পরশুরামে ধান বিক্রিতে নায্যমূল্য না পেয়ে লোকসানের মুখে পড়েছেন কৃষক। অভিযোগ রয়েছে, সিন্ডিকেটের কবলে পড়ে কৃষকরা উৎপাদিত ধানের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না। এদিকে উপজেলা প্রশাসন পরশুরাম বাজারের ধান ব্যবসায়ীদের সতর্ক করে মূল্য তালিকা তৈরি করে সে অনুযায়ী কৃষকদের থেকে ধান ক্রয় করতে নির্দেশ দিয়েছেন।

জানা গেছে, উপজেলায় ৭০-৮০ শতাংশ জমির ধান কাটা সম্পন্ন হয়েছে। কৃষকরা অভিযোগ করেছেন, ধান ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের কারণে কম দামে ধান বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন কৃষক। গত বেশকিছু দিন ধরে পরশুরাম উপজেলার বাজার ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে।

উপজেলার মির্জানগর, চিথলিয়া,বক্সমাহমুদ ও পরশুরাম পৌরসভার বাজারগুলোর খুচরা ধান ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণ করেন আবুল হাশেম। তার বেঁধে দেওয়া দামে ধান কেনেন খুচরা ব্যবসায়ীরা।

ধানের পাইকারি ব্যবসায়ী আবুল হাশেম সিন্ডিকেটের বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, এবার ধানে ভূষি বেশি। কুমিল্লা, হবিগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন মিলে ধান বিক্রি করি। তারা যে দামে আমাদের থেকে ধান ক্রয় করেন, প্রতিমনে ১০-২০ টাকা লাভে বিক্রি করি। এখন কৃষক থেকে ধান ক্রয় করে বিক্রি করতে পারছি না। মিল মালিকরা ধান নিতে চাচ্ছে না।

তিনি বলেন, পরশুরাম, ফুলগাজী, ছাগলনাইয়া ও ফেনীতে একই দামে ধান কেনা হচ্ছে। আমাদের ব্যবসায়ীদের মধ্যে কোন সিন্ডিকেট নেই।

অভিযোগ রয়েছে, সারাদেশে মিল ও চাতাল মালিকরা সিন্ডিকেট করে কম দাম ধান ক্রয়ে পাইকারদের বাধ্য করছেন। যার কারণে ধান বিক্রিতে নায্যমূল্য পাচ্ছেন না কৃষক।

গত শনিবার বিকালে পরশুরাম বাজারের ধানের পাইকারি ক্রেতা আবুল হাশেম ও মো সফিউল্লাকে ডেকে ধান ক্রয়ে কৃষককে নায্যমূল্য প্রদান ও মূল্য তালিকা টানানোর নির্দেশ দিয়েছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আরিফুর রহমান।

কৃষকরা জানিয়েছেন, এবার নানা ধরনের সিন্ডিকেট ও আর্থিক সংকটে পড়ে জমি থেকে ধান কাটার সঙ্গে সঙ্গেই তা বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। বর্তমানে তারা বোরো ধান প্রতিমণ ৯৫০ থেকে ১ হাজার টাকায় বিক্রি করছেন, অথচ উৎপাদন খরচ ৯০০ টাকার বেশি। তারা জানান, যদি ধান দেখেশুনে ও সঠিক সময়ে বিক্রি করতে পারতেন, তাহলে আর্থিকভাবে লাভবান হতেন কিন্তু সিন্ডিকেটের চাপে এখন ন্যায্যদাম থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

কৃষি অফিসের তথ্যানুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে উপজেলার ৩টি ইউনিয়ন ও পৌরসভায় ৩ হাজার ২৫০ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ করা হয়েছে। এরমধ্যে মির্জানগর ইউনিয়নে ১ হাজার ৯০ হেক্টর, চিথলিয়া ইউনিয়নে ৯০০ হেক্টর, বক্সমাহমুদ ইউনিয়নে ৫৩৬ হেক্টর ও পরশুরাম পৌরসভায় ৭২৪ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ করা হয়। ২০২৪ সালের আগস্ট মাসের ভয়াবহ বন্যায় চিথলিয়ার শালধর, পশ্চিম অলকা, পূর্ব অলকা, মির্জানগর ইউনিয়নে বল্লামুখার ভাঙনে নিজকালিকাপুর, কাশিনগরসহ কয়েকটি স্থানের জমিতে বালু জমে থাকায় প্রায় ৮০ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ করা সম্ভব হয়নি।

পৌরসভার উত্তর কোলাপাড়া গ্রামের কৃষক মো মিজান বলেন, ‘এবার বোরো ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। তবে সিন্ডিকেটের কারণে ন্যায্য দাম পাচ্ছি না। উৎপাদনে প্রতি মণে ৯০০ টাকার বেশি খরচ হলেও ৯৫০ থেকে ১ হাজার টাকায় ধান বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছি।’

বক্সমাহমুদ ইউনিয়নের দক্ষিণ গুথুমা গ্রামের কৃষক আলমগীর হোসেন জানান, ‘আর্থিক সংকটে পড়ে ধার-দেনা করে বোরো আবাদ করেছি। ফলনও ভালো হয়েছে। কিন্তু ফসল কেটে পাওনা টাকা দিতে বাধ্য হয়ে ৯৫০ টাকা মণ দরে ধান বিক্রি করেছি।



সরকারি গুদামে ধান বেচতে অনাগ্রহ
নানা জটিলতার কারণে অনেক কৃষক সরকারি গুদামে ধান দিতে আগ্রহ হারাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন একাধিক কৃষক।

বাউরপাথর গ্রামের কৃষক জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘সরকারি গুদামে ধান বিক্রি করতে হলে রেজিস্ট্রেশন করতে হয়, ধান দেখাতে হয়, তাদের পছন্দ হলে মাপজোখ করে তারপর টাকা পাওয়া যায়। অথচ আমাদের ওপর দেনার চাপ থাকে, টাকার দরকার পড়ে তখনই। তাই বাধ্য হয়ে কম দামে ধান বিক্রি করছি।’

উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক এসএম নুর উদ্দিন বলেন, খাদ্য বিভাগ ২৪ এপ্রিল থেকে সরকারিভাবে বোরো ধান ক্রয় শুরু করেছে। প্রতি মণ ধান ১ হাজার ৪৪০ টাকা দরে কেনা হচ্ছে। শনিবার (১০ মে) পর্যন্ত ৪০ মেট্রিক টন ধান ক্রয় করা হয়েছে। বোরো ধান ক্রয়ের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে ২০০ মেট্রিক টন।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আরিফুর রহমান বলেন, মির্জানগর ইউনিয়নে ৪৯৯জন, চিথলিয়া ইউনিয়নে ৩৪২ জন, বক্সমাহমুদ ইউনিয়নে ৪২০ জন ও পরশুরাম পৌরসভায় ৪৪৯জন কৃষক লটারির মাধ্যমে সরকারের কাছে ন্যায্যদামে ধান বিক্রির সুযোগ পাচ্ছেন। সরকারি গুদামে ধান বিক্রিতে কৃষকদের উৎসাহিত করতে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে মাইকিং করা হচ্ছে।