ফেনী-নদী, সাগর, সবুজ মাঠ এবং মানুষের হাসির শহর। কিন্তু এক ফোঁটা বৃষ্টির জল নামলেই এই শহর থমকে দাঁড়ায়। শহীদ শহীদুল্লাহ কায়সার সড়ক, মিজান রোড়, পাঠান বাড়ী সড়ক, নাজির রোড়সহ শহরের অলিতে-গলিতে পানি ভেসে ওঠে। রিকশা বন্ধ, গাড়ি অচল, পথচারীরা হাঁটু-সমান পানিতে চলাচল করতে বাধ্য। ট্রাংক রোড জিরো পয়েন্ট থেকে মহিপাল চৌরাস্তা, সদর হাসপাতাল মোড় থেকে ট্রাংক রোড-সবই জ্যামে আটকে থাকে।
ফুটপাত দখল, অবৈধ পার্কিং, বিশৃঙ্খলা, যত্রতত্র ময়লা, দুর্গন্ধ, মশা-মাছি-সবই মানুষের দৈনন্দিন জীবনকে নিঃস্ব করে। শিশুদের খেলার মাঠ নেই, হাঁটার পথ নেই, নিরাপদ পার্ক নেই। অথচ বহুতল মার্কেট আর রেস্তোরাঁয় আলো ঝলমল করছে। সম্ভাবনায় ভরপুর হলেও শহরটি ভোগান্তির বেড়াজালে বন্দি। আধুনিকতার মরীচিকা এ-ই ফেনী। গতকাল দৈনিক ফেনীতে প্রকাশিত জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলামের বক্তব্য আমাকে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছে। তিনি বলেছেন-"ফেনীর যেকোনো সমস্যা ফেনীর মানুষকেই দেখতে হবে। কোনো কাজ বাস্তবায়নের জন্য আলোচনা জরুরি। শহরের আধুনিকায়নের ছোঁয়া লাগলেও নেই হাঁটার জায়গা, নেই শিশুদের খেলার মাঠ কিংবা পার্ক। অথচ গড়ে উঠেছে বড় বড় মার্কেট ও রেস্টুরেন্ট। ফেনীর মানুষের ভালো চিন্তা ফেনীর মানুষকেই করতে হবে।" এই বক্তব্য শুধু প্রশাসনিক দায়িত্ব নয়; এটি মানবিক চেতনার বহিঃপ্রকাশ। ফেনীর ইতিহাসও গর্বময়-১৮৭৫ সালে মহকুমা, ১৯৮৪ সালে পূর্ণাঙ্গ জেলা। ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, জুলাই বিপ্লব, সাহিত্যচর্চা-সবই ফেনীর স্বতন্ত্র পরিচয়। অথচ নগরায়ণ ও আধুনিক পরিকল্পনার অভাবে শহরের অবকাঠামো বারবার পিছিয়ে পড়েছে। ছোট রাস্তা, খাল, খোলা জায়গা-সবই হকার, অবৈধ রিকশা, জ্যামে আটকে থাকা গাড়ি, রাজনৈতিক মিছিল এবং কিশোর গ্যাং-এর হুলস্থলের শিকার। শহরের সমস্যাগুলো শুধু অবকাঠামোগত নয়; সামাজিক ও মানবিক সংকটও তৈরি করছে। বড় মার্কেটের সামনে গাড়ি রাখার পার্কিং নেই। রাস্তার পাশে এলোমেলোভাবে শত শত ব্যক্তিগত গাড়ি পার্কিং করছে। ছোট রাস্তা আরও সংকীর্ণ হচ্ছে, চলমান গাড়ি ও যাত্রী জ্যামে আটকে থাকে। ফুটপাত নয়, রাস্তায় যেখানে পারছে সেখানে পণ্য বিক্রি করছে-এ শহরে আগত অন্যান্য জেলার মানুষ। দিন দিন শহর বহুমুখী হচ্ছে, নতুন বসতি ও কর্মসংস্থান বেড়েছে। অফিসগামী মানুষ ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে আটকে থাকে। শিশু মোবাইল ও কম্পিউটারে সময় ব্যয় করছে, বৃদ্ধরা বাইরে বের হতে পারছে না। কৃষক ন্যায্য দাম পাচ্ছে না, বাজারে দাম বেড়ে যায় তিন-চারগুণ। ফুটপাত দখলকারীরা জনসাধ্য চলাচল সীমিত করছে। ট্রাংক রোড জিরো পয়েন্ট শহরের প্রাণকেন্দ্র হলেও এখন দুর্ভোগের প্রতীক। কিশোর গ্যাং দৌরাত্ম্য চালাচ্ছে, ছোটখাটো সংঘর্ষ ও অরাজকতা সৃষ্টি করছে। রাজনৈতিক মিটিং, মিছিল ও সমাবেশ শহীদ মিনারের পাদদেশে হওয়ায় অসুস্থ রোগী, বিদেশগামী যাত্রী, নারী-পুরুষ-সবাই দুর্ভোগ পোহাচ্ছে। সহজ সমাধান আছে-ফেনী হাইস্কুল বা অন্যান্য খোলা মাঠে এসব সভা-সমাবেশ আয়োজন করা। কেনো মানুষের দৈনন্দিন দুর্ভোগ রাজনৈতিক স্বার্থে উপেক্ষা করা হয়, প্রশ্ন থেকে যায়। জাতীয় দৈনিকগুলোও এই সংকট তুলে ধরেছে। প্রথম আলো জানিয়েছে, সামান্য বৃষ্টিতেই শহরের প্রধান সড়কগুলো ডুবে যায়, কারণ খাল দখল হয়ে গেছে। ইত্তেফাক জানাচ্ছে, ফেনী জেনারেল হাসপাতালে ডাক্তার সংকট ভয়াবহ। কালের কণ্ঠ-এর রিপোর্টে শহরে প্রায় ১৫ হাজার অবৈধ রিকশা চলছে। ডেইলি স্টার-এর তথ্য অনুযায়ী, জেলার ৪৫% যুবক মাদকের ঝুঁকিতে। সমকাল জানাচ্ছে, কলেজে শিক্ষার্থী ভর্তির হার কমছে মানসম্মত শিক্ষার অভাবে। সব তথ্য মিলিয়ে দেখা যায়, ফেনী এখন একটি জটিল সংকটে আবদ্ধ।
বর্তমানে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিও জটিল। অন্তবর্তী সরকার দেশের পরিচালনা করছে। জেলার কোনো নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি নেই। এই শূন্যতায় জেলা প্রশাসক ও তার অংশীজনদের দায়িত্ব আরও গভীর ও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। জনগণের প্রতিটি সমস্যা এখন প্রশাসনের সরাসরি উদ্যোগে সমাধান খুঁজতে হবে। জনদুর্ভোগ ও অবকাঠামোর অভাব প্রশাসক ও স্থানীয় কর্মকর্তাদের কেবল প্রশাসনিক দায়িত্ব নয়; এটি নৈতিক দায়িত্বও। শহরের ক্ষুদ্র সমস্যা থেকে বৃহৎ সংকট-সবকিছুর সমাধান প্রয়োজন প্রাসঙ্গিক দৃষ্টিভঙ্গি ও বাস্তব পরিকল্পনার মাধ্যমে। প্রশাসক সাইফুল ইসলামের আহ্বান প্রমাণ করে, তিনি সমস্যার সমাধানে একক উদ্যোগ নয়, বরং সামষ্টিক অংশগ্রহণে বিশ্বাস রাখেন। ফেনীকে মানবিক ও আধুনিক করতে হলে ফুটপাত দখলকারী, শ্রমজীবী, হকার-যাদের কারণে সমস্যা তৈরি হয়-তাদের নিয়েই সমাধান খুঁজতে হবে। ফুটপাত দখলকারীদের পুনর্বাসন, রিকশাচালকদের বৈধকরণ ও সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, তরুণদের খেলাধুলা ও সংস্কৃতিতে যুক্ত করা। শুধু আইন প্রয়োগ নয়; দরকার অংশগ্রহণ, আলোচনার টেবিল, সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ। বিশ্বমানের উদাহরণ স্পষ্ট করে দেখায়-সিঙ্গাপুর স্ট্রিট ভেন্ডরদের আধুনিক হকার মার্কেটে অন্তর্ভুক্ত করেছে। কোপেনহেগেন সাইকেল-কেন্দ্রিক পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে, যানজট ও দূষণ কমিয়েছে। কেরালায় অংশগ্রহণমূলক বাজেট মানুষের উন্নয়নের মালিক বানিয়েছে। টোকিও নিয়মিত দুর্যোগ মহড়া চালিয়ে নাগরিকদের প্রস্তুত রাখছে। এসব উদাহরণ ফেনীর জন্য পথ দেখাচ্ছে-উন্নয়ন স্থায়ী হয়, যখন মানুষ তা নিজেদের বলে মনে করে। বাস্তব কৌশলও স্পষ্ট: সব হকারকে নির্দিষ্ট এলাকায় পুনর্বাসন; অবৈধ রিকশাকে বৈধকরণ ও সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ; প্রতিটি স্কুলে খেলার মাঠ সংরক্ষণ; নদী-খাল উদ্ধারে জনগণের অংশগ্রহণে টাস্কফোর্স; স্বাস্থ্যসেবায় ডিজিটাল টোকেন; শিক্ষার মানোন্নয়নে শিক্ষক-প্রশাসন কমিটি; ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে ডিজিটাল সিগন্যাল, সাইকেল লেন ও গণপরিবহন; মাদকবিরোধী সচেতনতা স্কুল-কলেজে ক্লাবের মাধ্যমে; গাড়ি পার্কিং ও রাস্তার জ্যাম নিয়ন্ত্রণের জন্য শহরের প্রতিটি মার্কেট ও ব্যস্ত এলাকায় পরিকল্পিত পার্কিং লট তৈরি; রাজনৈতিক সভা ও মিছিল নিরাপদ, জনবান্ধব স্থানে স্থানান্তর।
ফেনী শহরের রূপান্তরের চিত্র কল্পনা করুন-খাল পরিষ্কার, শিশুদের পার্ক, শিক্ষার্থীদের মাঠ, ভিক্ষুক ও ছিন্নমূল মানুষের পুনর্বাসন, ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রিত বাজার, উন্নত হাসপাতাল, শিক্ষার মানোন্নয়ন, সুশৃঙ্খল যানবাহন। শিশুদের হাসি, বৃদ্ধদের শান্তি, শ্রমজীবীর নিরাপত্তা, শিক্ষার্থীর স্বপ্ন-এই প্রত্যাশা বাস্তবায়ন হবে যদি সাধারণ মানুষ ও প্রশাসন একসাথে কাজ করে। একজন নাগরিক হিসেবে আমার বিনীত অনুরোধ-মান্যবর জেলা প্রশাসক, দরিদ্র মানুষের পাশে বসুন, শ্রমজীবীদের সঙ্গে আলাপ করুন, সুশীল সমাজ, শিক্ষার্থী-শিক্ষকদের সঙ্গে সংলাপ করুন, ব্যবসায়ী ও হকারদের সঙ্গে বসুন। ফেনী একদিন হাসবে-শিশুর হাসিতে, বৃদ্ধের শান্তিতে, শ্রমজীবীর নিরাপত্তায়, শিক্ষার্থীর স্বপ্নে। ফেনী হবে আধুনিক মানবিকতার আলোকবর্তিকা, যেখানে শুধু বাঁচা নয়, থাকবে মর্যাদা ও সম্ভাবনার বাতাবরণ।
-শিক্ষক, লেখক ও সামাজিক সংগঠক