গতকাল রাতে নিউজফিডে স্ক্রল করতে করতে নারী দিবস কেন্দ্রিক কিছু জিনিস চোখে পড়লো, মনোযোগ দিয়ে কিছুটা দেখলাম। বিষয়গুলোর মূল ভাবার্থ আমার কাছে বেশ চমৎকার লাগলো, যেটি মনঃপুত হয়নি সেটি হচ্ছে ভাবনার প্রয়োগ অথবা তথ্য নির্বাচন। কিন্তু মূল ব্যাপারগুলো দারুন ছিলো,অনেকটা সৃজনশীল ছিলো। এটি নিয়ে পরে বলছি।
আগে নারী দিবস নিয়ে একটু বলি। নারী দিবসের কথা এলেই পুরুষদের একটি কমন মজার কথা আসে তা হলো, পুরুষ দিবস কই! এটি কি লিঙ্গ বৈষম্য নয়! কথা গুলো কেবল মজা করেই বলে সবাই। আসলে নারী দিবসে কিংবা দিবস ছাড়াও নারীদের অগ্রসর করার শর্তে পুরুষের রয়েছে নানা দায়-দায়িত্ব। শেষের দিকে সেটির স্বল্প ভাবনা তুলে ধরবো নাহয় ।
শুরুতে কাল রাতে নারী দিবস কেন্দ্রিক কিছু উপস্থাপন দেখার কথা বলছিলাম। এই দেখার পর থেকে মধ্য রাত অবদি ভাবনার জগতে ডুবে গেলাম, আমার প্রায়ই এমন হয়। যেটি যেমন হওয়া উচিত, তেমনটি না হলে কেমন জানি অপূর্ন অথবা অসম্পূর্ণ মনে হয়। যদিও এটি আমি সংক্রান্ত কিছুই নয়। তাও তখন নিজে নিজেই বিষয়টি নিয়ে আমি ভীষণ ভাবি। যা দেখি,এমন অনেক কিছুই করার কথা মাথায় প্রায়ই আসে। কিন্তু করিনা,করিনা নানা প্রাসঙ্গিকতায়। আমি দক্ষতাকে সহজলভ্য করার বিষয়ে একমত নই, দক্ষতা অর্জনের পূর্বে দক্ষদের কাতারে কাউকে দাঁড় করিয়ে দেয়ার পক্ষেও নই। না মানে,একদম না। এই "না" টা আমার একান্তই ব্যক্তিগত। কিন্তু আমার "না" ভাবনার বিষয়টি অন্য অনেকে সুযোগ বুঝে "হ্যা" বানিয়ে দেয়। যার যার কর্নার থেকে যার যার সু-যুক্তি থাকে হয়তো। সু-যুক্তি বলছি কারণ সবার কাছে তার যুক্তিই সঠিক। আমার কাছে উপযুক্ত যুক্তি নয় বলেই সেসব আমার কাছে "না" এর মধ্যে সীমাবদ্ধ।
নারী দিবসে আমি নারীদের নিয়ে "না" ভাবতে চাই না। বরং ভাবতে চাই একটু ভিন্ন ভাবে, একজন পুরুষ হিসেবে। নারী দিবসকে আমরা কেবল সোশ্যাল মিডিয়ার একটি "বিষয় বস্তু" হিসেবেই ধরে নিয়েছি, অনেকে আবার নারী দিবস যতটা বুঝিনা "ওমেন্স ডে" তার চেয়েও বেশী বুঝি। সবাইকে নারী দিবসের শুভেচ্ছা যে হারে জানানো হয়েছে, সে হারে যদি আমরা নারীর দক্ষতা উন্নয়ন নিয়ে ভাবতে পারি তবেই এই দিবস নারীদের অনেক কাজে আসবে। নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে আসলে এখন অতটা বলার নেই, তুলনামূলক ভাবে ক্ষমতায়নের দিক থেকে নারীরা অনেক