আগস্টে বাংলাদেশের ফেনী, নোয়াখালীসহ দেশের এগারোটি জেলার ৭৩টি উপজেলায় এক ভয়াবহ এবং বিধ্বংসী বন্যা আঘাত হানে। এই বন্যা হাজার হাজার মানুষকে বাস্তুচ্যুত করেছে, তাদের জীবিকা ধ্বংস করেছে এবং বহু মানুষের জীবন কেড়ে নিয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলিতে রাস্তাঘাট, বাড়িঘর, ফসলের মাঠ এবং জীবিকা নির্বাহের সমস্ত উপায় বন্ধ হয়ে গেছে। শুধু তাই নয়, এই বিপর্যয় মানুষের আশা, স্বপ্ন এবং সুখের সম্ভাবনাও কেড়ে নিয়েছে।
শুরু থেকে বন্যার তান্ডব
ফেনীর ফুলগাজী ও পরশুরাম উপজেলায় যখন বন্যার পানি প্রবেশ করতে শুরু করে, প্রথমে স্থানীয়রা এটিকে স্বাভাবিক দুর্যোগ বলে মনে করেছিল। প্রতিবছর মুহুরী ও কহুয়া নদীর বাঁধ ভেঙে কয়েকটি গ্রাম প্লাবিত হওয়া যেন নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু এবছরের পরিস্থিতি ছিল ভিন্ন। ভারী বর্ষণ এবং ভারতের বাঁধ খুলে দেওয়ায় ফেনী জেলায় এক বিধ্বংসী বন্যা আঘাত হানে, যা পূর্বের সব বন্যাকে ছাপিয়ে যায়।
শুরুতে ফুলগাজী ও পরশুরামে পানি ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয়রা তাদের ঘরবাড়ি ছেড়ে আশ্রয়কেন্দ্রগুলোর দিকে ছুটে যান। কিন্তু পরিস্থিতি ক্রমেই খারাপ হতে শুরু করে। বন্যার পানি ফুলগাজী ও পরশুরাম পেরিয়ে ছাগলনাইয়া উপজেলায় ঢুকতে থাকে। এই অবস্থায় ফুলগাজী, পরশুরাম এবং ছাগলনাইয়া—এই তিনটি উপজেলার বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং মোবাইল নেটওয়ার্ক না পাওয়ার কারণে যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে।
অস্বাভাবিক গতিতে ছাগলনাইয়া উপজেলায় পানি ঢোকার পর এক দিনের ব্যবধানে ফেনী শহরও বন্যার পানিতে তলিয়ে যায়। শহরের মানুষজন পানিবন্দি হয়ে পড়ে। দ্রুত পরিস্থিতির অবনতি ঘটে যখন সোনাগাজী ও দাগনভূঁইয়া উপজেলায়ও পানি প্রবেশ করতে শুরু করে। এতে পুরো ফেনী জেলা এক মহাবিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়। খাদ্য ও পানির সংকট দেখা দেয়, এতে করে আশ্রয় কেন্দ্র সহ বিভিন্ন উঁচু ঘরবাড়িতে আশ্রয় নেয়া মানুষগুলো নিঃস্ব ও আতঙ্কিত হয়ে পড়ে।
মানুষের আর্তনাদ
বন্যার ভয়াবহতা শুরু হওয়ার পরপরই গ্রামের মানুষজন ঘরবাড়ি ছেড়ে নিজেদের বাঁচানোর জন্য ছুটতে শুরু করে। কেউ এক কাপড়ে, কেউ একমুঠো খাবার নিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রের দিকে ছুটছিল। শিশুদের কাঁধে নিয়ে মা-বাবারা কাদামাখা রাস্তায় ছুটছিলেন, পেছনে ফেলে যাচ্ছিল নিজেদের জীবনের সবকিছু। অনেকজনকে দেখা গেছে নিজেদের সাথে গবাদিপশুও নিয়ে যাচ্ছিলেন। তারা প্রথমে ভাবতে পারেনি, বন্যার পানি এত ভয়ংকরভাবে গ্রাস করবে। অনেকে তাদের শেষ আশ্রয় হিসেবে বাসাবাড়িতে ছিল, কিন্তু পানি যখন ক্রমশ বাড়তে শুরু করে, তখন এক কাপড়ে বেরিয়ে পড়েন।
কয়েকজনের সাথে কথা বলার সময় তাদের চোখে শুধুই আতঙ্ক আর ক্লান্তি দেখা যায়। পানি আর বন্যার হাহাকার চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। গ্রামের চুলাগুলোতে আগুন জ্বলেনি, কেবল শুকনো খাবার ও এক বুক সাহসে তারা বেঁচে ছিলেন। বাবা-মায়েরা সন্তানদের মুখের দিকে তাকিয়ে চোখের জল আটকে রাখার চেষ্টা করছিল, যেন তাদের দুর্বলতা ও কষ্ট সন্তানরা না দেখে।
