করোনাকালে বন্দী জীবনে হাঁপিয়ে উঠছেন অনেকে। অবারিত সবুজের প্রান্তঘেরা সুবিশাল আকাশ আর মুক্ত বাতাসে সজীব নিঃশ্বাস নিতে চাইছে মন। করোনার পরে সেই ক্লান্ত জীবনের একঘেঁয়েমি আর অবসাদ দূর করতে ঘুরে আসুন পরশুরামের মির্জানগরের ইউনিয়নের জয়ন্তীনগর-বীরচন্দ্র নগর গ্রামে অবস্থিত রাবার বাগান। ব্যক্তি উদ্যোগে গড়ে ওঠা এ রাবার বাগানটির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও প্রক্রিয়াজাতকরণের দৃশ্য দেখে যে কেউ অভিভুত হবে।


বাগাননের মালিক সত্যনগর গ্রামের ব্যবসায়ি হাজী মোঃ মোস্তাফা জানান, ২০০৯ সালে ২০ একর জমিতে ১০ হাজার রাবার চারা রোপণ করেছিলাম। বর্তমানে বাগান হতে বাণিজ্যিকভাবে রাবার উৎপাদন কার্যক্রম পরিচালিত করা হচ্ছে। রাবার সংগ্রহের জন্য গাছ উপযুক্ত হতে সময় লেগেছে দশ বছর।

বাগানের তদারকিতে নিয়োজিত সাইমুন মারমা বলেন, এখন চার হাজার গাছ থেকে কষ সংগ্রহ করা হচ্ছে। পর্যায়ক্রমে সবগুলো গাছ থেকে রাবার সংগ্রহ শুরু হবে। রাবার প্রক্রিয়াজাতকরণ কাজে বর্তমানে ১২ জন শ্রমিক কাজ করছে।


তিনি বলেন, অক্টোবর-জানুয়ারি চার মাস রাবার উৎপাদন বেশ ভালো হয়। শীতের তুলনায় বর্ষায় কম রাবার উৎপাদিত হয়।


রাবার উৎপাদনের পদ্ধতি সম্পর্কে সাইমুন বলেন, বাগান থেকে কষ এনে শুকনো রাবার শিটে পরিণত করে তা রোলার মেশিনের সাহায্যে পানি বের করা হয়। এরপর ড্রিপিং শেডে শুকিয়ে পোড়ানো হয়। তিনি বলেন, একটি গাছ থেকে দৈনিক প্রায় ৩০০-৪৫০ গ্রাম রাবার পাওয়া যাচ্ছে। বাজার দর অনুযায়ী প্রতি লিটার রাবার ১৫০-২০০ টাকায় বিক্রি করা যায় কিন্তু তা বর্তমানে কমে ১২০-১৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। একটি রাবার গাছ ৩৫ বছর পর্যন্ত বাণিজ্যিকভাবে রাবার উৎপাদন করা যায়।


স্বত্বাধিকারী হাজী মোস্তফা বলেন, বর্তমানে মাসিক দেড় লক্ষ টাকা খরচ হলেও তেমন লাভ হচ্ছেনা। পুরোদমে রাবার সংগ্রহ শুরু হলে আশা করি একটি ভালো অবস্থানে দাঁড়ানো সম্ভব হবে। তিনি বলেন, চট্টগ্রামের মেসার্স আরিফ এন্টারপ্রাইজ ইতোমধ্যে বাগান থেকে রাবার ক্রয় করছে।


মির্জানগর ইউপি চেয়ারম্যান ও হাজী মোস্তফার ছেলে নুরুজ্জামান ভুট্টু বলেন, বিগত কয়েক বছরে আমাদের বাগানটি পিকনিক স্পট হিসেবে জেলা এবং জেলার বাইরের অনেক মানুষের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। ভবিষ্যতে এখানে শিশুদের জন্য একটি পার্ক করার পরিকল্পনার কথা জানান তিনি। এখানে যাতায়াত সুবিধাসহ পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে কর্মচারীদের সার্বক্ষণিক নজরদারি রয়েছে বলে জানানা তিনি।


চেয়ারম্যান বলেন, চাইলে যে কেউ এখানে ঘুরতে আসতে পারে। এটি সবার জন্য উম্মুক্ত। তবে বাগানে প্রবেশ করতে হলে শর্ত একটাই, কোন প্রকার ম্যাচ বা আগুন উৎপন্নকারী দ্রব্য নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করা যাবে না।


