দেশে ক্রমবর্ধমান হারে কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। তেমনি বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যা। এতে আক্রান্ত হচ্ছেন সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী, আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। কেউই রেহাই পাচ্ছে না বিশ্বে আতংক সৃষ্টিকারী এ মহামারী হতে। কেউ দৃঢ় মনোবল আর চিকিৎসকদের সেবায় সুস্থ হয়ে ফিরে আসছেন স্বজনদের মাঝে, আর কেউ চলে যাচ্ছেন না ফেরার দেশে।


করোনা যুদ্ধে জয়ী তেমনই এক যুবকের নাম মোহাম্মদ ইসমাইল। ঢাকার শেখ হাসিনা ন্যাশনাল বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের নিরাপত্তা প্রহরী হিসেবে দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় করোনায় আক্রান্ত হন ফেনীর পরশুরামের মির্জানগর ইউনিয়নের জয়ন্তীনগর গ্রামের এই ২২ বছর বয়সী যুবক। প্রায় একমাস এ প্রাণঘাতি ঘাতকের বিরুদ্ধে লড়াই করে সুস্থ হয়ে ফিরে এসেছেন স্বজনদের মাঝে। জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে তার সেই যুদ্ধ জয়ের গল্প, সেই উৎকণ্ঠা আর বিভীষিকাময় সময়ের গল্প তুলে ধরার হল দৈনিক ফেনী.ডটকমের পাঠকের জন্য। সাক্ষাতকার গ্রহণ করেছেন দৈনিক ফেনী.ডটকমের প্রতিবেদক তারেক চৌধুরী।


দৈনিক ফেনী.ডটকমঃ আপনি কবে থেকে অনুভব করেছেন করোনা পরীক্ষা করা প্রয়োজন? কি উপসর্গ ছিল? নমুনা সংগ্রহ থেকে ফলাফল আসা পর্যন্ত কি কি ঘটনার সম্মুখীন হয়েছেন?


ইসমাইলঃ গত ৯ এপ্রিল আমার একটু একটু শ্বাসকষ্ট ও কাশি দেখা দেয়। দ্বিতীয় দিন এগুলো বেড়ে যায় এবং শরীর অস্থির হয়ে হালকা মাথা ব্যথা শুরু হয়। মনে হচ্ছিলো খাদ্যনালীতে কি যেন বসে আছে। ঐ দিনই ফার্মেসি থেকে নাপা এক্সটেন্ড-৫০০, এজিথ্রোমাইসিন-৫০০ ও গ্যাস্টিকের ঔষুধ এনে খাই। পরদিন মুখের স্বাদ ও ঘ্রাণশক্তি চলে যায়। আমি শেখ হাসিনা বার্ন ইউনিটে থাকতাম। ঐদিন রাতে আইইডিসিআর এ যোগাযোগ করলে আমাকে বলে ঢাকা মেডিকেল তো আপনার পাশেই, ওখানে পরীক্ষা করান। রবিবার সকালবেলা একটু বমি হয়। সকাল ৯ টায় ঢাকা মেডিকেলে অনেক কষ্টে সিরিয়াল দিয়ে আইসোলেশান ওয়ার্ডে বিকাল ৫.৩০ মিনিট পযর্ন্ত বসে থাকি। রীতিগত দিনভর যুদ্ধ করে নমুনা দিয়ে আসি। ১৩ এপ্রিল বিকালে ঢাকা মেডিকেল থেকে পরিচালকের কাছ হতে কল আসে- আমার নমুনার রেজাল্ট পজিটিভ।


দৈনিক ফেনী.ডটকমঃ ফলাফল পাওয়ার পর আপনার অনুভূতি কি ছিল?


ইসমাইল: খুবই অসহায় মনে হচ্ছিলো নিজেকে। পরিবারের কোন সদস্য বা কোন একজন পরিচিত মুখছাড়া অন্যেও সামনে দাঁড়ানো রীতিমত চ্যালেঞ্জিং ছিল।


দৈনিক ফেনী.ডটকমঃ হাসপাতালে ভর্তি প্রক্রিয়া কেমন ছিল?