এগিয়েছে। অফিস, আদালত,প্রশাসন কিংবা ব্যবসা-সব জায়গায় এখন নারীর পদচারণা সময়ের পরিক্রমায় বেড়েছে। তবে এটি নির্দিষ্ট একটি শ্রেণীর নারীদের ক্ষেত্রে বলা যায়। কিন্তু প্রান্তিক নারী গোষ্ঠীর সে তুলনায় প্রত্যাশিত পরিবর্তন আসেনি, উন্নয়ন ঘটেনি নিজস্ব জীবন যাত্রায়। জ্ঞান আহরণের খুব একটা সুযোগ সৃষ্টি হয়নি তাদের।
ছোট্ট একটি উদাহরণ দেই। আমার এক প্রিয় সংবাদকর্মী ছোট ভাই, আমার কাছে ফেনীর ৩-৪ জন ক্ষুদ্র নারী উদ্যোক্তার নাম জানতে চাইলো। গত ৪-৫ বছর ধরে ফেনীর কিছু ক্ষুদ্র ও সৌখিন নারী উদ্যোক্তাদের নিয়ে আমার "দেখা হবে বিজয়ে" নামক প্রতিষ্ঠানের কাজ করার স্বল্প অভিজ্ঞতা আছে। সে সূত্রেই আমার কাছে তার এই জানতে চাওয়া। বিভিন্ন সময় আরো বিভিন্ন সংবাদ সংশ্লিষ্ট ভাই-বন্ধু এরকম নাম আমার কাছে চায়। তাদের নিয়ে সফলতার গল্প ফিচার আকারে লিখার জন্য। সত্যি বলতে ফিচার কিংবা আর্টিকেল হবার মতো নাম আমি খুঁজে পাইনা। কঠোর চেষ্টা ও গুন-মান ধরে রেখে ভালো কাজ করছে এরকম যে নেই সেটি বলছিনা। উদ্যোগ বা উদোক্তা বলতে আমার ছোট্ট মেধায় যা বুঝি সেরকম যে কয়েকজন কে জানি তারা কেবল তৈরি হচ্ছে অথবা সম্ভাবনাময় বলেই আমি বুঝি। এখনও তারা অতটা পরিণত বা প্রস্তুত নয়, যতটা হলে তাদের গল্প নতুনদের পথ দেখাবে। কারণ তারা নিজেরাই সবে "তরুণ ও শিক্ষানবিশ" হিসেবে যাত্রা শুরু করেছে।
বর্তমান সময়ে কথায় কথায় বিভিন্ন অনলাইন পোর্টালে "অমুকের সফলতার গল্প,তমুকের বিজয়ের গল্প" এরকম নানা লিখা চোখে পড়ে। এই ব্যাপারটির সাথে আমি আসলে একেবারেই অভ্যস্ত নই। আগে একটা সময় ছিলো নানা সংগ্রাম, মেধা ও শ্রমের বিনিময়ে একজন উদোক্তা, সংগঠক তৈরী হতো এবং তার দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা ও সফল হবার গল্প তরুণদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে পত্র-পত্রিকায় লিখনির বিষয় হতো। এখনকার সময়ে এই বিষয়টিকে যেনো "মুড়ির মোয়া" বানিয়ে দেয়া হয়েছে। কেউ একজন কদিন কিছু একটা করলেই তাকে সফল হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয় একটি অপূর্ণ সস্তা আর্টিকেল এর মাধ্যমে। কাছের মানুষ বলে এদেরকে উপস্হাপন করা হয় অগ্রগামী অথবা সৃজনশীল বলে ।
