ফেনী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের অধ্যক্ষের উপর হামলার ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় শিক্ষক-কর্মকর্তা কর্মবিরতি, কালো ব্যাজ ধারণ করে প্রতিবাদ চলছে।
অধ্যক্ষ মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান খান জানান, কয়েকজন কর্মচারীকে দায়িত্বে অবহেলায় শো-কজ প্রদান ও একজন কর্মচারীর আবাসন বরাদ্দ বাতিল করায় ক্ষুব্ধ হয়ে তারা এ হামলার ঘটনা ঘটায়। এ ঘটনায় ৬ এপ্রিল ৯ জনকে আসামী করে ফেনী মডেল থানায় মামলা করা হয়েছে। ঘটনার ৫ দিনেও কাউকে আটক করা হয় নি। এ প্রসঙ্গে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ফেনী মডেল থানার এসআই জালাল উদ্দিন দৈনিক ফেনীকে জানান, সরকার কমর্কর্তা-কর্মচারীকে গ্রেফতারে কিছু আইনকানুন রয়েছে। ঘটনার তদন্ত চলছে। তদন্ত শেষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
অধ্যক্ষ জানান, প্রতিষ্ঠানের পরিচ্ছন্নতা কর্মী সঞ্জীব হরিজন দীর্ঘদিন ধরে দায়িত্ব অবহেলা করে আসছিলো। বহুবার বলেও তাকে সংশোধন করা না গেলে গত রবিবার (৪ এপ্রিল) শাস্তিস্বরূপ তার আবাসন বরাদ্দ বাতিল করা হয়। পরদিন অফিসে গেলে সকাল আনুমানিক ১১ টার দিকে সঞ্জীব হরিজন, দিলীপ কান্তি চাকমা, মোঃ আবুল হোসেন ও মোঃ মোস্তফা কামালসহ ৮/৯ জন কর্মচারী আমাকে প্রশাসনিক ভবনের সামনে ঘিরে ধরে। এসময় তারা আমাকে অবরুদ্ধ করে সঞ্জীবের আবাসন বরাদ্দ ফিরিয়ে দিতে বলে এবং অকথ্য ভাষায় গালিগালাজসহ হুমকি প্রদান করে। এক পর্যায়ে তারা আমার গায়ে চড়াও হয়ে আমার জামা-কাপড় টানা হেঁচড়া করে আমাকে লাঞ্ছিত করে। শোর চিৎকার শুনে আমার কয়েকজন সহকর্মী শিক্ষক আমাকে তাদের হাত থেকে উদ্ধার করে।
এ ব্যাপারে কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বরাবরে অভিযোগ করেছেন পলিটেকনিক অধ্যক্ষ।
এ ব্যাপারে কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোঃ হেলাল উদ্দিন দৈনিক ফেনীকে জানান, ঘটনাটি জানতে পেরেছি। বিষয়টি তদন্ত করার জন্য ফেনী জেলা প্রশাসককে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তদন্ত রিপোর্ট হাতে এলে কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তর যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। কত দিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়া হবে জানতে চাইলে তিনি জানাতে পারেন নি। এখন পর্যন্ত কোন ব্যবস্থা না নেয়া বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে তিনি স্পষ্ট কোন উত্তর না দিয়ে ফোন রেখে দেন।
মামলার প্রধান আসামী পরিচ্ছন্নতাকর্মী হরিজন জানায়, অধ্যক্ষ অন্যায়ভাবে আমার আবাসন বরাদ্দ বাতিল করে দেন। ঘটনার দিন কোন কারণ ছাড়াই আমার গায়ে হাত তুলেন। বিষয়টি আমার সহকর্মীরা জানতে পেরে অধ্যক্ষ স্যারের কথা বলতে চাইলে তিনি সেখানেও আমাকে মারতে উদ্যত হন। আমার এক সহকর্মী দিলীপ কান্তি চাকমা প্রতিবাদ করলে তাকেও জুতা দিয়ে মারতে যান ও গালিগালাজ করেন। আমাদের মারতে এলে আমরা তা প্রতিহত করি।
আরেক অভিযুক্ত দিলীপ কান্তি চাকমা বলেন, কোন কারণ ছাড়াই সঞ্জিবকে শাস্তি দেয়ার বিষয়ে কথা বলতে গেলে অধ্যক্ষ আমাকে জুতাপেটা করেন। আমরা অধ্যক্ষকে মারিনি শুধু প্রতিহত করেছি।
তবে এমন অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে অধ্যক্ষ বলেন, প্রশাসনিক প্রধান হিসেবে নিয়ম শৃঙ্খলা বজায় রাখতে কঠোরতায় স্বীয় পদের সীমালঙ্ঘন করিনি।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টের প্রধান মোঃ আক্তারুজ্জান জানান, অধ্যক্ষের গায়ে কর্মচারীদের হাত তোলার ঘটনা আর কোন প্রতিষ্ঠানে ঘটেনি। যা আমাদের সকল শিক্ষকের জন্য লজ্জাজনক বিষয়। কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তর চাইলে তাৎক্ষণিকভাবে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারতো। পরে না হয় তদন্ত করে শাস্তি দেয়া যেতো। কিন্তু কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তর কোন ব্যবস্থা গ্রহণ না করে কেবল তদন্ত কমিটি করে দায়িত্ব পালন করেছেন। এমন ঘটনার পর শিক্ষকদের সম্মান কতটা নিচে নেমেছে তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়।
