এ অন্য আরেক জীবনের গল্প। একদিকে করোনার ভয়াল আগ্রাসন, অন্যদিকে ক্ষুধার অন্বেষণ। দুজন মানুষ দিকভ্রান্ত, উদভ্রান্ত হয়ে ঘুরছিলেন পথে পথে। তারা ছিল পরিবার, সমাজ, আত্মীয় স্বজন থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন। ঘুরতে ঘুরতে আশ্রয় নিয়েছিল পরশুরাম বাজারে।


সেখানে তাদের সাথে দেখা হল এ গল্পের নায়ক পরশুরাম উপজেলা যুবলীগের সভাপতি মোঃ ইয়াছিন শরীফ মজুমদারের সাথে। যিনি এ দুর্যোগকালীন সময়ে রাতের বেলা বাজারে ঘুরে ঘুরে গত ২০ দিন ধরে ‘ভালোবাসা’র আহার খাবার বিলি করছিলেন ছিন্নমূল ভাসমান মানুষদের জন্য।


সেই সূত্র ধরে তাদের পরিচয় হল, একজনের নাম বাতাসী বেগম (৩৫) অন্যজনের নাম আবদুর রহিম (৫৫)। দুজনেই ছিলেন মানসিক ভারসাম্যহীন, নাম ঠিকানাবিহীন। কিন্তু গল্প শেষে দুজনেই ফিরে গেলেন আপন ঠিকানায়, পরিবার পরিজনের মাঝে। কি করে? সেই গল্প বলছেন এ গল্পের নায়ক স্বয়ং নিজেই।


ইয়াছিন শরীফ মজুমদার বলেন, করোনাকালীন দুর্যোগে ভাসমান মানুষের জন্য ‘ভালোবাসার আহার’র ব্যবস্থা করেছিলেন ফেনী সদর আসনের মাননীয় সংসদ সদস্য নিজাম উদ্দিন হাজারী মহোদয়। ফেনীর সামাজিক সংগঠন সহায় এর তত্বাবধানে গত ২০ দিন ধরে পরশুরাম বাজারে ভবঘুরে মানুষের হাতে আমরা রাতের খাবার বিলি করে যাচ্ছি।


তিনি বলেন, সেই সূত্র ধরেই ওইসব ভাসমান মানুষদের কাছে যাবার সুযোগ হয় আমার। প্রথম প্রথম তারা বেশ প্রতিক্রিয়া দেখালে ৪/৫ দিন পরে ঘনিষ্ঠ হতে শুরু করলেও নাম ঠিকানা কিছুই বলতো না। এরপর আস্তে আস্তে আমার উপর তাদের বিশ্বাস জন্মে। নাম ঠিকানা সব খুলে বলে। তাদের বলা নাম ও ঠিকানাসহ তাদের ছবি দিয়ে আমার ফেইসবুক আইডিতে পোস্ট করি।


সেই পোস্ট চোখে পড়লে তাদের আত্মীয় স্বজনরা আমার সাথে যোগাযোগ শুরু করেন। গত তিনদিন আগে তুলি ভৌমিক নামে একজন ভদ্রমহিলা আমার ম্যাসেঞ্জারে নক করে বাতাসীর পরিবারের বিস্তারিত জানান এবং তার মায়ের মোবাইল নাম্বার দেন আমাকে। তার মায়ের মোবাইলে ফোন দিয়ে জানতে পারি তার বাড়ি নোয়াখালী জেলার বেগমগঞ্জ উপজেলার এখলাসপুর ইউনিয়নে। গত শুক্রবার পরশুরাম এম্বুলেন্স সার্ভিসের সত্ত্বাধীকারী মেহেদী হাসানা বাবুর সহযোগিতায় একটি এ্যাম্বুলেন্সে করে বাতাসী বেগমকে পৌঁছে দিলাম তার মা ও ভাইয়ের কাছে।


অন্যদিকে শনিবার দিবাগত রাত ৪টার দিকে আবদুর রহিম ভাইয়ের এক আত্মীয় আমাকে ফোন করে তার বিস্তারিত আমাকে জানান। আমি তার ভাইয়ের নাম্বার নিয়ে ফোন করে রবিবার পরশুরাম আসতে বলি। শনিবার তার বোন ও ভগ্নিপতি এসে তাকে নিয়ে গেছেন। পরশুরাম উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান কামাল উদ্দিন মজুমদার, ইউএনও ইয়াছমিন আক্তার ও সহকারি কমিশনার (ভূমি) নু এমং মারমার উপস্থিতিতে উনাকে তাদের হাতে তুলে দেই। তার বাড়ি চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলায়।


গল্প শেষে ইয়াছিন শরীফ মজুমদার বলেন, সত্যিই এ অনূভুতি ভাষায় প্রকাশ করার মত নয়। একজন পরিবারহারা, ঘরহারা মানুষকে তার পরিবারের কাছে তুলে দিতে পেরে নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করছি। তিনি বলেন, বাকি যারা আছেন তাদের পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেবার চেষ্টা করছি।


পরশুরামে করোনাকালের শুরু থেকেই বিভিন্ন কার্যক্রমমে যুক্ত আছে ইয়াছিন ও তার দলের সদস্যরা। পরশুরামে ১০জনের দল গড়ে করোনায় মৃতদেহ দাফনের দায়িত্ব নিয়েছেন নিজের কাঁধে। সংকট শুরু থেকেই তারা পরিচ্ছন্নতা বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টিতে কাজ করেন ও নানা সামগ্রী বিলি করেছেন।


উপজেলা যুবলীগের সভাপতির দায়িত্ব ছাড়াও তিনি উপজেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক হিসেবেও কাজ করছেন। আবার সামাজিক-সমবায় সংগঠন ‘বন্ধুর বন্ধনে’র সাথেও যুক্ত তিনি।


পরশুরাম উপজেলা পরিষদ ক্যাম্পাসের কামাল চেয়ারম্যান বাড়ির ছেলে ইয়াছিন। পিতা রফিকুল ইসলাম মজুমদার, মাতা আনোয়ারা বেগম। এক ভাই তিন বোনের মাঝে তিনি মেজো। স্ত্রী নাজিয়া সুলতানা আনিকাকে নিয়ে তার ছোট্ট সংসার।