আত্মহত্যা মানে নিজেই নিজেকে হত্যা করা। হত্যা মানে খুন বা জীবন সংহার করা। কেউ আত্মহত্যা করে ফেললে সেখান থেকে ফিরে আসার আর কোনো পথ থাকে না। এর বেদনাদায়ক প্রভাব শুধু একজন ব্যক্তির জীবননাশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না, বরং ব্যক্তি সংশ্লিষ্ট ঘনিষ্ঠজন, পরিবার ও সমাজে এক ভয়াবহ বিপর্যয় বয়ে আনে। তাই একমাত্র কার্যকর উপায় হলো আত্মহত্যা প্রতিরোধ করা। ইসলামি শরিয়তের বিধানমতে, আত্মহত্যা মহাপাপ বা কবিরা গুনাহ। কবিরা গুনাহ তাওবা ছাড়া মাফ হয় না; আর আত্মহত্যাকারীর তা করার কোনো সুযোগই থাকে না। সুতরাং এই মহাপাতকী চির-দোজখি হয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জরিপ বলছে, 'প্রায় এক মিলিয়ন মানুষ প্রতি বছরে আত্মহত্যার কারণে মারা যায়'। যা নির্দেশ করে প্রতি ৪০ সেকেন্ডে একটি মৃত্যু। পৃথিবীর প্রতিটি দেশেই মৃত্যুর প্রথম দশটি কারণের মধ্যে এবং পনেরো থেকে পঁয়ত্রিশ বছর বয়সিদের প্রথম তিনটি কারণের মধ্যে একটি হলো আত্মহত্যা। বাংলাদেশে আত্মহত্যার জাতীয় কোনো পরিসংখ্যান নেই। স্থানীয় গবেষণায় দেখা গেছে, এ হার প্রতি লাখে ১০ জন, যা উন্নত দেশের কাছাকাছি। প্রতিটি আত্মহত্যা ঘটানোর আগে গড়ে ২৫ বার আত্মহত্যার প্রচেষ্টা লক্ষ করা যায়। এ জন্য আত্মহত্যার প্রচেষ্টাকে কোনোভাবেই হালকাভাবে নেওয়ার সুযোগ নেই। আর অগণিত জীবনহানি প্রতিরোধে প্রয়োজন সচেতনতা, দ্রুত ও সময়মতো আত্মহত্যার প্রবণতা নির্ণয় ও তার প্রতিকার, চিকিৎসা ইত্যাদি।
আত্মহত্যার জরিপে বিশ্বে দশম স্থানে রয়েছে বাংলাদেশ । প্রতি বছর কিছু স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের পরীক্ষায় আশানুরূপ ফল না পেয়ে হতাশাগ্রস্ত হয়ে আত্মহত্যা করছে। তার খবরও আমরা পাই প্রতিনিয়ত। তবে প্রশ্ন হতে পারে মানুষ কেন আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়? বিভিন্ন মানসিক কষ্ট ও হতাশার কারণেই মানুষ আত্মহননের পথ বেছে নেয়। সমকালীন গবেষকদের মতে, স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়া, মা-বাবা ও অভিভাবকদের শাসন, পরকীয়া প্রেম-ভালোবাসা, কাঙ্ক্ষিত সফলতা না পাওয়া, অভাব-অনটন, ভয়-ভীতি, অসুস্থতা, অপ্রাপ্তি, অসহ্য মানসিক চাপ, যৌতুক, মানসিক সমস্যা, যৌন হয়রানি, চাকরি নিয়ে অনিশ্চয়তা, হতাশা ইত্যাদি হচ্ছে আত্মহত্যার কারণ। তার ওপর মানুষ যখন শেষ আশ্রয়স্থল ঘনিষ্ঠজন ও পরিবারের কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হন, তখন ওই ব্যক্তি আত্মহত্যা ছাড়া অন্য কিছু ভাবতে পারে না। কিন্তু মানুষ নিজে সে তার নিজের স্রষ্টা নয় এবং মালিকও নয়। মানুষ জীবন ও মৃত্যুর মালিকও নয়। দুনিয়াতে আসা ও যাওয়া তার ইচ্ছাধীন নয়। তাই সে নিজের প্রাণ সংহার যেমন করতে পারে না, তেমনি সে তার দেহেরও মালিক নয়, তাই সে তার নিজ দেহের অঙ্গচ্ছেদ বা অঙ্গহানিও করতে পারে না।