পরিবারের ৫০ জন মানুষ নিয়ে ট্রাকে করে আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার সময় মো: রাশেদের চোখে ছিলো অতীতের স্মৃতি আর ভবিষ্যতের অজানা আশঙ্কা। তিনি বলেন, “শুধু আমি না, আমার আব্বা-আম্মাও এমন ভয়াবহ বন্যা কখনও দেখেনি। সব কিছু পানিতে চলে গেছে, কীভাবে আবার শুরু করবো জানি না।” সেই মুহূর্তে তার কথাগুলো যেনো সব বন্যার্ত মানুষের কান্নার প্রতিধ্বনি হয়ে উঠেছিল।
শুধু গ্রামে নয় শহরের মানুষেরও হাহাকার কম ছিলোনা। উঁচু ভবন কিংবা পাকা দালানে আশ্রয় নিলেও ছিলো বিশুদ্ধ পানি, মোমবাতি ও খাবারের সংকট। এছাড়াও ঘরে পুরুষ না থাকা এবং অনেক পরিবারের পুরুষ সদস্য প্রবাসে থাকায় সে সকল পরিবারকে অন্যদের তুলনায় বেশি সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে।
বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর ফুলগাজী উপজেলার হালিমা খাতুন কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলেন, "হাইল্লা তোয়াই হাইয়ের না, চাইল দি কিয়া করমু?"(পাতিল খুঁজে পাচ্ছি না, চাল দিয়ে কি করবো)
ছাগলনাইয়া উপজেলার নিচিন্তা গ্রামের ফিরোজা বেগম এক কাপড়ে চলে যান আশ্রয়কেন্দ্রে। সেখানে খেয়ে না খেয়ে কাটিয়েছেন নয় দিন। আশ্রয়কেন্দ্র থেকে বের হয়ে বাড়িতে এসে দেখেন নষ্ট হয়ে গেছে সারাজীবনে একটু একটু করে গড়া সকল জিনিস।
সংকটে সংকট
ফেনীর সর্বগ্রাসী বন্যা শুধু ঘরবাড়ি আর জীবিকা ধ্বংস করেনি, মানুষকে ঠেলে দিয়েছে এক সংকটের পর আরেক সংকটে। বন্যায় পানিবন্দি মানুষের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে খাবার এবং পানির অভাব। বড়বাজারসহ ফেনীর বেশিরভাগ দোকানপাট পানিতে ডুবে যাওয়ায় শুকনো খাবার এবং বিশুদ্ধ পানির সরবরাহ প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। খাদ্য সংকট প্রতিদিনের সংগ্রামকে আরও কঠিন করে তোলে।
কিন্তু এর চেয়েও বড় এবং অন্যতম সংকট ছিল উদ্ধার কার্যক্রম চালানোর জন্য নৌকা এবং স্পিডবোটের অভাব। ফেনী সাধারণত কোনো পর্যটন এলাকা নয়, তাই এখানে পর্যাপ্ত নৌকা বা ইঞ্জিনচালিত স্পিডবোটের সুবিধা নেই। এই ঘাটতি বন্যাকবলিত এলাকা থেকে মানুষকে উদ্ধার করতে এবং ত্রাণ সরবরাহে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
বিপদে পড়া মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে পৌঁছানোর জন্য নৌকার প্রয়োজনীয়তা ছিল তীব্র। দ্রুতগতির উদ্ধার কার্যক্রমের অভাব এবং সংস্থান সংকট পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। প্রশাসন এবং স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবীরা নৌকার ব্যবস্থা করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেছে, কিন্তু সঠিক সময়ে পর্যাপ্ত নৌকা এবং স্পিডবোট সরবরাহের অভাবে অনেক এলাকায় মানুষকে দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে।
ভেসেছে লাশ, মরেছে মানুষ
বন্যায় ফেনীতে লাশ ভাসিয়ে দেয়ার কথা সকলের কাছে অজানা কিছু নয়। বন্যার প্রথম থেকেই কেউ অসুস্থ হয়ে, কেউ পানির স্রোতে ভেসে গিয়ে, আবার কেউ অজানা কারণে মৃত্যুবরণ করেছেন। সব কিছু পানিতে ডুবে থাকায়, লাশ গুলোকে দাফন করা অনেক ক্ষেত্রে সম্ভব হয়নি। এই হৃদয়বিদারক পরিস্থিতির কারণে কিছু কিছু লাশকে কলা গাছের ভেলায় ভাসিয়ে দেয়া হয়েছে। ভেলায় একটি চিরকুট রেখে দেয়া হয়েছে, যাতে লেখা ছিলো: “শুকনো জায়গা পেলে দাফন করবেন”।
