চট্টগ্রামে করোনার নমুনার স্তূপ জমেছে। পরীক্ষায় হিমশিম খাচ্ছে চট্টগ্রামের একমাত্র টেস্টল্যাব ফৌজদারহাট বিআইটিআইডি।


চট্টগ্রাম বিভাগের ১১টি জেলার ৯টিতেই করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) শনাক্তের আলাদা কোনো ব্যবস্থা নেই। কক্সবাজার ছাড়া বাকি ১০টি জেলার করোনা রোগী শনাক্তের একমাত্র ঠিকানা চট্টগ্রামের ফৌজদারহাটে অবস্থিত বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিসেস (বিআইটিআইডি)। অথচ এই গবেষণা প্রতিষ্ঠানটিতে করোনার নমুনা পরীক্ষার জন্য পিসিআর বা পলিমারেজ চেইন রিঅ্যাকশন মেশিন আছে মাত্র দুটি। এর মধ্যে একটি আবার সংকট শুরুর পর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ধারে আনা।


চট্টগ্রামে করোনা পরীক্ষায় যে জট তৈরী হয়েছে তা তুলে ধরেন, স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ) সমন্বয় সেলে চট্টগ্রাম বিভাগের দায়িত্বে থাকা ডাঃ আ ম ম মিনহাজুর রহমান। তিনি নিজের ফেসবুক ওয়ালে লিখেন- করোনা বিআইটিআইডিতে নমুনাজট তৈরি হয়েছে। বিভাগের অন্য জেলাগুলো থেকেও প্রচুর নমুনা আসতে থাকায় এই একটি কেন্দ্র চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে। তাই নমুনা পৌঁছানোর পরও পরীক্ষা সম্পন্ন হতে দু-তিন দিনও সময় লেগে যাচ্ছে। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে দ্বিতীয় কেন্দ্র স্থাপনের কাজ প্রায় শেষের পথে। এখানে পরীক্ষা শুরু হলে এ সংকট কিছুটা কাটবে বলে আশা করছি।

কিন্তু বর্তমানে ঢাকা-চট্টগ্রাম ও বিভিন্ন জেলায় মোট ১৭টি ল্যাবরেটরিতে কারোনাভাইরাস শনাক্তকরণের পরীক্ষা হচ্ছে। এসব ল্যাবরেটরিতে দিনে সর্বোচ্চ পরীক্ষা হয়েছে এক হাজার ৯০৫টি নমুনা। এর মধ্যে চট্টগ্রাম বিভাগের ১০ জেলার তিন কোটি মানুষের করোনা পরীক্ষায় ব্যবহার করা হচ্ছে মাত্র দু’টি পিসিআর মেশিন।


বিআইটিআইডি সূত্রে জানা গেছে, গত ২৬ মার্চ চট্টগ্রামের বিশেষায়িত এই হাসপাতালে শুরু হয় কোভিড-১৯ শনাক্তকরণ পরীক্ষা। প্রায় ১১০০ টেস্ট কিট নিয়ে মাত্র দুটি পিসিআর মেশিনে এক মাস ধরে চলছে করোনা পরীক্ষা।


বিআইটিআইডির ল্যাবপ্রধান ও ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক শাকিল আহমদ বলেন, ‘আমাদের প্রতিষ্ঠানে শুধু দুটি পিসিআর মেশিন আছে যেগুলোতে আমরা এখন করোনাভাইরাস পরীক্ষার কাজ করছি। এর মধ্যে একটি সংকট শুরুর পর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ধারে এনেছি।’


তিনি আরও বলেন, ‘দুটো মেশিন সকাল-বিকেল দু’বেলা বসালে ১৮০টি পর্যন্ত নমুনা পরীক্ষা করা সম্ভব হয়। কিন্তু শুধু পিসিআর বা টেস্ট কিট হলেই পরীক্ষা সম্ভব হয় না। এ পরীক্ষার আলাদা তিনটি স্তর আছে, প্রতিটি স্তরেই আলাদা প্রয়োজনীয় উপাদান ও রিঅ্যাজেন্টের প্রয়োজন হয়, যা সবসময় পাওয়া যায় না। এর বাইরে দক্ষ জনশক্তির অভাবতো রয়েছেই।’


বিআইটিআইডি সূত্রে আরো জানা গেছে, ২৬ মার্চ থেকে কোভিড-১৯ শনাক্তকরণ পরীক্ষা শুরুর পর গত ২৫ দিনে মোট এক হাজার ৪৫১টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। এর মধ্যে শুধু চট্টগ্রামেই করোনা পজেটিভ রোগী শনাক্ত হয়েছে ৩৯ জন, যার মধ্যে পাঁচ ইতোমধ্যে মারা গেছেন।


বিআইটিআইডির হিসাবে গড়ে প্রতিদিন ৫৮ জনের করোনাভাইরাস পরীক্ষা করা হয়েছে। অথচ চট্টগ্রাম বিভাগের ১০টি জেলায় (কক্সবাজার ছাড়া) মোট জনসংখ্যা প্রায় তিন কোটি। এই বিপুল জনসংখ্যার জন্য করোনা পরীক্ষার এই হার একেবারেই নগণ্য বলছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।


