চোখ বন্ধ করে ভাবতে চাই—একে একে ১৬টি লাশ ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার বা দেশের বিভিন্ন কারাগার থেকে অ্যাম্বুল্যান্সে করে ফেনীতে পৌঁছে যাচ্ছে। আগের রাতের কোনো এক সময় তাঁদের ফাঁসি কার্যকর হয়েছে।
১৬টি লাশ হচ্ছে : সিরাজ উদ দৌলা (কারাগারে বসে নুসরাতকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যার নির্দেশদাতা ও পরিকল্পনাকারী), রুহুল আমিন (জ্ঞাত থেকে হত্যার পরিকল্পনায় অংশ নেওয়া ও আসামিদের বাঁচানোর চেষ্টা করেন), মাকসুদ আলম (হত্যার সরঞ্জাম কেনার জন্য ১০ হাজার টাকা দেন এবং ঘটনা আত্মহত্যা বলে চালানোর চেষ্টা করেন), শাহাদাত হোসেন (নুসরাতকে হত্যার জন্য কেরোসিন কিনে দেন। ঘটনার সময় তিনি নিজে নুসরাতের মুখ চেপে ধরেন), আবছার উদ্দিন (নুসরাতকে আগুন দেওয়ার আগে মাদরাসার ফটকে পাহারা দেন), আব্দুল কাদের (নুসরাতকে হত্যার আগে মাদরাসার মূল ফটকে পাহারায় ছিলেন), উম্মে সুলতানা (নুসরাতের সহপাঠী ছিলেন। নুসরাতকে ছাদে ডেকে নেন। ওড়না দিয়ে নুসরাতের হাত বেঁধে ও পা ধরে রাখেন), কামরুন নাহার (হত্যার জন্য বোরকা ও হাতমোজা কেনেন। ঘটনার সময় নুসরাতের বুক চেপে ধরেন), ইফতেখারউদ্দিন (নুসরাতকে হত্যার আগে বৈঠকে অংশ নেন। মাদরাসার ফটকের বাইরে পাহারা দেন), নুরউদ্দিন (কারাগারে অধ্যক্ষের সঙ্গে দেখা করেন এবং তাঁর নির্দেশনা অনুযায়ী হত্যার পরিকল্পনা করেন ও গেটে পাহারা দেন), মো. জোবায়ের (নুসরাতের ওড়নার একাংশ দিয়ে নুসরাতের পা পেঁচিয়ে ধরে ম্যাচ দিয়ে গায়ে আগুন দেন), মহিউদ্দিন শাকিল (সাইক্লোন শেল্টারের নিচে পাহারা দেন, যাতে সবাই নিরাপদে চলে যেতে পারেন), আব্দুর রহিম (হত্যাকাণ্ড নির্বিঘ্ন করতে মাদরাসার ফটকে পাহারা দেন), ইমরান হোসেন (মাদরাসার মূল ফটকের বাইরে পাহারা দেন ও মূল পরিকল্পনাকারী), জাবেদ হোসেন (হত্যার আগে বৈঠকে অংশ নেন। আগুন দেওয়ার আগে নুসরাতের গায়ে কেরোসিন দেন), মো. শামীম (সাইক্লোন শেল্টারের নিচে পাহারা দেন, যাতে কেউ আসতে না পারে)।
পাঠক, এই যে ১৬টি লাশের পরিচয় দেওয়া হলো, যাঁরা ফেনীর সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদরাসার আলিম পরীক্ষার্থী নুসরাত জাহান রাফিকে হত্যায় জড়িত ছিলেন, তাঁদের কারো জন্য কি মায়া হচ্ছে? বা তাঁরা সঠিক বিচার পাননি, এমনটি মনে হচ্ছে? তাঁদের প্রতি অবিচার করা হয়েছে, এমন কিছু মনে হচ্ছে আপনার?