এছাড়াও, কিছু লাশ শুকনো জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে কলাগাছের ভেলায় করে এবং সেখানে কিছু কিছু লাশ দাফন করা সম্ভব হয়েছে। এমন একটি ঘটনার সাক্ষী ফেনী জেলার মিজান রোড। ২৩ অক্টোবর রাত ১২টায়, একটি লাশ কলাগাছের ভেলায় ভেসে আসে। স্বজনরা লাশটিকে ভাসিয়ে নিয়ে এসেছেন এবং গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছিলেন, যেন তারা মৃতদেহটিকে যথাযথ মর্যাদায় দাফন করতে পারেন।
ফেনীর বন্যা পরিস্থিতি যতই ভয়াবহ হয়ে উঠেছে, ততই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে এসেছেন মানবিক সাহায্যকারীরা। কেউ এসেছেন উদ্ধার কাজ করতে, আবার কেউ এসেছেন ত্রাণ সহায়তা নিয়ে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, এই সাহায্যকারীদের অনেকেই ফিরেছেন লাশ হয়ে। যারা মানুষের জীবন বাঁচাতে এসেছিলেন, তারা নিজেরাই দুর্যোগের নির্মম শিকার হয়েছেন। বন্যার এই নির্মম পরিস্থিতি কেবল প্রাণহানি ঘটায়নি, বরং মানুষকে লাশ দাফন ও শেষকৃত্য করার মতো পবিত্র কাজ থেকেও বঞ্চিত করেছে।
নারী ও শিশুদের স্বাস্থ্যঝুঁকি এবং সংকটময় পরিস্থিতি
আকস্মিক বন্যায় সবচেয়ে বেশি স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়েছে নারী ও শিশুরা। হঠাৎ বন্যার কারণে পর্যাপ্ত প্রস্তুতির অভাব থাকায় তাদের নিরাপদ আশ্রয়ে নিতে বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে। বিশেষ করে গর্ভবতী নারীদের স্থানান্তর করা ছিল অত্যন্ত কঠিন ও ঝুঁকিপূর্ণ। পানির উচ্চতা বৃদ্ধির সাথে সাথে তাদের আশ্রয়ে নিয়ে যাওয়া কিংবা হাসপাতালে পৌঁছানো ছিল একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
অনেক গর্ভবতী মহিলার প্রসবের সময় চলে আসায় তাদের হাসপাতালে নিয়ে আসার প্রয়োজন দেখা দেয়, কিন্তু হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্ত চিকিৎসক ও সিটের অভাবে চিকিৎসা সেবা দেওয়া সম্ভব হয়নি। এতে করে অনেককে জরুরি ভিত্তিতে ঢাকায় প্রেরণ করা হয়েছে, যেখানে বিমান বাহিনীর হেলিকপ্টার এবং সেনাবাহিনীর সহায়তায় স্থানান্তরের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এছাড়াও সেনাবাহিনী ও নৌ-বাহিনীর মেডিকেল ক্যাম্পে কিছু রোগীর জন্য প্রাথমিক চিকিৎসা সেবা প্রদান করা হয়েছে, কিন্তু তাতেও ছিল পর্যাপ্ত সরঞ্জাম ও সুবিধার সংকট।
নারী ও শিশুদের স্বাস্থ্যঝুঁকি আরও বেড়ে যায় যখন তারা প্রথম দিন থেকেই নানা পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হতে শুরু করে। ডায়রিয়া, জ্বর, এবং অন্যান্য পানিবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব শিশুদের মধ্যে বেশি দেখা যায়। এছাড়া, বৃষ্টিতে ভিজে থাকার কারণে ঠান্ডাজনিত রোগেও অনেক নারী ও শিশু আক্রান্ত হয়। পরিস্থিতির কারনে প্রাথমিক চিকিৎসা ছাড়া কোনো উন্নত চিকিৎসা সেবা প্রদান করা সম্ভব হয়নি। অনেক মা ও শিশুর জন্য সংকটকালীন সময়ে চিকিৎসা সেবা পাওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছিলো, যার ফলে তাদের শারীরিক ও মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে হয়েছে।