অপর প্রত্যক্ষদর্শী ইনস্টিটিউটের শিক্ষক রফিক আহমদ জানান, শোরগোল শুনে বাইরে গিয়ে দেখি অধ্যক্ষ মহোদয়কে ৮/৯ জন কর্মচারী ঘিরে রেখেছেন। কয়েকজন ওনাকে ধরে রেখেছেন। আমি তাৎক্ষণিক ছুটে গিয়ে তাদের হাত থেকে অধ্যক্ষকে উদ্ধার করি। অধ্যক্ষকে উদ্ধার করতে গিয়ে আমার গায়েও কিল-ঘুষি লাগে। এ ধরনের ঘটনায় আমরা শিক্ষকরা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেছি, প্রতিবাদের ভাষা হারিয়ে ফেলেছি।
নিজাম উদ্দিন নামের আরেক শিক্ষক বলেন, অধ্যক্ষকে লাঞ্ছিত করে যদি দোষীরা পার পেয়ে যায় তাহলে এ ধরনের ঘটনা ভবিষ্যতে যে কোন শিক্ষকের সাথে ঘটাতে তারা দ্বিতীয়বার ভাববে না।
মেকানিক্যাল টেকনোলজি বিভাগের জুনিয়র ইন্সট্রাক্টর হযরত আলী বলেন, একজন সৎ ও কর্মপ্রিয় মানুষের সাথে এমন অপ্রীতিকর ঘটনা মেনে নেয়া যায় না। এর নিন্দা ও কঠোর বিচার দাবি জানান তিনি।
শিক্ষকদের প্রতিবাদ চলছে
কর্মচারীদের হাতে অধ্যক্ষ লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন ফেনী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষক সংগঠনের নেতারা। সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে দোষীদের বিচার দাবিতে প্রতিবাদ সভা, কালো ব্যাজ ধারণ ও প্রতীকি কর্মবিরতি পালন করছেন ইনস্টিটিউটের শিক্ষক পরিষদ, শিক্ষক সমিতি ও শিক্ষক ফেডারেশন।
শিক্ষক সমিতির সভাপতি জিএম তাজউদ্দিন বলেন, অধীনস্থ নিন্ম শ্রেণীর কর্মচারীদের হাতে প্রতিষ্ঠান প্রধানের লাঞ্ছিত হওয়া কোনভাবেই মেনে নেয়া যায় না। এই ঘটনায় শুধুমাত্র অধ্যক্ষ মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান খান লাঞ্ছিত হয়েছেন এমন নয়। এতে পুরো শিক্ষক জাতিই লাঞ্ছিত হয়েছেন। এই ঘটনার সুষ্ঠু বিচার না হলে ভবিষ্যতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার পরিবেশ বিঘ্নিত হওয়ার আশংকা রয়েছে। এ ব্যাপারে প্রতিকার চেয়ে কেন্দ্রীয় শিক্ষক সমিতি বরাবর স্মারকলিপি দেয়া হয়েছে।
শিক্ষক পরিষদ সভাপতি মোঃ আক্তারুজ্জামান বলেন, একজন অধ্যক্ষকে লাঞ্ছিত করার ৫ দিন পার হলেও এখন পর্যন্ত কোন ব্যবস্থা না করা সকল শিক্ষকদের ব্যাথিত করেছে। উচিত ছিলো তাৎক্ষণিকভাবে দোষীদের চিহ্নিত করে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা। কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তর ঠিক কোন কারণে এখনও বিষয়টির গুরুত্ব দিচ্ছেন না তা আমার বোধগম্য নয়।
টিচার্স ফেডারেশনের সভাপতি মিজানুর রহমান বলেন, একজন শিক্ষক যিনি একটা প্রতিষ্ঠানের প্রধান তাকে অপমান করা হলো। অথচ এর কোন বিচার এখন পর্যন্ত হয়নি। এর থেকে লজ্জা ও হতাশার কিছুই হতে পারে না। অনতিবিলম্বে এর সুষ্ঠু বিচার না হলে আমরা আরও কঠোর আন্দোলনে যেতে বাধ্য হবো৷
সঠিক বিচার দাবি কর্মচারীদের
ইনস্টিটিউটের কর্মচারীর হাতে অধ্যক্ষ লাঞ্ছিত করার ঘটনায় বিব্রত বোধ করছেন সাধারণ কর্মচারীরাও। তারা বলছেন, সঠিক তদন্ত ও ভিডিও ফুটেজ যাচাই করে প্রকৃত দোষীদের বিচার হওয়া উচিত। অন্যায়ভাবে একজনের শাস্তি যেন অন্যজন না পায় সেদিকে খেয়াল রাখার দাবি জানান তারা।
ইনস্টিটিউটের রেজিস্ট্রার আবদুল গণি ভূঞা বলেন, এমন ঘটনা আমাদের সবার জন্য বিব্রতকর। অধ্যক্ষের সাথে এমন আচরণ কোন ভাবেই মেনে নেয়া যায় না। অভিযুক্তদের মধ্যে সবাই জড়িত থাকার কথা নয়। তবুও তদন্ত করে সুষ্ঠু বিচার হওয়া উচিত।
প্রধান সহকারী পুলিন বিহারী দে বলেন, অধ্যক্ষের সাথে যা হয়েছে তা কোনভাবেই প্রত্যাশা করা যায় না। ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত দোষীদের শাস্তি দাবি করেন তিনি।
ইনস্টিটিউটের কর্মচারী ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক মোঃ মোস্তফা কামাল বলেন, অভিযুক্তদের তালিকায় আমার নামও রয়েছে বলে জানতে পেরেছি। তিনি দৈনিক ফেনীকে বলেন, মোবাইলে সব কথা বলা যায় না। শুধু এতটুকু বলবো, আমরা কোন অপরাধ করিনি। আপনারা সিসিটিভি ফুটেজ চেক করে দেখেন ঘটনায় আমরা জড়িত আছি কিনা।