পরশুরামের ৫০ শয্যা বিশিষ্ট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স প্রায় ২ লাখ মানুষের চিকিৎসায় ভরসাস্থল। হাসপাতালটিতে চিকিৎসক, নার্স ও কর্মচারি সংকটে জেরবার স্বাস্থ্যসেবা। এতে সেবাবঞ্চিত হচ্ছেন সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে প্রান্তিক জনগোষ্ঠি।
হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, হাসপাতালে ইউএইচ এন্ড এফপিও, আরএমও, কনসালটেন্ট ও চিকিৎসা কর্মকর্তাসহ ২১ জন চিকিৎসকের পদ থাকলেও বর্তমানে সেখানে চিকিৎসক রয়েছেন মাত্র ৮ জন। তাদের মধ্যে দুজনকে অ্যাটাচমেন্টে অন্যস্থানে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। চিকিৎসকের ২১টি পদের মধ্যে ১৩টি পদই শূন্য। সার্জারি, অর্থোপেডিক্স, চক্ষু, ইএনটি ও কার্ডিওলজি বিভাগের জুনিয়র কনসালট্যান্টের ৫টি পদে চিকিৎসক নেই। এনেস্থটিস্ট ১ জন, মেডিকেল অফিসার ১ জন, মেডিকেল অফিসার (অল্টারনেট মেডিসিন কেয়ার) ১ জন, নার্স ৫ জন ও ৩ জন মিডওয়াইফের পদ শূন্য রয়েছে। এছাড়া ল্যাব এটেনডেন্টর ১টি, অফিস সহায়কের ৩টি, ইমার্জেন্সি এটেনডেন্টের ১টি, আয়ার ২টি, ওয়ার্ড বয়ের ২টি, বাবুর্চির ৩টি, নিরাপত্তা প্রহরীর ৩টি, মালির ১টি ও পরিচ্ছন্নতা কর্মীর ৫টি পদে জনবল নেই।
সম্প্রতি সরেজমিনে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়ে দেখা যায়, বহিঃবিভাগে তিনজন চিকিৎসক রোগি দেখছেন। প্রত্যেক চিকিৎসকের চেম্বারের সামনে রোগিদের ভীড়। আবাসিক স্বাস্থ্য কর্মকর্তা (আরএমও) ডাঃ ইফতেখার হাসান ভূঁইয়ার চেম্বারের বাইরে প্রায় ৩০ জন রোগী ভীড় করছেন। তিনি বলেন, বহিঃবিভাগে গড়ে ৩৫০-৪০০ রোগীকে চিকিৎসা সেবা দেওয়া হয়। গ্রীষ্মকালে চিকিৎসা সেবা নেন ৫০০-৬০০ রোগী।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের এক কর্মকর্তা বলেন, হাসপাতালে চিকিৎসকের সংকট ব্যাপক। দুইজন মেডিকেল অফিসার ডা. মাহফুজুল হক চৌধুরী ও ডা. ফারজানা ইয়াসমিনকে অ্যাটাচমেন্টে ও জুনিয়র কনসালটেন্ট ডাঃ শ্রীবাস পালকে প্রেষণে ঢাকায় দায়িত্ব দিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এছাড়া হাসপাতালের ওটি এটেনডেন্ট নুরুল করিম ফুলগাজীতে ও ক্যাশিয়ার লাভলী আক্তারকে ফেনী সদরে অ্যাটাচমেন্টে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। যে কয়জন চিকিৎসক রয়েছেন তারা রোগীদের আন্তরিকতার সঙ্গে সেবা দিতে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছেন। দ্রুত অ্যাটাচমেন্টে থাকা ওই দুই চিকিৎসককে ফিরিয়ে আনা ও শুন্য পদে চিকিৎসকসহ জনবল নিয়োগ দেওয়া হলে সেবার মান আরও বাড়বে। হাসপাতালের পুরুষ ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায়, দেয়ালের রং উঠে জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছে।
সেখানে গিয়ে দেখা গেছে, বিছানাপত্র অপরিস্কার হয়ে তেল চিটচিটে হয়ে আছে। টয়লেটে কোন লাইট নেই। পুরুষ ও মহিলা ওয়ার্ডের টয়লেটগুলো অপরিস্কার। হাসপাতালের চারপাশে ড্রেনেজ ব্যবস্থা থাকলেও ড্রেনে পানি ও পাতা জমে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে।
হাসপাতালের জরুরি বিভাগের ইনচার্জ দেবব্রত গোস্বামী জানান, জরুরি বিভাগে জনবল নেই। নিজে একাই সব কাজ করতে হয়। দূর্ঘটনায় আহত বা কাটছেঁড়া রোগি ও বিষখাওয়া রোগি সামলাতে কষ্ট হয়। একজনের পক্ষে একসাথে দুইজন রোগি দেখা সম্ভব না।
জানা যায়, হাসপাতালে অপারেশন থিয়েটার থাকলেও সেটি প্রায় অকেজো। এখানে ডিজিটাল কোনো এক্সরে মেশিন নেই। এনালগ সিস্টেমের একটি এক্সরে মেশিন থাকলেও সেটি দিয়ে চেস্ট (বুক) পরীক্ষা ছাড়া অন্য কোন পরীক্ষা করা যায় না। ডিজিটাল এক্স-রে মেশিনটি চালু করার আগেই বাক্সে অচল হয়ে পড়ে আছে। একটি আল্ট্রাসোনোগ্রাফি মেশিন সচল রয়েছে। হাসপাতাল সূত্র জানিয়েছে, ২০২৪ সালে ১৫টি সিজার অপারেশন (২৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত) হাসপাতালে করা হয়েছে।
