অন্য অনেকের মত করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কলেজ এডুকেশন ডেভলপমেন্ট প্রজেক্ট’র সিনিয়র প্রোগ্রাম অফিসার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯ ব্যাচের শিক্ষার্থী ফেনীর ছেলে মোঃ মামুন উল হক। দৃঢ় আত্মবিশ্বাস আর বুক ভরা সাহস নিয়ে দীর্ঘ ২১দিন লড়াই করে করোনার কবল হতে মুক্ত হয়েছেন তিনি। কিভাবে? গত ১৯ জুন সেই অভিজ্ঞতার গল্প তিনি তুলে ধরেছিলেন নিজের ব্যক্তিগত ফেইসবুক আইডিতে। তার সেই করোনা জয়ের গল্প উপস্থাপন করা হল দৈনিক ফেনীডটকমের পাঠকদের জন্য-
দীর্ঘ একুশ দিন পর একটু আগে শরীর থেকে করোনা ভাইরাস মুক্তির নিশ্চয়তা সংবাদ পেলাম। আক্রান্ত হবার পর ফেসবুকে জানান দিয়ে নানামুখী দুশ্চিন্তায় কাতর মুরুব্বীস্থানীয় অসুস্থ আত্মীয়, বন্ধু ও পরিচিতদের টেনশনে ফেলতে চাইনি বলেই এতদিন নিশ্চুপ ছিলাম। পরিচিত অনেকেই অনুরোধ করেছেন, এই সংকটকালের অভিজ্ঞতা আর উপলব্ধিটা শেয়ার করলে কারো না কারো কাজে লেগে যেতে পারে। তাই লিখতে বসলাম।
আটাশে মে রাতে গলায় খুশখুশে ভাব, উনত্রিশ তারিখে একটু কাশি। কোন দ্বিধা না করেই হোম আইসোলেশন এর সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম। পরদিন বেশ ভালো বোধ করলেও সিদ্ধান্ত পরিবর্তন না করে প্রটোকল মেনে রুম লক রেখে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের করতে থাকলাম। পরদিন জ্বর আর গায়ে ব্যাথা শুরু হলো। বিলম্ব না করে প্রটোকল মেনে ইভারমেকটিন ও ডক্সিসাইক্লিন আর ব্যাথার জন্য প্যারাসিটামল খাওয়া শুরু করলাম। বাচ্চাদের নিজ নিজ রুমে চৌদ্দ দিনের কোয়ারেন্টাইন বুঝিয়ে কারোরই মাস্ক ছাড়া বের হতে বারণ করলে ওরা খুবই গুরুত্ব দিয়ে সাড়া দিলো।
পহেলা জুন ছেলে আর স্ত্রী শরীর ব্যাথা বললেই ওদের দুজনকেও ইভারমেকটিন ও এন্টিবায়োটিক শুরু করিয়ে দিলাম। ছেলে একদিন স্ত্রী তিন/চারদিন পরে সুস্থ হয়ে গেলেও আমার শরীর খারাপ হতে থাকলো। তিন তারিখ টেস্ট দিয়ে রাখলাম। আর আসন্ন ঝাপটা সামলানোর জন্য ব্রিদিং এক্সারসাইজ করে ফুসফুসকে প্রস্তুত করার চেষ্টা করলাম।
চার তারিখ রাত থেকেই মৃদু থেকে মাঝারি ধরণের শ্বাসকষ্ট ও শরীরের ব্যথা বেড়ে গেলো। পরপর বেশ কয়েকজন বন্ধু পরিচিতজনদের কোভিড আক্রমণে চলে যাবার সংবাদ মনটাকে ভেঙ্গে দিল। চিকিৎসকের পরামর্শে শ্বাসকষ্ট ও কাশির জন্য মন্টিলুকাস ও ডেক্সোফাইলিন চলতে লাগলো। চারদিনের লড়াই শেষে একটু স্বস্তি বোধ হতে নয় তারিখে আবার টেস্ট দিলাম। এখন সামান্য খুশখুশে কাশি ছাড়া আর কোন অস্বস্তি নেই। এই যাত্রায় অভিজ্ঞতা আর উপলব্ধিগুলো নীচে শেয়ার করলাম :
১) এই অতিমাত্রায় ছোঁয়াছে ভাইরাস থেকে পুরোপুরি নিরাপদ থাকা সম্পূর্ণ অনিশ্চিত। সতর্কতা কোন নিশ্চয়তা নয়; তাই আতন্কিত জীবনযাপন না করে আক্রান্ত হলে কী কী করবেন, আগেই ঠিক করে রাখুন।