প্রতিদিন সংগৃহীত নমুনার চাইতে করোনাভাইরাস পরীক্ষা কম হচ্ছে জানিয়ে অধ্যাপক শাকিল আহমদ বলেন, ‘চট্টগ্রাম ও আশপাশের জেলা থেকে দৈনিক ২০০টির বেশি নমুনা সংগ্রহ করা হয়। কিন্তু আমরা চাইলেও বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার কারণে ১০০ থেকে ১২০টির বেশি নমুনা পরীক্ষা করতে পারি না। এ কারণে প্রতিদিনই বিআইটিআইডিতে নমুনার স্তূপ জমা পড়ছে। বিকল্প ব্যবস্থা করা না গেলে আমরা নমুনাতেই চাপা পড়ব।’


তিনি বলেন, ‘সকাল ১০টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত একটানা ১২ ঘণ্টা কাজ করছি। আমরা সাতজন মানুষ রাতদিন খেটে এর বেশি কোনোভাবেই পরীক্ষা করতে পারি না। এভাবে আমরা কয়দিন চালাতে পারব জানি না। আমাদেরও কোয়ারেন্টাইনে যেতে হতে পারে।’


চট্টগ্রামের বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক হাসান শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘চট্টগ্রামে বর্তমানে করোনা সামাজিক সংক্রমণ চলছে। আমরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে নিশ্চিত হওয়ার জন্য আক্রান্ত ব্যক্তির আশপাশের লোকজনকে বেশি পরীক্ষা করছি, তাই তারা শনাক্তও বেশি হচ্ছেন। আমরা যদি পরীক্ষার পরিমাণ আরও বাড়াতে পারি তাহলে দেখতেন আরও অনেকে করোনা রোগী শনাক্ত হতো।’


করোনা পরীক্ষায় বিআইটিআইডিসহ চট্টগ্রামের স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষ থেকে পলিমারেজ চেইন রিঅ্যাকশন মেশিনের স্বল্পতার কথা বলা হলেও অনুসন্ধানে বন্দরনগরী চট্টগ্রামে এই মুহূর্তে অন্তত ২০টি পিসিআর মেশিনের তথ্য পাওয়া গেছে। এছাড়া মাত্র সাতজন ব্যক্তি যখন পুরো বিভাগের করোনার নমুনা পরীক্ষায় হিমশিম খাচ্ছেন তখন হাতের কাছে থাকা প্রশিক্ষিত মাইক্রোবাইলজিস্ট ও জনশক্তিকে ব্যবহারে কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষ থেকে।

জানা গেছে, শুধু চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি অ্যান্ড এ্যানিমেল সাইয়েন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে এই মুহূর্তে পিসিআর মেশিন রয়েছে পাঁচটি, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগ, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগ ও ইনস্টিটিউট অব মেরিন সায়েন্সেস অ্যান্ড ফিশারিজ বিভাগে অন্তত পাঁচটি সচল পিসিআর মেশিন রয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ (বিসিএসআইআর) চট্টগ্রাম শাখা, চট্টগ্রাম মেরিন ফিশারিজ অ্যাকাডেমিসহ বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে আরও ১০টির বেশি পিসিআর মেশিন রয়েছে। আছে পিসিআর মেশিনে ভাইরাস পরীক্ষায় প্রশিক্ষিত জনবলও।


স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব পিসিআর মেশিন ও প্রশিক্ষিত জনবল ব্যবহার করে চট্টগ্রাম বিভাগের করোনার নমুনা পরীক্ষা সম্ভব।


চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সাবেক পরিচালক (স্বাস্থ্য) ডা. রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, ‘জাতি এখন ইতিহাসের অন্যতম ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। রাষ্ট্রকে কেন বলতে হবে, উচিত ছিল প্রতিষ্ঠানগুলোরই স্বপ্রণোদিতভাবে এগিয়ে আসা। আমি অবসরে এসেছি আজ ১০ বছর। কিন্তু খুব ইচ্ছে করছে এই সময়ে যদি জাতির কোনো কাজে লাগতাম। আপনি যেসব প্রতিষ্ঠানের কথা বলেছেন তাদের কাছে পিসিআর মেশিন আছে। এর বাইরে বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতেও মেশিনসহ প্রশিক্ষিত জনবল রয়েছে। সরকারি হোক আর বেসরকারি হোক। এর সবই রাষ্ট্র চাইলে ব্যবহার করতে পারে। বেসরকারি হাসপাতালগুলোর ফাইল উল্টালেই জানা যায়, তাদের কাছে কী আছে কী নেই। এই দুঃসময়ে যদি আমরা এসব সম্পদের ব্যবহার না করি কখন করব? স্বাস্থ্য বিভাগের উচিত এখনই এ লক্ষ্যে সমন্বিত উদ্যোগ নেয়া’।


সূত্রঃ চট্টগ্রাম২৪.কম