ইসমাইল: ফলাফল জানানোর পর বেডপত্র নিয়ে ঢাকা মেডিকেলে উপস্থিত থাকার জন্য বলল। রাতে ঐখানে গিয়ে দেখি একজন গর্ভবতী বোন, আমরা ২ জন যুবক ২ জন বয়স্ক লোকসহ ৫ জন হাসপাতালে ভর্তির জন্য অপেক্ষায়। সন্ধ্যা ৭:৩০ মিনিটের সময় এ্যাম্বুলেন্স এসে আমাদেরকে নিয়ে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে দায়িত্বরতদের হাতে রিপোর্ট দিলাম। তা দেখে তারা বলল আপনাদেরকে ভর্তি দেখানো হয়েছে কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে। পরে ঢাকা মেডিকেলের পরিচালককে ফোন দিলাম। তিনি বললেন কুয়েত মৈত্রীতে বেড খালি নাই। তোমরা অপেক্ষা কর, আমি ব্যবস্থা করতেছি, এখানে তোমাদের ভর্তি হবে।


অপেক্ষা করতে করতে রাত ১০.৩০ মিনিট হয়ে গেল। তারপর আইইডিসিআর এ কল দিলাম তারাও বলে অপেক্ষা করেন। শেষ মুহূর্তে দুইদিক থেকে শুধু আশায় দিয়ে গেল। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের একটাই কথা আপনারা কুয়েত মৈত্রী থেকে রেফার করে নিয়ে আসেন তারপর আমরা ভর্তি নেব।


একজনকে রেখে বাকী ৪ জন অসহায় হয়ে নিজেদের ৬ হাজার টাকায় একটা এ্যামুলেন্স ভাড়া করে কুয়েত মৈত্রী আসি। এখানেও কোনো সাড়া মেলেনি একদিকে মশার কামড়, অন্যদিকে ক্ষুধায় কাতর হয়ে উপায় না দেখে রাত ১২ টায় চলে যাই আবার ঢাকা মেডিকেল কলেজে। সেখান থেকে আবার রাত ২.৩০ মিনিটের কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে পাঠায়। অনেক কষ্টের পর সময় টেলিভিশনের একজন সাংবাদিক ভাইয়ের সহযোগিতায় আমরা কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি হই। এ দুঃসময়ে পাশে থাকার জন্য তার কাছে আমরা চিরকৃতজ্ঞ।


দৈনিক ফেনী.ডটকমঃ হাসপাতালে চিকিৎসা পদ্ধতি কেমন ছিল?


ইসমাইল: প্রথম তিনদিন তেমন কেউ কাছে আসতনা। এরপর থেকে নার্স, ক্লিনার এবং ডাক্তররা আসত। তাও আবার দুইজন ডাক্তার, একজন মহিলা অন্যজন পুরুষ তারা তাদের সাধ্যমত সেবা দিয়েছেন। তাঁরা সকাল ১১ টায় একবার, রাত ১১ টায় একবার সব রোগীদের দেখে শুনে উৎসাহ দিতেন। বাকি ডাক্তাররা দূর থেকে দাড়িয়ে কয়েকজনকে দেখেই পালাতেন। ১৪ দিন যারা ডিউটি করেছে, তারা আবার ১৪ দিনের জন্য কোয়ারেন্টাইনে চলে গেছে।
এরপর ২০ এপ্রিল নতুন ডাক্তার, নার্স, ক্লিনাররা আসে। তারা আগের শিফটের তুলনায় অনেক ভালো ছিল। তাদের সাধ্যমত সেবা দিয়ে গেছে এবং যাচ্ছে। শুরুর দিকে হাসপাতালের ম্যানেজমেন্ট তেমন ভালো না থাকলেও ২৫ তারিখের পর থেকে তারও অনেক উন্নতি হতে থাকে।


দৈনিক ফেনী.ডটকমঃ আপনাদের খাওয়া, ওয়াশরুম, গোসলের স্থান কেমন ছিল?


