রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান এবং অন্যান্য তথা আগরতলা মামলায় ২৩ নম্বর আসামী প্রয়াত বীর মুক্তিযোদ্ধা বিমান বাহিনীর সার্জেন্ট শামছুল হক এখনও পাননি মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি।
রাষ্ট্রপতির দফতরসহ সরকারি প্রতিষ্ঠান হতে প্রেরিত বিভিন্ন সময়ের শুভেচ্ছা কার্ডে আগরতলা মামলার আসামী উল্লেখ থাকলেও কোথাও লেখা থাকে না বীর মুক্তিযোদ্ধা। অথচ মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষক এ মানুষটি ছিলেন ফেনীর গেরিলা যোদ্ধাদের প্রাণপুরুষ। ১৯৯৫ সালে স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করেন সার্জেন্ট শামছুল হক।
মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় অন্তর্ভূক্তির সর্বশেষ অনলাইন আবেদনের সময়সীমার মধ্যে নাম অন্তর্ভূক্তির আবেদন করতে পারেনি শামছুল হকের পরিবার। দুই ছেলের বড়জন এনামুল হক জানান, সময়মত তথ্য না জানায় বাবার অন্তিম ইচ্ছাপূরণ করতে পারিনি। এর পরপর ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রী আ.ক.ম মোজাম্মেল হকের কাছে বিশেষ সুযোগ পেতে আবেদন করলেও ‘অনলাইন আবেদন করে না থাকলে কিছুই করণীয় নেই’ মন্তব্য লেখেন।
তিনি জানান, বাবার নাম মুক্তিযোদ্ধা গ্যাজেটভূক্ত করতে গেল সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রী বরাবর আবেদন করেছেন।
ছোট ছেলে ফজলুল হক জানান, দেশ স্বাধীনের পর নিজেই মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় অন্তর্ভূক্ত হননি। পরিবার হতে তালিকাভূক্ত হতে বললে বলতেন, আমি মুক্তিযোদ্ধা চিহ্নিত করেছি, প্রশিক্ষণ দিয়েছি। আমার কেন সার্টিফিকেট লাগবে!
তবে জীবনের শেষ মুহূর্তে এসে বীর মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি চেয়েও পাননি। ছোট ছেলে অভিযোগ করেন, ১৯৯৪ সালে তৎকালীন ফেনীর এমপিসহ চেষ্টা করেছিলেন মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় অন্তর্ভূক্ত হতে। কিন্তু রাজনৈতিক মতভেদের কারণে তৎকালীন সরকার হতে সহযোগিতা পাননি।
বঙ্গবন্ধু স্বপরিবারে হত্যাকান্ডের পর স্বাধীন বাংলাদেশে তাঁর উপর নেমে আসে জেল নির্যাতন।
এনামুল হক জানান, স্বাধীনতার পর ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত ফেনী সদরের ফরহাদনগর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন সার্জেন্ট শামছুল হক।
তিনি জানান, আগরতলা মামলায় গ্রেফতারের পর অমানুষিক নির্যাতনের প্রভাব ছিল আমৃত্যু। ১৯৬৯ সালে জেল হতে মুক্তির পর মানসিক বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়েন শামছুল হক। বঙ্গবন্ধুর সহযোগিতায় পরবর্তীতে পাবনা মানসিক হাসপাতালে চিকিৎসা নেন।
মহান মুক্তিযুদ্ধে সার্জেন্ট শামছুল হকের অবদান প্রসঙ্গে সাবেক জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মোতালেব জানান, মার্চের শুরু থেকেই ফেনী পিটিআই মাঠে কলেজ ছাত্র ও সাধারণ যুবকরা অস্ত্র চালনার প্রশিক্ষণ নিতে থাকে। বিমান বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সার্জেন্ট শামছুল হক এবং সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সার্জেন্ট নূরুল ইসলাম গাদা রাইফেল ও ডামি রাইফেল দিয়ে প্রতিদিন প্রশিক্ষণ দিতেন।
১৯৭১ সালে ত্রিপুরায় মুহুরী ইউথ ট্রেনিং ক্যাম্পের ডেপুটি ক্যাম্প চীফ বীর মুক্তিযোদ্ধা মোস্তফা হোসেন বলেন, সার্জেন্ট শামছুল হক ফেনীর রাজা খ্যাত খাজা আহম্মদের আস্থাভাজন ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই ফেনীর সিও অফিসে সম্মুখ সমরে সামনের সারিতে ছিলেন।
সাবেক এমপি বীর মুক্তিযোদ্ধা তালেব আলী জীবিত থাকাকালে একটি প্রত্যয়নপত্রে শামছুল হক প্রসঙ্গে লেখেন, তিনি মুক্তিযুদ্ধে নিজেই অংশগ্রহণ করেন এবং আমাদের গেরিলা ক্যাম্পগুলোতে কমান্ডার হিসেবে গেরিলাদের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন।
অন্য একটি প্রত্যয়নপত্রে বীর মুক্তিযোদ্ধা বেলায়েত হোসেন বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে আমি ওনার (ক্যাপ্টেন শামছুল হক) অধীনে একজন প্রশিক্ষণার্থী ছিলাম। আমাদের প্রশিক্ষণ চলাকালীন ভারতের চোত্তাখোলায় তিনি ট্রেনিং ইন্সট্রাক্টর হিসেবে ছিলেন।
সার্জেন্ট শামছুল হক ১৯৩৯ সালের পহেলা নভেম্বর ফেনী সদরের ফরহাদনগরের নৈরাজপুর গ্রামের সাদেক আলী হাজী বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি করইয়া উচ্চ বিদ্যালয় ও ফেনী কলেজে পড়াশোনা শেষ করে বিমান বাহিনীতে যোগ দেন। যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে তিনি ফরহাদনগরে রিলিফ কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন। ১৯৯৫ সালের ২৫ আগস্ট নিজ বাড়িতে মৃত্যুবরণ করেন এ বীর মুক্তিযোদ্ধা।