কাজের সূত্রে এদের অনেককেই আমি জানি বেশ কাছ থেকে,প্রাসঙ্গিক ভাবেই। তথাকথিত সফল এদের অনেকেরই নিজস্বতা বলে কিছু নেই। এদের পণ্যের মান নিয়েও আছে নানা প্রশ্ন, আছে অন্যজনের পণ্যকে নিজের বলে চালিয়ে দেয়ার কূট-কৌশল । বাজার থেকে সংগ্রহ করে নিজের বলে চালিয়ে দিয়ে অনেকে সেজে যাচ্ছে সংগ্রামী উদোক্তা। উদোক্তা শব্দটি এখন "ফ্যাশন" এ পরিণত হয়েছে যেনো।
কেউ কাজ করে স্বীকৃতি পায়, আর কেউ কাজের আগেই স্বীকৃতি পেয়ে বসে থাকে। যুগ এখন কাজের মানুষদের খুঁজেনা, যে যার কাছের মানুষদের নিয়েই ব্যস্ত। কাছের মানুষদের ভিড়ে কাজের মানুষরা থেকে যায় লোকচক্ষুর আড়ালে, তাদের গায়ে "প্রচার" নামক আলোর রেখা সহসা পড়েনা।
তবে সবাই একই নয়, কেউ কেউ ঠিকই খুঁজে বের করে কারা আসল হীরা। কারা সত্যিকার অর্থে মেধাবী, কারা বিজয়ী সেসব নারী। সঠিক মানুষকে খুঁজে বের করতে পারাও একধরনের দক্ষতা, সে দক্ষতা অবশ্যই কিছু মানুষের আছে। আছে বলেই এখনো পৃথিবীতে সৃজনশীল চর্চা হয়, সেসবকে তুলে ধরাও হয়।
নারী দিবসে পুরুষদের করণীয় কি হতে পারে, এটি নিয়েই মূলত লিখতে বসেছিলাম। নারী ব্যতীত আমাদের দৈনন্দিন জীবন যেমন অর্থবহ হয়না, তেমনি নারীকে এগিয়ে দিতে পুরুষদের কাজও অনেক। একজন দক্ষ নারী কেবল তার নিজের জীবনকেই সুন্দর করেনা, সুন্দর করে তার পরিবার সমাজ ও কর্মপরিসরকেও। তাই পুরুষদের উচিত নারীদের দক্ষতা উন্নয়নে নিজেদের বেশী বেশী সম্পৃক্ত করা। কর্মক্ষেত্রে সম্পৃক্ত হতে চাওয়া নারীদের বেশী বেশী প্রশিক্ষণ, কর্পোরেট গ্রূমিং,ভাষাগত চর্চা,পণ্য যাচাই সক্ষমতা সহ ছোট-বড় নানা প্রাসঙ্গিক বিষয়ে জ্ঞানার্জনের সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়া অত্যন্ত প্রয়োজন। অন্তত এই ব্যাপারগুলো নারীদের সঠিক পথ দেখাতে সবচেয়ে বেশী সহযোগিতা করবে বলে আমার বিশ্বাস। প্রচারের আলোয় আসাটা অবশ্যই ইতিবাচক ও প্রয়োজনীয়, তবে তার চেয়েও বেশী গুরুত্বপূর্ণ নারীদের কর্মদক্ষতা, সৃজনশীল জ্ঞানার্জনের সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়া। এগুলো যদি করা যায় তবেই নারীদের কারো মুখাপেক্ষী হতে হবেনা, প্রচারের আলোর জন্য মুখিয়ে থাকতে হবেনা, অমুক-তমুকের নির্ভরতায় পিছিয়ে পড়তে হবেনা । এতে করে সমাজে নারী-পুরুষ বৈষম্য যেমন অনেকাংশে কমে আসবে তেমনি প্রতিযোগিতামূলক কর্মক্ষেত্রে নিজেদের উপস্থিতি আরও বাড়াতে সক্ষম হবে নারীরা । সকল নারীর জন্য রইলো অনেক শুভকামনা। দেখা হবে বিজয়ে।
লেখক: প্রশিক্ষক, দেখা হবে বিজয়ে