ইসমাইল: সব অনিয়মের ভিড়েও সময়মত আমাদেরকে নিয়মিত পর্যাপ্ত পরিমাণে খাবার দিয়ে যেত। সকালের নাস্তার মেনুতে চার পিস পাউরুটি, ডিম ও দুধ, দুপুর ও রাতে ভাত, ডাল, মুরগির মাংস ও সবজি থাকত। নিয়মিত একই রকমের খাবার মেনুই ছিল। ওয়াশরুম, গোসলের জায়গা চলার মত ছিল।


দৈনিক ফেনী.ডটকমঃ কোনদিন কি বিশেষ কোন অসুস্থতা অনুভব করছেন?


ইসমাইলঃ হ্যা।১৭ এপ্রিল রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে যাওয়ার পর অনুভব করি আমার পুরো শরীর কেমন যেন ঠান্ডা হয়ে একদম অচল হয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছিলো তখনই বুঝি নিঃশ্বাসটা বন্ধ হয়ে যাবে। অনেক বড় বড় স্বরে শুধু কলেমা পড়ছিলাম। পাশের বেড থেকে একজন এসে পরে হাত পা মালিশ করলে মাঝরাতে আমার মনে হল মৃত্যু থেকে যেন ফিরে আসলাম আবার।


দৈনিক ফেনী.ডটকমঃ হাসপাতালে ঔষুধ সেবনের রুটিন কেমন ছিল?


ইসমাইল: নিয়মিত দুবেলা এন্টিবায়োটিক আর নাপা দিয়ে যেত।


দৈনিক ফেনী.ডটকমঃ কত তারিখ থেকে সুস্থতা অনুভব করেছেন?


ইসমাইল: আলহামদুলিল্লাহ্। আমি ২২ তারিখ থেকে মোটামুটি সুস্থ ছিলাম। তেমন কোন উপসর্গ আর অনুভব হয়নি।


দৈনিক ফেনী.ডটকমঃ দ্বিতীয় নমুনা সংগ্রহ ও ফলাফল প্রাপ্তির ঘটনা কেমন ছিল? হাসপাতাল থেকে ছুটি পেয়েছেন কবে?


ইসমাইল: ২২ এপ্রিল হাসপাতাল থেকে নমুনা সংগ্রহের পর ২৬ তারিখ জানতে পারি ফলাফল নেগেটিভ। অনেক কষ্ট করে আইইডিসিআর এর মনিটরিংয়ের দায়িত্বে থাকা এক ডাক্তারের সহযোগীতায় ফলাফল জানতে পারি। ঐদিনই আমাকে নেগেটিভ ওয়ার্ডে নিয়ে যায়। একদিন যাওয়ার পর ডিউটি ডাক্তার ও আইইডিসিআরের দায়িত্বরত ডাক্তারকে আমাদের তৃতীয় নমুনা সংগ্রহের কথা বলি। ডিউটি ডাক্তার বলল আগামীকাল হাসপাতালের পক্ষ থেকে আপনাদের নমুনা নিয়েই ছেড়ে দেওয়া হবে। ২৮ তারিখ সকালবেলা নমুনা সংগ্রহ করে আইইডিসিআর থেকে। আমরা সবাই রেডি হয়ে বসে আছি কিন্তু একে একে ১৮ জনকে ছুটি দিল আমরা ৮ জনকে রেখে। তখন আমাদের মাথায় হতাশার ছাপ। পরেরদিন দুপুর অর্থাৎ ২৯ তারিখে আমাদেরও ছাড়পত্র প্রদান করে এবং ১৪ দিন হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকার জন্য বলে।


আর তৃতীয় পরীক্ষার ফলাফল নেগেটিভ আসলে জানানো হবেনা এবং পজেটিভ আসলে মোবাইলে যোগাযোগ করা হবে বলে জানান হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। তিনদিন পরে হাসপাতালে কল দিয়ে জানতে পারি ফলাফল নেগেটিভ। পরের দিন নিশ্চিত হওয়ার জন্য আইইডিসিআর এ কল দিয়ে আবার নিশ্চিত হই যে ফলাফল নেগেটিভ।


দৈনিক ফেনী.ডটকমঃ ছাড়পত্র পাওয়ার পর লকডাউনে ফেনী আসলেন কিভাবে?


