অশ্রুশিক্ত কিছু কথা
বন্যার প্রথম দিন থেকেই আমি ছিলাম ফেনীর পথে প্রান্তরে। দেখেছি মানুষের আর্তনাদ, কষ্ট ও হাহাকার। এই বন্যার ভয়াবহতা কেবলমাত্র চোখে দেখার অভিজ্ঞতার মাধ্যমে বোঝা সম্ভব। মা-বাবার জন্য ছিল সন্তানের আহাজারি, আর পরিবারের জন্য স্বামী ও পিতাদের কান্না। এ দৃশ্য সহ্য করা কঠিন কাজগুলোর মধ্যে একটি ছিল।
বন্যায় আটকে থাকা মানুষ গুলো উদ্ধারকর্মীদের দেখলেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে, ভেবেছে এই যাত্রায় হয়তো বেঁচে ফিরবে। দিনের পর দিন মানুষ খেয়ে ছিল শুকনো খাবার। সন্তানের মুখে খাবার তুলে না দিতে পারার নিরব কষ্টে কেঁদেছে হাজারো পিতা। পানি খাওয়ার সময় অনেকের মনে চিন্তা ছিলো “কিছুক্ষণ পর আবার পিপাসা পেলে কি খাবেন?”
বন্যার সময়টায় মানুষের মুখে একটি কথা সব থেকে বেশি শোনা গেছে সেটি হচ্ছে “এমন বন্যা আমরা কখনো দেখি নাই”। মানুষ মূলত এমন বন্যা না দেখার কারনেই আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ায় আনিহা ছিল এবং প্রাথমিক প্রস্তুতি নিতেও তেমন আগ্রহ ছিল না।
বন্যার পানি ঢুকতে শুরু করলে এক কাপড়ে অনেকে চলে গেছেন আশ্রয়কেন্দ্রে। সেখান থেকে ফিরে কেউ দেখেছেন তাদের ঘর ভাসিয়ে নিয়ে গেছে বানের পানি, আবার কেউ দেখেছেন সারাজীবন কষ্টে করা সব স্বপ্ন ধ্বংস হয়ে গেছে। নতুন করে কিভাবে শুরু করবেন সে চিন্তায় অনেকেই মানসিক ভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছেন।
বন্যার কারণে অনেকের গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র, যেমন সার্টিফিকেট, জন্মনিবন্ধন এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র নষ্ট হয়ে গেছে। ভেসে গেছে বেশিরভাগ শিক্ষার্থীদের বই, খাতা এবং অন্যান্য শিক্ষা উপকরণ। অনেক পরিবারের সন্তানদের জন্য নতুন বই খাতা কিনা কষ্ট সাধ্য হয়ে উঠেছে।
জেলা প্রশাসনের নানা রকম সমন্বয়হীনতা ও ধীরগতি কাজের কারণে পরিস্থিতি সামাল দেয়া কষ্টকর হয়েছিল। কিন্তু সামরিক বাহিনী, শিক্ষার্থী, ফেনীর স্বেচ্ছাসেবক ও সারা বাংলাদেশ থেকে ছুটে আসা মানুষের আন্তরিকতা এবং কষ্টের জন্যই বন্যা পরিস্থিতি সামাল দেয়া সম্ভব হয়েছে। এছাড়াও বন্যার সময় সহায়তার নামে অনেকেই পিকনিক বা ভ্রমণে এসেছেন, যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে। তারা যখন আনন্দে মগ্ন, তখন স্থানীয়দের কষ্ট ও দুর্ভোগ বেড়েই চলেছিল। এই ধরনের আচরনে স্থানীয়দের মনে হতাশা সৃষ্টি করেছে, কারণ সে সময়ে তাদের প্রয়োজন ছিল সহায়তা।
উদ্ধার কার্যক্রমে পর্যাপ্ত সরঞ্জাম না থাকায় সকলকেই বেগ পেতে হয়েছে। যদি সঠিক সময়ে পর্যাপ্ত সরঞ্জাম, নৌকা ও স্পীডবোট ব্যবস্থা করা যেতো, তবে মানুষের কষ্ট এবং দুর্ভোগ দ্রুত লাঘব করা সম্ভব হতো। বন্যাকে পুঁজি করে অনেক ব্যবসায়ী তাদের ব্যবসার পরিসর বাড়িয়েছেন। সংকটময় মুহূর্তে জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে মানসিকভাবেও কষ্ট দিয়েছে অনেক ব্যবসায়ী।
বন্যায় অনেক দৃশ্যমান ক্ষয়ক্ষতি চোখে পড়লেও, অনেক ক্ষয়ক্ষতি সচরাচর নজরে আসে না। নিরব কষ্টে থাকা অনেক পরিবার এখন মানবেতর জীবনযাপন করছে। তাদের দুঃখ ও কষ্টের চিত্র যেন অদৃশ্য। এই পরিবারের সদস্যদের দৈনন্দিন চাহিদা মেটানো ও জীবিকা নির্বাহ করা কঠিন হয়ে পড়েছে, যা একটি গুরুতর সংকট।
চোখে দেখা, ২৪ সালের এই ভয়াবহ বন্যা যেন কখনো আর না আসে। এর ক্ষতগুলো মনে পড়লে এখনও বুকের মধ্যে অসহনীয় চাপ অনুভব হয়। মানুষের অসহায়তা, ছোট ছোট শিশুদের কান্না, এবং পরিবারের বিভক্তি, এই দৃশ্যগুলো যেন আমার মন থেকে কখনো মুছবে না। এই বন্যা আমাদের শিখিয়েছে মানবতা, কর্তব্য ও মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসা। এই দুর্যোগ আমাদের সজাগ করেছে, আমাদের মধ্যে একতা এবং সহযোগিতার অনুভূতি সৃষ্টি করেছে। “সকলের তরে সকলে আমরা, প্রত্যেকে আমরা পরের তরে” এই প্রতিজ্ঞাকে ধারন করে সকলে একত্রিত হয়ে নিজেদের শক্তি গড়ে তুলি, যাতে ভবিষ্যতে আমরা সকল বিপর্যয়ের মোকাবেলা করতে পারি এবং একসাথে এগিয়ে যেতে পারি। এতে করেই “দুর্যোগে হাসবে দেশ, একসাথে আমরা বাংলাদেশ।”
লেখক: পরিবেশ ও জলবায়ু কর্মী
শিক্ষার্থী, পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ, স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ
পরিবেশ ও দূষণ নিয়ন্ত্রণ সমন্বয়কারী, ইয়ুথনেট ফর ক্লাইমেট জাস্টিস