হাসপাতালের সিট সংকট, চিকিৎসক সংকট এবং পর্যাপ্ত চিকিৎসা সরঞ্জামের অভাব—এই সবকিছু মিলিয়ে পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। উন্নত চিকিৎসার অভাবে অনেক নারীর গর্ভকালীন জটিলতা বেড়েছে, আর শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গিয়ে তাদের দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
ক্ষয়ক্ষতি ও মানুষের ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা
ফেনীতে আগস্টের ভয়াবহ বন্যায় আনুমানিক ২,৬৮৬ কোটি ২০ লাখ ৫০০ টাকার ক্ষতি হয়েছে, যার মধ্যে কৃষিখাতেই ১,২০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। দৈনিক ফেনীতে প্রকাশিত এক বিশেষ প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে। চলতি বছর ফেনী তিনবার বন্যার কবলে পড়ে, তবে ২০ আগস্টের বন্যা ছিল সবচেয়ে ভয়াবহ। এতে ফুলগাজী, পরশুরাম, এবং অন্যান্য উপজেলার প্রায় ১০ লক্ষাধিক মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং ২৯ জন প্রাণ হারান।
বন্যার কারণে ফেনীতে সড়ক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ঘরবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, মোটরযান এবং ফ্রিজের বিশাল ক্ষতি হয়েছে। কৃষিখাতে ক্ষতির পরিমাণ ১,২০০ কোটি টাকা, যার মধ্যে পোল্ট্রি ও লাইভস্টকে ক্ষতি প্রায় ৩৯৬ কোটি টাকা। সড়ক যোগাযোগে ১৪০ কোটি টাকা এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও দপ্তরে ৩৮ কোটি ৭২ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। এছাড়া মোটরযানে ৬১ কোটি টাকা এবং ঘরবাড়ি ও আসবাবপত্রে ক্ষতি ৬৯২ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে।
এছাড়াও সম্প্রতি অক্সফাম প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বন্যায় ফেনীর ৯০ শতাংশ মানুষ বিপর্যয়ের মুখে পড়েছেন। সাম্প্রতিক সময়ে এমন পরিস্থিতি বাংলাদেশে আগে দেখা যায়নি। বন্যায় লাখ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ঘরবাড়ি ও কৃষিজমি ডুবে গেছে। জীবিকা হারিয়েছে লাখ লাখ মানুষ। গবাদিপশুর ক্ষয়ক্ষতি, দুর্গত জনগোষ্ঠীকে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিয়েছে।
পানি নেমে গেলেও মানুষ ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে চেষ্টা করছে। কিন্তু ধারণা করা হচ্ছে, এ ক্ষতিপূরণে অনেক সময় লাগবে। বেসরকারি সংস্থাগুলি পুনর্বাসনের জন্য কাজ করছে, কিন্তু আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও যথাযথ ক্ষতিপূরণ ছাড়া এই ক্ষতি কাটিয়ে উঠা কষ্টকর হয়ে পড়বে। এই পরিস্থিতিতে সরকারের পাশাপাশি স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক সহায়তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী ও নৌ-বাহিনীর অক্লান্ত পরিশ্রম
বন্যা পরিস্থিতি মোকাবেলায় সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী এবং নৌবাহিনীসহ সরকারি কিছু সংস্থার প্রচেষ্টা ছিলো অত্যন্ত প্রশংসনীয়। এই দুর্যোগের শুরু থেকেই তারা জনগণের সাহায্যে নিয়োজিত হয়েছে, যদিও প্রাথমিকভাবে পর্যাপ্ত সরঞ্জামের অভাবে তাদের প্রচেষ্টা অনেক ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ ছিলো। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে তারা তাদের প্রস্তুতি এবং কার্যক্রম আরও সুসংহত করেছে।