ইসমাইল: ছাড়পত্র পাওয়ার পর সিএনজিতে যাত্রাবাড়ী পর্যন্ত আসি। ঐখান থেকে মোটর সাইকেল করে কাঁচপুর, তারপর কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট পযর্ন্ত আসি। এর মধ্যে পুলিশি বাঁধায় আটকা পড়ে প্রায় আধঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে। আমাকে বলে মাঝপথ থেকে ঢাকার দিকে ফিরে যেতে। পরে আমি করোনা আক্রান্ত হয়ে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার বিষয়টি বুঝিয়ে বলি। একথা শুনে পুলিশ ও মোটরসাইকেল চালক ঘাবড়ে যায় এবং পুলিশ আমাকে গন্তব্যে পৌঁছে দিতে চালককে নির্দেশ দেন। সে আমাকে ক্যান্টনমেন্ট পর্যন্ত নামিয়ে দিয়ে একটি কাভার্ডভ্যানে তুলে দেয়। এভাবে মহিপাল পর্যন্ত আসলে আমি নেমে যাই এবং ফেনী থেকে একটি সিএনজি নিয়ে সন্ধ্যায় ৭টার দিকে পরশুরামের নিজ বাড়িতে এসে পৌঁছাই।


দৈনিক ফেনী.ডটকমঃ বাড়িতে আসার পরে সামাজিকভাবে কোন সমস্যার মুখে পড়েছেন?


ইসমাইলঃ বাড়িতে আসার তৃতীয় দিন গ্রামের লোকজন আমি আসার বিষয়টি জানতে পেরে হট্টগোল বাঁধে। এতে গুটিকয়েক লোকছাড়া করোনা আক্রান্তের বিষয়টি কেউ জানতনা। সবাই ঢাকা ফেরত হিসেবে জানে। পরবর্তী ৮ম দিনে এসে ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে আমাদের বাড়ি আনুষ্ঠানিকভাবে লকডাউন করে।


দৈনিক ফেনী.ডটকমঃ আপনার সাথে অন্য ৪ জন কেমন আছে?


ইসমাইলঃ আমরা ৪ জন সুস্থ হয়ে ধারাবাহিকভাবে ছুটি পেয়ে বাড়িতে আছি। আর অন্য একজন ভর্তি হওয়ার পরের দিন মারা গেছেন।


দৈনিক ফেনী.ডটকমঃ এখন কেমন আছেন?


ইসমাইল: আলহামদুলিল্লাহ্। ভালো আছি আল্লাহর রহমতে। ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ঘরে ১৪ দিনের কোয়ারেন্টাইনে আছি।


দৈনিক ফেনী.ডটকমঃ করোনামুক্ত থাকতে হলে আপনার পরামর্শ কি?


ইসমাইল: শুধু একটা কথাই বলব ঘরে থাকুন, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকুন। তাহলেই নিজে বাঁচবেন। বেঁচে যাবে আপনার পরিবার। আর একটি বিষয় কখনো মনোবল হারাবেন না। আতংকিত না হয়ে নিজেকে সবসময় শক্ত রাখার চেষ্টা করবেন। আমরা জন্য সবাই দোয়া করবেন। আল্লাহপাক সকলকে যেন সুস্থ রাখে।


ইসমাইল মির্জানগর ইউনিয়নের জয়ন্তীনগর গ্রামের মোঃ মোস্তফার ছেলে। বর্তমানে বাড়িতে তার মা-বাবাসহ ৪ ভাই, ১ বোন ও দাদু রয়েছে।