‘ইউনুস বাবুর মাথার ডান পাশে সামনের অংশে ছিল ২টি ধারালো আর পেছনে ছিল ৩টি কোপের দাগ, যার মধ্যে একটি ছিল গভীর ক্ষত। তার গলার কন্ঠনালীতে পাটের রশি দিয়ে গিট দেয়া। শরীরের চামড়া খসে পড়েছিল বিভিন্ন স্থানে। বাম চোখ বন্ধ এবং ডান চোখ খুলে বাইরে বেরিয়ে এসেছে। ডান হাত ছিল সামান্য বাঁকানো। বাম হাত বাঁকানো অবস্থায় বুকের উপর রাখা। তার শরীরের উপরের অংশে একটি টিশার্ট জড়ানো থাকলেও, নিচের অংশে কোন কাপড় ছিলনা।’
মৃতদেহের সুরতহাল প্রতিবেদনে এমন তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতিবেদন তৈরি করেন ফেনী শহর পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ সুদ্বীপ রায়।
তাসপিয়া ভবনের এ সেফটিক ট্যাংকের ভেতর হতে বাবুর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ
গত বৃহস্পতিবার (৮ অক্টোবর) রাত ১১টার দিকে মা রেজিয়া বেগমের সাথে শেষবার কথা হয় চীনের আহোট ইউনিভার্সিটিতে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়ুয়া বাবুর। মাকে বলেছিলেন, ঘরে ফিরছেন তিনি। তারপর থেকে গত তিনদিন ধরে তার কোন খোঁজ নেই। তার খোঁজে বিভিন্ন জায়গায় খোঁজাখুঁজি করলে কোন সন্ধান পায়নি তার পরিবার। শনিবার রাতে বাবুর খোঁজে শহরের পুরাতন রেজিস্ট্রি অফিসের মনির উদ্দিন সড়কের তাসপিয়া ভবনে আসেন তার পরিবারের সদস্যরা। ভবনের মালিক তখন তাদের ভেতের ঢুকতে দেয়নি। পরে তিনি আবার থানায় ফিরে যান। পুলিশকে বিষয়টি জানালে তারা এলে তালা খুলে দেয়া হয়। তখন সেপটিক ট্যাংকের ভেতর তল্লাশী চালালে সন্ধান মেলে বাবুর মরদেহের। আর খবর পেয়ে থানা থেকে ছুটতে ছুটতে ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন তিনি।
আরও পড়ুন ⇒ ‘তাসপিয়া ভবনের সেপটিক ট্যাংকে মিলল আরও এক যুবকের লাশ’
কাঁদতে কাঁদতে রেজিয়া বেগম বলেন, বৃহস্পতিবার রাত ১১টার দিকে বাবুর সাথে শেষ কথা হয় আমার। তখন বাবু বলেছে সে শাহরিয়ার ও রাকিবের সাথে আসতেছে। এরপর সে না আসায় রাত তিনটার দিকে আবার ফোন দেই। তখন এক অপরিচিত ব্যক্তি ফোন ধরে বলে, তুমি কে? এরপর ফোন বন্ধ করে দেয়। তারপর বাবুর আর কোন খোঁজ পাইনি। পরদিন শুক্রবার রাতে আমি আবার বাবুর খোঁজে শহরের কদলগাজী রোডে রাকিবের বাসায় যাই। তার পা ধরে আমি বাবুর কথা জানইতে চাইলে রাকিব বলে, আন্টি আমি পাঠানবাড়ি রোডের মাথায় এসে নেমে যাই। বাবু শাহরিয়ারের সাথে চলে গেছে। তখন সে পুলিশকে ফোন করে বলে, স্যার বাবুর আম্মা আসছে। রেজিয়া বেগম বলেন, পুলিশ আমার কথা বিশ্বাস করেনি। বিকাশ নামে এক পুলিশ সদস্য বলে, বাবু খুন করে আত্মগোপনে গেছে। মোবাইল ট্র্যাকিংয়ের মাধ্যমে আমাকে লোকেশান দেখান তিনি।
জানা যায়, শুক্রবার রাতে এ ঘটনায় সেফটিক ট্যাংক হতে উদ্ধারকৃত শাহরিয়ারের নামে মামলা করেন রেজিয়া বেগম। সেসময় রাকিব নামে ওই যুবকও তার সাথে ছিলেন।