শরীর ব্যথা নিয়ে চিকিৎসা নিতে আসেন সলিয়া গ্রামের মাইনুর আক্তার (৫০)। তাঁকে ডায়গনস্টিক সেন্টার থেকে এক্স-রে ও অন্যান্য পরীক্ষা করতে হয়েছে। তিনি বলেন, টাকার অভাবে সরকারি হাসপাতালে ডাক্তার দেখাতে আসি। সরকারিভাবে ডাক্তার দেখালেও অতিরিক্ত অর্থের বিনিময়ে পরীক্ষা করাতে হয়েছে বাইরের ডায়গনস্টিক সেন্টারে। কর্তৃপক্ষের কাছে দ্রুত হাসপাতালের ডিজিটাল এক্স-রে চালু করার দাবি জানান তিনি।
এনসিডি কন্ট্রোল প্রোগ্রামের আওতায় হাসপাতালে এনসিডি কর্নার চালু আছে। এখানে ডায়বেটিস, উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদরোগে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা ও বিনামূল্যে ঔষধ প্রদান করা হতো। এখন ডায়াবেটিস, হার্ট ও পেশারের ওষুধ এবং ইনজেকশন নেই। এন্টিবায়োটিক ওষুধ কিনে নিতে হচ্ছে রোগিদের। উত্তর কোলাপাড়া গ্রামের বেলাল হোসেন (৪৫) হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর জানতে পারেন তিনি নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত। তিনি বলেন,প্যারাসিটেমল বাইরে থিকে কিনতে হচ্ছে। কুকুরে কামড়ানো জলাতঙ্ক রোগিদের এন্টি রাবিস ভ্যাকসিন মজুদ নেই হাসপাতালে। তবে সাপে কামড়ানো রোগিদের প্রতিষেধক এন্টিভেনম পর্যাপ্ত রয়েছে বলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে।
সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন’র পরশুরাম উপজেলা কমিটির সভাপতি ইউসুফ বকুল জানান, চিকিৎসাসেবা প্রান্তিক মানুষের কাছে পৌঁছাতে হলে হাসপাতালে দ্রুত চিকিৎসক ও জনবল নিয়োগ দিতে হবে। প্রয়োজনীয় ওষুধ পত্রের সরবরাহ বাড়াতে হবে। চিকিৎসক ও সংশ্লিষ্টদের আরো বেশি আন্তরিক হতে হবে।
হাসপাতালের কয়েকজন কর্মচারীর দাবি, নিরাপত্তা প্রহরী না থাকায় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এলাকাটি অনিরাপদ। উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকতা বসবাসের কোন বাংলো নেই। ডাক্তার কোয়ার্টার জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছে। অপর একটি ডাক্তার কোয়ার্টার ও স্টাফ কোয়ার্টার বসবাসের অযোগ্য। চলতি বছরে ডাক্তার ও স্টাফ কোয়ার্টারে বেশ কয়েকবার চুরির ঘটনা ঘটেছে। এতে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সরকারি কোয়ার্টারে বাস করা চিকিৎসক, নার্স এবং কর্মচারীরা। তারা জানান, দীর্ঘদিন ধরেই নোংরা, অপরিচ্ছন্ন ও চারপাশে ময়লা আবর্জনায় কোয়ার্টার ও হাসপাতালটি বেহাল। ফলে খুব সহজেই ডেঙ্গু মশার উৎপত্তি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার-পরিকল্পনা কর্মকর্তা (ইউএইচ এন্ড এফপিও) ডা. নাজমুল হাসান রাজু চিকিৎসক ও জনবল সংকটের বিষয় স্বীকার করে বলেন, চাহিদা অনুযায়ী জনবল নিয়োগ দিতে সিভিল সার্জন অফিসে বেশ কয়েকবার চিঠি দেওয়া হয়েছে। হাসপাতালে ওষুধ ঘাটতি কবে পূরণ হবে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এনসিডি কর্নার থেকে রোগিদের ওষুধ সরবরাহ করা হয়। ওষুধ শেষ হয়ে গেছে। নতুনভাবে ওষুধ সরবরাহের জন্য চিঠি দেওয়া হয়েছে।
- সর্বশেষ
- ফেনী জেলা
- শিক্ষাঙ্গন
- অন্যান্য
- আইন আদালত
- খেলাধুলা
- শিল্প ও সাহিত্য
- অর্থনীতি
- রাজনীতি
- জাতীয়
- ফেনী জেলা
- রাজনীতি
- ফটো গ্যালারী
- ফেনী জেলা
- চাকরির খবর
- ফটো গ্যালারী
- ধর্ম
- মুক্ত কলাম
- শিল্প ও সাহিত্য
- খেলাধুলা
- শিক্ষাঙ্গন