প্রাথমিকভাবে বন্যাকবলিত এলাকাগুলোতে সেনাবাহিনী উদ্ধার কার্যক্রম শুরু করে। বন্যাকবলিত এলাকার মানুষকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া এবং জরুরি সেবা প্রদান করা তাদের প্রধান দায়িত্ব ছিলো। বিশেষ করে, যেসব স্থানে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছিলো, সেখানে তারা নৌকা ও স্পিডবোটের মাধ্যমে মানুষদের নিরাপদে সরিয়ে নিয়ে যায়।
এছাড়াও বিমানবাহিনী ও নৌবাহিনীর ভূমিকা ছিলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দূর্গম অঞ্চলগুলোতে বিমানবাহিনী ও নৌবাহিনী খাবার, বিশুদ্ধ পানি, ওষুধসহ অন্যান্য জরুরি সামগ্রী বন্যাকবলিত এলাকায় পৌঁছে দিয়ে দিয়েছে। বিশেষ করে যেসব এলাকায় সড়কপথে পৌঁছানো সম্ভব ছিলো না, সেখানে হেলিকপ্টারের মাধ্যমে ত্রাণ সামগ্রী পৌঁছানোর চেষ্টা করেছে। উদ্ধার অভিযানেও ছিলো নৌ ও বিমান বাহিনীর দৃশ্যমান কার্যক্রম। সামরিক বাহিনীর পাশাপাশি বিভিন্ন সরকারি সংস্থা, যেমন ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর, স্থানীয় প্রশাসন এবং স্বাস্থ্য বিভাগ, বিদ্যুৎ বিভাগ বন্যা মোকাবেলায় ভূমিকা পালনের চেষ্টা করেছে।
তবে, চেষ্টা থাকলেও স্থানীয় প্রশাসনের সমন্বয়হীনতার কারনে অনেক কার্যক্রমের সিদ্ধান্ত সঠিক সময়ে নেয়া সম্ভব হয়নি। প্রথমদিকে প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের অভাব এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার কারণে উদ্ধার ও ত্রাণ কার্যক্রমে কিছুটা সমস্যা দেখা দেয়।
স্বেচ্ছাসেবকদের নিরলস প্রচেষ্টা
ফেনীতে বন্যার শুরু থেকেই স্বেচ্ছাসেবকরা নিজ নিজ জায়গা থেকে দায়িত্ব পালনে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন। কেউ উদ্ধার অভিযানে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন, আবার কেউ পৌঁছে দিয়েছেন খাদ্য সহায়তা। দুর্গম এলাকা আর প্রচণ্ড বন্যার স্রোত তাদের বাধা হয়ে দাঁড়ালেও, তারা কখনো থেমে যাননি। প্রতিকূল পরিবেশের সাথে যুদ্ধ করে নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন এই সাহসী স্বেচ্ছাসেবকরা।
শুরুর দিকে নৌকা ও স্পিডবোটের অভাবে স্বেচ্ছাসেবকদের কাজ চালিয়ে যাওয়া বেশ কঠিন হয়ে পড়েছিল। কিন্তু তারা হতাশ না হয়ে কলা গাছের ভেলা তৈরি করেন। সেই ভেলা দিয়েই দুর্গম এলাকা থেকে আটকে পড়া মানুষদের উদ্ধার এবং ত্রাণ সরবরাহ চালিয়ে যান। কোনো কোনো জায়গায় খাবার বা বিশ্রামের সুযোগ ছাড়াই রাত-দিন এক করে চলেছেন এসব মানবতার সৈনিকরা।
পরবর্তীতে নৌকা ও স্পিডবোট আসতে শুরু করলে তাদের কাজ কিছুটা সহজ হয়, তবে স্বেচ্ছাসেবকদের উদ্যম কমেনি। তারা দিন-রাত না খেয়ে, বিশ্রাম না নিয়ে ছুটে গেছেন আটকে থাকা মানুষদের দিকে। তাদের অবিরাম প্রচেষ্টায় অনেক প্রাণ রক্ষা পেয়েছে এবং অসহায় মানুষদের কাছে পৌঁছেছে প্রয়োজনীয় সহায়তা।
এছাড়াও বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে এসেছিলেন স্বেচ্ছাসেবকরা। নিজ নিজ জায়গা থেকে করে গেছেন কাজ। কেউ ছিলেন সাথে নিয়ে আসা ট্রাকে আবার কেউবা ছিলেন নৌকা কিংবা স্পিডবোটে। স্থানীয় মানুষজন অনেক স্বেচ্ছাসেবকদের জায়গা করে দিয়েছেন তাদের বাড়িতে।
পরের অংশ পড়ুন ⇒এখানে