বাবুর বাবা রঙের কাজ করেন। তিন ভাইবোনের মধ্যে বাবু ছিলেন সবার বড়। ফেনী ইন্সটিটিউট অব কম্পিউটার সাইন্স এন্ড টেকনোলজি থেকে ডিপ্লোমা শেষ করে বৃত্তি নিয়ে তিনি পড়াশোনার জন্য চীনের আহোট ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছিলেন।
তার ছোট ভাই মোঃ ইফরান বাপ্পী শাহীন একাডেমীর নবম শ্রেণীর ছাত্র। সে জানায়, বিএসসিতে ভাইয়ার ১ম বর্ষ শেষ হয়েছিল। করোনাভাইরাস প্রকোশ শুরু হবার আগে তিনি দেশে আসেন। লকডাউন শুরু হওয়ার কারণে তিনি আটকা করেন। কিন্তু অনলাইনে ক্লাস করছিলেন। বৃহস্পতিবার শাহরিয়ার ও রাকিব ভাইয়াকে ডেকেছিলেন। শাহরিয়ার ভাই ঢাকায় একটি কোম্পানীকে চাকরী করতেন। তিনি বুধবার ও শুক্রবার ঢাকা হতে ভাইয়ার সাথে দেখা করতে আসতেন। গত বুধবারও তিনি ফেনীতে আসেন ভাইয়ার সাথে দেখা করতে।
আরও পড়ুন ⇒ ‘পাঠানবাড়িতে যুবককে কুপিয়ে ফেলা হয়েছিল সেফটি ট্যাংকে’
এরপর তিনদিন ধরে তার কোন খোঁজ পাইনি আমরা। আমি পাঠানবাড়ি রোডে প্রাইভেট পড়তে এসে শাহরিয়ার ভাইয়ার ঘটনাটি শুনতে পাই। এতে করে আমাদের সন্দেহ হয়, যে ভাইয়াও এখানে আছে।
তবে কি কারণে এই নৃশংশ হত্যাকান্ড ঘটানো হয়েছে তার মোটিভ এখনও স্পষ্ট নয়। রেজিয়া বেগম বলছেন, আইফোনজনিত কারণেই এ ঘটনা ঘটানো হয়েছে।
পুলিশ সূত্রে জানা যায়, আজ রবিবার গ্রেফতারকৃত ওই ভবনের কেয়ারটেকার মোজাম্মেল হক শাহিনকে আদালতে রিমান্ডের আবেদন করা হতে পারে। এ ঘটনায় হত্যা মামলা দায়েরের প্রক্রিয়া চলছে।
শুক্রবার (৯ অক্টোবর) ভোরের দিকে তাসপিয়া ভবনের একই ট্যাংক হতে শাহরিয়ার নামে আরেক যুবককে গুরুতর আহতাবস্থায় উদ্ধার করে পুলিশ
অন্যদিকে শাহরিয়ারের মায়ের করা মামলায় শনিবার গ্রেফতারকৃত শাহিন আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দী দিলেও সেখানে বাবুর কথা উল্লেখ করেনি। জবাবন্দীতে সে জানায়, বাবু ভবনে একবার এসেই চলে গিয়েছিল। জবানবন্দীতে শাহীন আদালতকে জানায়, ঘটনার রাতে বাবু একবারের জন্য এখানে এসেছিল। এরপর কিছুক্ষণ থেকে সে বেরিয়ে গেছে।
এ ঘটনায় ওই এলাকার জনমনে আতংকের সৃষ্টি হয়েছে। স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দার সাথে কথা বলে জানা যায়, ওই কেয়ারটেকারের আচার-আচরণ ছিল ভদ্র। কিন্তু তার মনের ভেতরে যে এইরকম ভয়ংকর খুনি বাস করে, তা আমার কখনো কল্পনা করতে পারিনি। তবে এ ঘটনার সাথে শুধু একাই শাহিন জড়িত কিনা, তা সঠিকভাবে তদন্ত করলে বেরিয়ে আসবে। এমন নৃশংসভাবে দুজন মানুষকে কুপিয়ে সেফটি ট্যাংকের ভেতর ফেলে দেয়া কেবল অসুস্থ মস্তিষ্কসম্পন্ন মানুষের পক্ষেই সম্ভব। তারা বলছেন, শুক্রবার ভোর রাতে পুলিশ এসে আরেক যুবককে উদ্ধার করেছিল। তখন ভেতরে যে আরও একজনের লাশ যে পড়ে আছে সেটি তাদের চোখে পড়েনি?