বিশ্বাস করি, আমার মতো অনেক মানুষই চোখ বন্ধ করে ভাবতে চান ওই দৃশ্যটা—একে একে ১৬টি লাশ পৌঁছে যাচ্ছে ফেনীতে।
কী অপরাধ ছিল নুসরাতের? মাদরাসা অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলা যৌন নিপীড়ন করায় সে তার প্রতিবাদ করেছিল। এর জন্য নুসরাতের শরীরে ৬ এপ্রিল আগুন দেওয়া হয়। ১০ এপ্রিল রাজধানীর একটি হাসপাতালে তাঁর মৃত্যু হয়। হত্যার সাড়ে ছয় মাসের মাথায় রায় দেওয়া হলো। রায় পড়ার সময় সব আসামি আদালতে উপস্থিত ছিলেন।
রায়ে নুসরাতের পরিবার সন্তুষ্টি প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছে। বিচারক বলেছেন, ‘নারীর মর্যাদা রক্ষায় তেজোদীপ্ত আত্মত্যাগ নুসরাতকে অমরত্ব দিয়েছে।’
রায়ের পর প্রধান দুই আসামি অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলা ও নুরউদ্দিন নুসরাতের ভাইকে লক্ষ্য করে হুমকি দিয়ে বলেছেন, ‘আমাদের মৃত্যুদণ্ড হলেও আমাদের লোকজন তোদের শান্তিতে থাকতে দেবে না।’
জানা নেই, এখন পর্যন্ত কোনো হত্যা মামলার রায়ের সময় সব আসামি আদালতে হাজির ছিল কি না। এই হত্যা মামলাটি একটু ব্যতিক্রম। প্রধানমন্ত্রী অভয় দিয়েছিলেন নুসরাতের পরিবারকে, দ্রুত রায় দেওয়া হবে। এখন আমার চাওয়া, রায়টি দ্রুত কার্যকর হোক।
আসামিদের কেউ কেউ রায়ের পরে চিৎকার করে বলেছেন, তাঁরা উচ্চ আদালতে যাবেন। যেতেই পারেন। এটা মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের অধিকার।
কিন্তু প্রশ্ন হলো—যাঁরা এই আসামিদের আইনজীবী, তাঁদেরও একটু ভেবে দেখার দরকার আছে হত্যাটি কতটা বর্বরোচিত! কতটা নৃশংস! কতটা পৈশাচিক!
একজন আইনজীবী জানেন তাঁর মক্কেল খুন করেছেন, কিন্তু তার পরেও তাঁর অধিকার আছে খুনির পক্ষে শেষ পর্যন্ত আদালতে লড়ে যাওয়ার। এটা আইনসিদ্ধ ব্যাপার।
সেই আইনজীবীদের প্রতি শতভাগ সম্মান রেখে বলছি, আপনারা একটু ভাবুন, একজন মেয়ে কতটা নির্মমভাবে মৃত্যুর দিকে চলে গেল হাসপাতালের বিছানায় কাতরাতে কাতরাতে। কিভাবে তার গায়ে কেরোসিন ঢেলে দেওয়া হয়েছে!
যদি এই নুসরাত আপনার আদরের বোন হতো? কিংবা আপনার আদরের মেয়ে? আপনার মতোই কোনো এক আইনজীবী ওই হত্যাকারীদের পক্ষে লড়ে যেতেন, আপনার কেমন লাগত তখন, একটু ভাবুন।
তাই নুসরাত হত্যার রায়ের ব্যাপারে উচ্চ আদালতে যাওয়ার আগে একটু চিন্তা করুন। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ, যাদের কোনো রাজনৈতিক পরিচয় নেই, তারা এই রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছে। এই হত্যা মামলায় একজন আওয়ামী লীগ নেতাকেও মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। কোনো ধরনের জিঘাংসা থেকে রায় দেওয়া হয়নি। মানুষের মনে ব্যাপকভাবে দাগ কেটেছে এই হত্যাটি।
বিচারক বলেছেন, ‘এভাবে আগুনে পুড়িয়ে মারার ঘটনা বিশ্ববিবেককে নাড়া দিয়েছে। এই ঔদ্ধত্য কালান্তরে মানবতাকে লজ্জিত করবে নিশ্চয়ই। তাই দৃষ্টান্তমূলক কঠোরতম শাস্তিই তাদের প্রাপ্য।’
দেশের সাধারণ মানুষ চায় এই ১৬ জনের রায় দ্রুত কার্যকর হোক। তাঁরা যেন আইনের মারপ্যাঁচে কোনোভাবেই বের হয়ে যেতে না পারেন।
এই বর্বরোচিত হত্যা মামলায় যাঁদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে, সেটা যাতে দ্রুত সময়ে কার্যকর হয়ে যেতে পারে সে জন্য আইনজীবীদের মানবিক মূল্যবোধও একটি বড় ব্যাপার। আইন যেহেতু পেশা, তার পরেও তার ওপরে অবস্থান মানবিকতার।
এই মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হলে দেশে আর ও রকম অপরাধ ঘটবে না, এমনটাও আশা করা যাবে না, তবে অপরাধীরা একটু ভয় পাবে। আর সে জন্যই দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি জরুরি।
দেশের আইনজীবীদের প্রতি অনুরোধ, একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করুন। আসামিদের পক্ষে একজন আইনজীবীও রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে লড়বেন না। নুসরাতকে নিজের আদরের মেয়ে বা আদরের ছোট বোন ভেবে আসামিদের পক্ষে না গেলেই হত্যা মামলার রায় দ্রুত কার্যকর হয়ে যাবে। দেশের মানুষ জানুক আমাদের দেশের আইনজীবীরা কতটা মানবিক!
আমি চোখ বন্ধ করে ভাবতে চাই, একে একে ১৬টি লাশ ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার বা দেশের বিভিন্ন কারাগার থেকে অ্যাম্বুল্যান্সে করে ফেনীতে পৌঁছে যাচ্ছে। আগের রাতের কোনো এক সময় তাঁদের ফাঁসি কার্যকর হয়েছে।
লেখক : ছড়াকার, সাংবাদিক