স্থানীয় বাসিন্দা বাহার উদ্দিন বলেন, বাগানের কষ সংগ্রহের কাজে প্রথমদিকে কক্সবাজার রামুর কর্মচারীরা কাজ করত। কিন্তু এখন আমাদের স্থানীয় লোকজনই এ কাজ করছে। এতে গ্রামের বেকার জনগোষ্ঠীদের কর্মসংস্থানের ব্যাপক সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে।


রাবার ছাড়াও বাগানের মাঝখানে মাছ চাষ, স্বল্প পরিসরে আম ও লিচু উৎপাদন করা হচ্ছে।


বাগান পরিদর্শনে আসা হাসিব নামে এক পর্যটক বলেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে রাবার বাগানের কিছু চিত্র দেখে আর লোভ সামলাতে পারিনি। এখানে সারিবদ্ধ গাছ, রাবার প্রক্রিয়াজাতকরণের দৃশ্য, কাছ থেকে ভারত সীমান্তের দৃশ্য ও প্রাকৃতিক সজীবতা আামাকে মুগ্ধ করেছে। তবে যাতায়াতের একমাত্র সড়কটির খারাপ থাকায় দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।


আরেকজন পর্যটক বলেন, বিনামূল্যে কোন ধরনের টিকেট ছাড়াই আমি পরিবার নিয়ে এখানে প্রবেশ করতে পেরেছি। তবে এখানে যদি খাওয়ার জন্য কোন ব্যবস্থা থাকত তাহলে আমাদের আরও সুবিধা হত।


বন বিভাগের বিলোনিয়া বিটের আবু তাহের নামের এক কর্মকর্তা বলেন, রাবার গাছ ঘর থেকে বিষাক্ত ফরমালডিহাইড দূর করতে সবচেয়ে বেশি কার্যকরী। এছাড়াও অন্যান্য কেমিক্যাল যেমন কার্বন মনোক্সাইড, ট্রাই ক্লোরো ইথিলিন দূর করতেও এই গাছ ভূমিকা রাখে।


পরশুরাম উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোঃ কামরুজ্জামান বলেন, বর্তমান বিশ্বে রাবার একটি সম্ভাবনাময় শিল্পের স্থান দখল করছে। তিনি বলেন, বারার উৎপাদনের উপযুক্ত পরিবেশ বিবেচনায় পাহাড় বা উচুঁ স্থান যেখান থেকে বৃষ্টির পানি সহজে নেমে যেতে পারে তা বেশি উপযোগী। সে হিসেবে উপজেলার সীমান্তবর্তী জয়ন্তীনগর গ্রামে গড়া উঠা বাগানটিও উচুঁ ছোট পাহাড়ি স্থান যা রাবার উৎপাদের উপযুক্ত ক্ষেত্র।


স্থানীয় কেউ রাবার উৎপাদন করতে চাইলে উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে সব ধরনের প্রযুক্তিগত ও পদ্ধতিগত সহায়তা দেওয়া হবে বলেও জানান কৃষি কর্মকর্তা।


  • যেভাবে যাবেন রাবার বাগানে
    ফেনী শহরের হাসপাতাল মোড় হতে সিএনজি বা বাসযোগে পরশুরাম। এতে সিএনজি ৩৫ ও বাসযোগে আসলে ২৫ টাকা যাতায়াত খরচ। পরশুরাম উপজেলা গেইটের সামনে থেকে সিএনজিতে ১৫ টাকা ভাড়ায় সুবার বাজার। তারপর সুবার বাজার থেকে সিএনজি বা অটোরিক্সায় ২০ টাকা যাতায়াত খরচে জনপ্রতি মোট ৬৫/৭৫ টাকা ব্যয়েই পরিবার পরিজন নিয়ে রাবার বাগানের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর মনোরম দৃশ্য উপভোগ করা সম্ভব।

  • থাকা এবং খাওয়াঃ
    বাগানে এখনো থাকা এবং খাওয়ার তেমন কোন ব্যবস্থা নেই। তবে ফেনী থেকে একদিনের মধ্যেই বাগান ঘুরে আসা সম্ভব। সেক্ষেত্রে সাথে করে খাবার নিয়ে গেলে সমস্যা হবে না।