সমাজে যারা আশাবাদী, জীবনের কষ্টকে যারা চ্যালেঞ্জ হিসেবে ভাবেন এবং যে কোনো বিষয়ে অল্পতেই সন্তুষ্ট থাকেন তাদের মধ্যে আত্মহত্যার হার কম দেখা যায়। মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা ছাড়াও আত্মহত্যা ও আত্মহত্যার প্রবণতার সঙ্গে ব্যক্তিত্বের সমস্যা অনেকাংশে দায়ী। 'মানুষের মধ্যে অবচেতনে থাকে মৃত্যু প্রবৃত্তি। পরিবেশ পরিস্থিতির প্রভাবে এই মৃত্যু প্রবৃত্তি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে আর মরিবার সাধ হয় তার। আত্মহত্যাকারীদের ৯০ শতাংশেরই কোনো না কোনো ধরনের মানসিক রোগের সমস্যা ছিল। এর মধ্যে ডিপ্রেশন, স্কিটজোফ্রিনিয়া নামের জটিল মানসিক রোগসহ মাদকাসক্তি ও অ্যালকোহলে আসক্তি, ব্যক্তিত্বের সমস্যা, মৃগী রোগের মতো শারীরিক কারণে মানসিক সমস্যা ইত্যাদি অন্যতম। বর্তমান প্রজন্ম ধ্বংসের পেছনে অন্যতম হচ্ছে স্মার্টফো। এখনকার কিশোররা বন্ধুর সান্নিধ্যে কম সময় কাটায়, তাদের মধ্যে ডেটিং কমছে, এমনকি পুরো প্রজন্মের ঘুম কম হচ্ছে। একাকিত্বের এই হার বাড়ায় সাইবার নিপীড়ন, হতাশা, উদ্বেগ এবং আত্মহত্যার ঘটনা বাড়ছে। কিছু কিছু মনোবিজ্ঞানীর মতে, মানুষের একাকিত্ববোধ, অস্তিত্বহীনতা, জীবনের অর্থ-উদ্দেশ্য খুঁজে না পাওয়ায় আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে।
আত্মহত্যা কী আসলেই ব্যক্তির জন্য সমস্যা-সমাধানের পথ? আত্মহত্যা করলেই কী ব্যক্তির সব সমস্যা শেষ হয়ে যায়? না। বরং প্রতিটি আত্মহত্যার ফলে সমাজ ও সংসারে অপূরণীয় ক্ষতি হয়। সারাজীবনের জন্য ভেঙে যায় একটি পরিবারের স্বপ্ন, আশা, আকাঙ্ক্ষা। মা-বাবা হারায় তার সন্তানকে, ভাই হারায় তার বোনকে, বন্ধু হারায় তার বন্ধুকে। তা ছাড়া মৃত ব্যক্তির পরিবার গভীর শোক, অপরাধবোধ, হতাশা এবং আরও নানাবিধ জটিল পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়। আবার, মৃতের যদি সন্তান-সন্ততি থাকে তারাও স্বাভাবিক পরিবেশে বেড়ে উঠতে পারে না। তার পরিবারে সমাজ কর্তৃক বিভিন্ন সমস্যা সৃষ্টি হয়, পরিবারকে সমাজ কর্তৃক হেয় চোখে দেখা হয় এবং বিভিন্ন নেতিবাচক মনোভাবের সম্মুখীন হতে হয়। তা ছাড়া আত্মহত্যাকারীর পরিবারকে পোহাতে হয় নানা রকম আইনি ঝুট-ঝামেলা এবং বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা সামাজিকভাবেও আত্মহত্যাকারীর পরিবারের মান-মর্যাদা, প্রভাব কমে যায়, এক ঘরে হয়ে যেতে হয়।
সর্বোপরি পরিবারের শান্তি এবং স্বাভাবিক ব্যবস্থাটাই ভেঙে পড়ে। আত্মহত্যাকারীর মৃত দেহকেও সম্মান করা হয় না। পুলিশি পোস্টমর্টেমের নামে ছিন্নভিন্ন করা হয় মৃতের দেহ। যা আপনজন-পরিবারের পক্ষে সহ্য করা হয়ে যায় কঠিন। তাহলে প্রশ্ন আসতে পারে, কোনোভাবেই কি এই ভয়াবহ আত্মহত্যার ব্যাধি থেকে মানুষকে বাঁচানো যায় না? চাইলেই যায়, মানুষকে সচেতন করার মাধ্যমে। হতাশাগ্রস্ত মানুষের বোঝাতে হবে, শুধু তোমার জীবনে নয়- সব মানুষের জীবনেই দুঃখ-কষ্ট আছে, থাকবেই। তবে দুঃখ-কষ্ট আছে বলেই নিরাশ হওয়া যাবে না। জীবনের চ্যালেঞ্জকে গ্রহণ করতে হবে। কোনো কাজেই আশাহত হওয়া যাবে না। সফলতাই জীবনের সব কিছু নয়। ব্যর্থ হলে আবার অন্যভাবে চেষ্টা করে দেখতে হবে, কোনো কাজই ছোট নয়। আর ধর্মকে মেনে চলতে হবে, কারণ সব ধর্মেই আত্মহত্যা মহাপাপ। তাই ধর্ম মানলে, অন্তরে ধারণ করলে আত্মহত্যাকেও একটা পাপ মনে হবে। ফলে আত্মহত্যা অনেকটাই কমে যেতে পারে। আত্মহনন মানে শুধু নিজেকে বঞ্চিত করা নয়; বরং অন্য সবার অধিকার হরণ করা। আত্মহত্যা মূলত আত্মপ্রবঞ্চনারই নামান্তর। কারণ, জীবন বিসর্জন দেওয়া কোনো সমস্যার সমাধান নয়; কোনো সফলতাও নয়, বরং চরম ও চূড়ান্ত ব্যর্থতা। এর দ্বারা কোনো কিছুই অর্জিত হয় না; বরং একূল-ওকূল দুকূলেই হারাতে হয়।
লেখক: প্রাবন্ধিক