জাতিসংঘের অধীনে বিশ্বব্যাপী পরিবেশ রক্ষার লক্ষ্যে গঠিত একটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা হল জাতিসংঘ জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন (UNFCCC)। এটি মূলত ১৯৯২ সালে স্বাক্ষরিত হয়েছিল, যেখানে প্রায় ২০০টি দেশ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিরোধে একমত হয়। প্রতি বছর "কনফারেন্স অব দ্য পার্টিজ" বা কপ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে এই চুক্তির অন্তর্ভুক্ত দেশগুলো মিলিত হয়ে পরিবেশ রক্ষায় কার্যকর পদক্ষেপ নিয়ে আলোচনা করে। ২০২৪ সালে কপ-২৯ সম্মেলন আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
কপ সম্মেলন হল একটি বার্ষিক আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্ম, যেখানে বিভিন্ন দেশ এবং সংগঠনগুলোর প্রতিনিধিরা বৈশ্বিক জলবায়ু সংকট মোকাবেলায় বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়ে আলোচনা করেন। যেখানে জাতিসংঘ সদস্য রাষ্ট্রগুলি এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিরা ছাড়াও কূটনীতিক, জলবায়ু বিজ্ঞানী, শ্রমিক নেতৃবৃন্দ এবং পরিবেশকর্মীরা উপস্থিত থাকেন। সম্মেলনের মূল উদ্দেশ্য হল কার্বন নির্গমন হ্রাসের মাধ্যমে বৈশ্বিক উষ্ণতা নিয়ন্ত্রণে আনা, যাতে পৃথিবী ও এর বাস্তুসংস্থান রক্ষা পায়। বিশেষত, ২০১৫ সালে প্যারিস চুক্তির আওতায় গৃহীত সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়নে কপ সম্মেলনগুলোকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হচ্ছে। প্যারিস চুক্তির মাধ্যমে নেতৃবৃন্দ ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা সীমা বজায় রাখার অঙ্গীকার করেন, যা অর্জনে কার্বন নির্গমন হ্রাস একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় তার অন্যতম প্রধান জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা (NAP) বাস্তবায়নে অর্থায়ন বৃদ্ধির উপর জোর দিয়ে কপ-২৯ সম্মেলনে আলোচনায় মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করছে। জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য বিশ্বে অতি-সংবেদনশীল দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম এবং ২০২১ সালের ওয়ার্ল্ড ক্লাইমেট রিস্ক ইনডেক্সে সপ্তম স্থানে রয়েছে। বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল এবং উপকূলীয় এলাকাগুলি ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, খরা এবং তীব্র তাপপ্রবাহের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রায়ই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ২০৫০ সালের মধ্যে প্রতি সাত জন বাংলাদেশির মধ্যে একজন, অর্থাৎ প্রায় ১ কোটি ৩৩ লক্ষ মানুষ বাস্তুচ্যুত হতে পারে বলে সরকারের পূর্বাভাস রয়েছে।
বাংলাদেশ উন্নত দেশগুলোর ১০০ বিলিয়ন ডলারের বার্ষিক জলবায়ু তহবিল প্রতিশ্রুতি পূরণের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়েছে এবং জলবায়ু তহবিল পাওয়ার জটিলতাও তুলে ধরছে।এছাড়াও ২০৩০ সালের মধ্যে অভিযোজন ও প্রশমনে প্রায় ৯০ বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন, যার একটি বড় অংশ আন্তর্জাতিক উৎস থেকে আসা জরুরি। কপ-২৮-এর একটি প্রধান অর্জন ছিল ৭০০ মিলিয়ন ডলারের ক্ষতি ও ক্ষয়ক্ষতি তহবিল প্রতিষ্ঠা, যা জলবায়ু দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো, যেমন বাংলাদেশ, স্বাগত জানিয়েছে। ক্ষতিপূরণ তহবিলের মাধ্যমে বাংলাদেশ উপকূলীয় অঞ্চলের জনগণকে সুরক্ষা প্রদান, আবাদযোগ্য জমি রক্ষা এবং স্থানচ্যুত মানুষকে পুনর্বাসন করতে পারবে। কপ সম্মেলনগুলোতে বাংলাদেশ এই তহবিলের জন্য চাপ দিয়ে আসছে। জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর অন্যতম হিসেবে বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে আন্তর্জাতিক ন্যায়সঙ্গত অর্থায়নের পক্ষে কাজ করছে এবং নতুন অর্থায়ন সহজলভ্য করতে সহায়ক ভিত্তি তৈরি করেছে। বর্তমান বৈশ্বিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে, জলবায়ু অভিযোজন ও স্থিতিস্থাপকতা অর্জনের জন্য কপ-২৯ বাংলাদেশকে অভিযোজন, প্রশমন ও ক্ষয়ক্ষতি অর্থায়নের সহায়তা নিশ্চিত করতে একটি গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ দিচ্ছে।