২) আমার হয়তো হয়নি এমন সুবিধাবাদী ধারণা করার চাইতে হয়েছে ধরে নিয়ে দ্রুত সতর্কতা ও হোম আইসোলেশন নিশ্চিত করুন। এতে পরিবারের অন্যদের সুরক্ষিত করা সহজ হবে।
৩) টেস্ট এর রিপোর্ট এর জন্য অপেক্ষা না করে ন্যুনতম চিকিৎসার প্রটোকল শুরু করে দিন। সম্ভব হলে সামান্য ইভারমেকটিন ও ডক্সিক্যাপ বা এজিথ্রোমাইসিন ঘরে রাখতে পারেন।
৪) সরকারি টেস্ট এর তিন তারিখ এর রিপোর্ট তের তারিখ আর নয় তারিখের রিপোর্ট সতের তারিখে এসেছে। তাই, টেস্টের পেছনে দৌড়াতে গিয়ে শরীরের উপর বাড়তি চাপ নেবেন না।
৫) টেস্টে রেজাল্ট নেগেটিভ এলেও চৌদ্দ দিনের আইসোলেশন যথাযথভাবে পালন করুন। সম্ভব হলে একুশ দিন ঘরেও সকলের সামনে মাস্ক পরে থাকুন।
৬) হাসপাতাল ও সরকারের দেয়া নম্বরে কথা বলে কোন অবস্থায় মুভ করতে হবে সেটি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা রাখুন। বয়োজ্যেষ্ঠ কেউ আক্রান্ত হলে বাসায় অক্সিজেন সিচুরেশন পরীক্ষার ব্যবস্থা নিন। রেটিং বিরানব্বই এর কম হলে হাসপাতালে নেয়া বা অক্সিজেন সাপোর্ট দেয়ার ব্যবস্থা নিন।
৭) পরিবারের বাকীদের সুরক্ষার জন্য সতর্ক থাকুন। সকলকে ভিটামিন সি, ডি, জিন্ক ও ক্যালসিয়াম নেয়ার ব্যবস্থা করুন।
৮) গরম পানি, মশলা পানি, ভাপ এগুলো যতটা সহনীয় চালাতে পারেন। তবে অতিরিক্ত করতে গেলে এসিডিটি ও অন্য সমস্যা দেখা দিতে পারে।
৯) করোনা ভাইরাস পঁচাশি ভাগ রোগীর শরীরে সাধারণ ফ্লু এর বেশি সমস্যা সৃষ্টি করতে পারেনা। সামান্য জ্বর ও গায়ে ব্যথার ভেতর দিয়ে দুই/তিন দিনেই ক্লিন হয়ে যায়। বাকী দশভাগ রোগীর সপ্তাহখানেক ভুগতে হয়। শুধুমাত্র পাঁচ ভাগ রোগীর অক্সিজেন সহায়তা লাগে। এদের মধ্যে দশমিক পাঁচ ভাগের ভেন্টিলেশনে যেতে হয়।
১০) ধৈর্য্য, মনোবল ও স্রষ্টার উপর অগাধ বিশ্বাসের শক্তি দিয়ে এই বিপদকাল অতিক্রম করতে হবে। খারাপ সময়টিতে ফেসবুকে না যাওয়াই ভালো। পরিচিত ও অন্যদের মৃত্যু সংবাদ মানসিকভাবে দুর্বল করে ফেলতে পারে।
করোনা ভাইরাস অতিমাত্রায় ছোঁয়াছে। তাই একসময় এটি আমাদের দেশের অন্তত সত্তরভাগ মানুষকে ছুঁয়ে যাবে। আতংক পরিহার করে সতর্কতা ও সাহস নিয়ে এই পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হবে। আতংক এই বিপদে কোন কাজেই আসবে না। আত্মবিশ্বাস রাখবেন, এই রোগে অধিকাংশ রোগীই কয়েক দিনের মধ্যে সুস্থ হয়ে যায়।
আল্লাহপাকের কাছে তাঁর দয়ার জন্য অশেষ শোকরানা। আমার স্ত্রী নিজের অসুস্থতা সত্বেও দুঃসময়ে আমাকে সেবা দেয়ায় তাঁর প্রতিও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। কৃতজ্ঞতা সিইডিপি প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক, উপ পরিচালক ও সহকর্মীদের কাছে, যারা আমাকে সাহস ও সুযোগ দিয়ে মনোবল ধরে রাখতে সহায়তা করেছেন।