবহের জুলাই সনদ বাস্তবায়ন ও নভেম্বরে গণভোটসহ পাঁচ দফা দাবিতে নির্বাচন কমিশনের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছে জামায়াতে ইসলামিসহ সমমনা আটটি রাজনৈতিক দল। পরে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বরাবর স্মারকলিপি দেন দলগুলোর প্রতিনিধিরা। জুলাই সনদ বাস্তবায়নে জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোটের বিকল্প নেই বলেও মনে করেন তারা। অবস্থান কর্মসূচি থেকে বক্তারা অভিযোগ করেন, জাতির আকাঙ্ক্ষাকে উপেক্ষা করে সরকার একটি বিশেষ দলকে সুবিধা দিতে নির্বাচনের দিন গণভোট আয়োজনের পরিকল্পনা করছে। নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত না হলে গ্রহণযোগ্য ভোট আয়োজন সম্ভব নয় বলে মত তাদের। জোট করলেও ভোট করতে হবে নিজস্ব প্রতীকে, এমন সংশোধিত আরপিও অনুসারেই নির্বাচন চান তারা। এনসিপির হাল ভূমিকা জামায়াতের বেশ অনুকূলে। জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের জমা দেওয়া সুপারিশকে ইতিবাচকভাবে দেখছে তারা। গণভোটের ক্ষেত্রে নোট অব ডিসেন্টের কার্যকারিতা না রাখা, পুরো সনদকে “হ্যাঁ”, “না” ফরম্যাটে গণভোটে দেওয়া এবং গণ-অভ্যুত্থানের ভিত্তিতে আদেশ জারি করায় তারা সন্তুষ্টু। এক দল সরকারি হতে চাচ্ছে, আরেক দল বিরোধী। এক দল ভারতে এক পা দিয়েছে, আরেক দল পাকিস্তানে। এগুলো সামনে আরও স্পষ্ট হবে-এমন প্রকাশ্য কথাও এসেছে এনসিপি থেকে।
ড. ইউনূসের সরকার একটি অথর্ব নির্বাচন কমিশন গঠন করেছে এ অভিযোগ আরো আগেই করে রাখা হয়েছে। বিভিন্ন দল থেকে এখন ভিন্ন ভিন্ন কিছু কথা এলেও গোল বেধেছে সংবিধান সংস্কারের বিষয়গুলো নিয়ে। জুলাই সনদে সংবিধান সংস্কারের প্রস্তাব আছে ৪৮টি। এর মধ্যে না হলেও ৩৬টি প্রস্তাব নিয়ে কোনো না কোনো রাজনৈতিক দলের ভিন্নমত আছে। জুলাই সনদে সেই ভিন্নমতগুলো যুক্ত করে এটা নিশ্চিত করা হয়েছিল যে কোনো রাজনৈতিক দল তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে ভিন্নমতগুলো উল্লেখ করে যদি জনগণের ভোটে বিজয়ী হয়, তবে তারা তাদের মতো করে সংবিধান সংশোধন করতে পারবে। স্বয়ং প্রধান উপদেষ্টা ঐকমত্য কমিশনের সভাপতি। আর দৃশ্যত খাটাখাটুনি করেছেন কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ। তাকে নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা বিস্তর। রয়েছে কারো কারো বিদ্বেষ-অসহিষ্ণুতাও। এসব গায়ে না মেখে কাজ করে গেছেন তিনি। এখন পড়ে গেছেন বড় রকমের ফ্যাসাদে। এই ফ্যাসাদে প্যাঁচিয়ে গেছে নির্বাচন এবং গণভোটও। সেখানে প্রতিনিয়তই ধোঁয়াশা-কুয়াশার ঘনঘটা। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠাও। যা জুলাই চেতনা ও আকাঙ্খাকে কেবল আহতের পর আহতই করছে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