কিন্তু কপ-২৯ সম্মেলনে অঙ্গীকার বাস্তবায়ন কতটা হবে, সেই সন্দেহ থাকছে। কারণ বৈশ্বিক নেতাদের উল্লেখযোগ্য অনুপস্থিতি, যেমন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং, ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির অনুপস্থিতি, জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় সম্মেলনের লক্ষ্য পূরণে বড় বাধা সৃষ্টি করছে। এই নেতাদের অনুপস্থিতি জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ ও অর্থায়ন নিশ্চিত করতে ধনী দেশগুলোর প্রতিশ্রুতির ওপর সন্দেহ তৈরি করছে। কপ-২৯-এর মতো সম্মেলনগুলোতে উন্নত দেশগুলোর অংশগ্রহণ ও সক্রিয় ভূমিকা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এই দেশগুলো বড় ধরনের কার্বন নিঃসরণকারী এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় তাদের আর্থিক সহায়তা অপরিহার্য।
পরিবেশবাদীরা ও জলবায়ু কর্মীরা জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় উন্নত দেশগুলোর কাছে বিলিয়ন নয়, ট্রিলিয়ন ডলার অর্থায়নের দাবি জানাচ্ছেন। বর্তমান বৈশ্বিক জলবায়ু সংকটের সমাধানে এই বিশাল অঙ্কের অর্থায়ন অত্যন্ত জরুরি। এই তহবিল উন্নয়নশীল এবং জলবায়ু পরিবর্তনে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর জন্য অভিযোজন, ক্ষতি ও ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলা সহায়ক হবে। তবে প্রয়োজনীয় এই ট্রিলিয়ন ডলার অর্থায়ন বাস্তবায়ন কতটা সম্ভব হবে এবং উন্নত দেশগুলো আদৌ এই অঙ্গীকার কতটা পূরণ করবে, তা এখনও অমীমাংসিত থেকে যাচ্ছে।
জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস কপ-২৯ সম্মেলনকে এক বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন, যা জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বিশ্বজুড়ে সমন্বিত প্রচেষ্টার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে। তিনি সতর্ক করেছেন যে, বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সীমাবদ্ধ রাখতে হলে, উন্নত দেশগুলোকে তাদের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ১০০ বিলিয়ন ডলার তহবিল বরাদ্দ এবং জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমাতে আরও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। তিনি উল্লেখ করেছেন যে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে উন্নয়নশীল দেশগুলো বিশেষত সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, এবং তাদের জন্য আর্থিক সহায়তা ও প্রযুক্তির প্রবাহ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
গুতেরেস বলেন, কপ-২৯ এমন একটি মঞ্চ, যেখানে বিশ্বের নেতারা জলবায়ু সংকটের মোকাবিলায় কার্যকরী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন, তবে সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন কতটা কার্যকর হবে, তা নিয়ে অনেক সংশয় রয়েছে। বিশ্বজুড়ে তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্য দায়ী দেশগুলোর কাছে জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য ক্ষতিপূরণ ও অর্থায়ন প্রাপ্তির বিষয়টি নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছেন।
কপ-২৯ সম্মেলনে গৃহীত সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়ন হবে কিনা এবং জলবায়ু তহবিল প্রতিশ্রুতি কতটা পূরণ হবে, তা আসলেই সময়ের উপর নির্ভরশীল। তবে বর্তমান প্রেক্ষাপটে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ ব্যতীত বিকল্প কিছু নেই, কারণ জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব প্রতিদিন তীব্রতর হচ্ছে এবং মানবজাতির ভবিষ্যত এতে সরাসরি প্রভাবিত। সম্মিলিত প্রচেষ্টা এবং আন্তরিক উদ্যোগের মাধ্যমে কপ-২৯ সত্যিই বিশ্বকে একটি টেকসই ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে নিতে সহায়ক হতে পারে।
লেখক
শিক্ষার্থী, পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ, স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ
পরিবেশ ও দূষণ নিয়ন্ত্রণ সমন্বয়কারী, ইয়ুথনেট ফর ক্লাইমেট জাস্টিস