ফেনী পৌরসভার বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় পরিবেশবান্ধব সমাধানের আশায় ২০১৮ সালে ‘বর্জ্য থেকে জৈব সার উৎপাদন’ প্রকল্পের যাত্রা শুরু হলেও কোটি টাকার এই প্রকল্পটি এখন পুরোপুরি অচল হয়ে পড়েছে। স্থানীয়রা বলছেন, পৌর কর্তৃপক্ষের চরম উদাসীনতা, নিয়মিত তদারকি ও নিরাপত্তা না থাকায় প্রকল্পের প্রায় ৮০ শতাংশ যন্ত্রপাতি ও অবকাঠামো চুরি হয়ে গেছে। কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত জৈব সার উৎপাদন কেন্দ্রটি দীর্ঘদিন পরিত্যক্ত থাকায় বর্তমানে এটি মাদকসেবী ও দুর্বৃত্তদের নিরাপদ আশ্রয়স্থলে পরিণত হয়েছে। তবে পৌর কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলে জানা গেছে, প্রকল্প সম্পর্কে তারা কিছুই জানেন না।

ফেনী পৌরসভার সুলতানপুর এলাকায় প্রায় ৭০ শতক জমির ওপর স্থাপিত প্রকল্প এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, উৎপাদন শেডগুলো ভাঙাচোরা অবস্থায় পড়ে আছে। কোথাও দরজা নেই, কোথাও ছাউনি খুলে নেওয়া হয়েছে। যন্ত্রপাতির কোনো অস্তিত্ব নেই। ভেতরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে ভাঙা কংক্রিট, মরিচা ধরা লোহার অংশ। আগাছায় ঢেকে পুরো এলাকাজুড়ে ভূতুড়ে পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে।

জানা গেছে, পরিবেশ অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্টের অর্থায়নে প্রায় ১ কোটি ৫৭ লাখ টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হয়। ২০১৮ সালে নির্মাণকাজ শুরু হয়ে ২০২১ সালে পরীক্ষামূলকভাবে সার উৎপাদন শুরু হয়। প্রকল্পটির বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান ছিল বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সেবক এগ্রোভেট লিমিটেড।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, প্রত্যাশিত আয় না হওয়ায় ২০২৩ সালেই সার উৎপাদন বন্ধ করে দেয় প্রতিষ্ঠানটি। পরে সেখানে কিছুদিন প্লাস্টিক পুড়িয়ে ফার্নেস অয়েল উৎপাদনের চেষ্টা চালানো হয়।

২০২৪ সালে সরকার পরিবর্তনের পর প্রকল্পটির সব কার্যক্রম পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। এরপর দীর্ঘদিন কোনো তদারকি বা নিরাপত্তা ব্যবস্থা না থাকায় একে একে যন্ত্রপাতি ও অবকাঠামো চুরি হয়ে যায়।

প্রকল্প চলাকালে কেন্দ্রটির পাহারাদার ফরিদ আহমদ বলেন, “যখন এখানে সার উৎপাদন হতো, তখন আমি ৬ হাজার টাকা বেতনে পাহারাদার হিসেবে দায়িত্ব পালন করতাম। ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর থেকে আর কেউ এখানে আসেনি। আমিও পাহারা দেওয়া বন্ধ করে দিই। এখন এখানে কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। সব ভেঙে নিয়ে গেছে চোরেরা। পৌরসভার কোনো পদক্ষেপ না থাকায় যে যেভাবে পেরেছে নিয়ে গেছে।”

পাশের পৌর কবরস্থানে দাফনকাজে নিয়োজিত ইমাম মোহাম্মদ আলী বলেন, কার্যক্রম বন্ধ থাকলেও ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত জায়গাটি মোটামুটি ভালো অবস্থায় ছিল। সরকার পরিবর্তনের পর থেকেই চুরি শুরু হয়।

স্থানীয় বাসিন্দা নুর মোহাম্মদ বলেন, কারখানা স্থাপনের শুরু থেকেই আমরা আপত্তি জানিয়েছিলাম। ময়লা আবর্জনার দুর্গন্ধে আশপাশে বসবাস করা কষ্টকর হয়ে পড়েছিল। লাভ না হওয়ায় যারা চালু করেছিল, তারাই আবার বন্ধ করে পালিয়েছে। ৫ আগস্টের পর এলাকার কিছু মাদকসেবী, চোর ও বহিরাগতরা মিলে ফ্যান, আসবাবপত্র ও যন্ত্রপাতিসহ সবকিছু লুট করে নিয়ে গেছে। কয়েকবার পৌরসভাকে জানানো হলেও তারা কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।

এ বিষয়ে জানতে ফেনী পৌরসভার প্রশাসক মো. ঈসমাঈল হোসেনের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি নির্বাহী প্রকৌশলীর সঙ্গে কথা বলতে বলেন। নির্বাহী প্রকৌশলী মো. জাকির উদ্দিন বিষয়টি সম্পর্কে কিছুই জানেন না দাবি করে পৌর স্বাস্থ্য কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলতে বলেন।

পৌর স্বাস্থ্য কর্মকর্তা কৃষ্ণপদ সাহা বলেন, ২০১৮ সালে সুলতানপুরে বর্জ্য থেকে সার উৎপাদন কেন্দ্রটি চালু করা হয়। চট্টগ্রামের একটি এনজিও পৌরসভার সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়ে এটি পরিচালনা করছিল। সম্ভবত লাভ না হওয়ায় তারা বন্ধ করে দেয়। তবে তারা প্রকল্পটি আনুষ্ঠানিকভাবে পৌরসভার কাছে হস্তান্তর করেনি। বর্তমানে প্রকল্পটির অবস্থা সম্পর্কে আমার জানা নেই।

কেন পৌরসভার আওতাধীন কোটি টাকার প্রকল্পটি অচল হয়ে পড়েছে এ বিষয়ে বক্তব্য দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন নির্বাহী প্রকৌশলী মো. জাকির উদ্দিন। এক পর্যায়ে তিনি প্রকল্প বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান সেবক এগ্রোভেট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. খালেদ আমিনকে ফোন করে আগামী সপ্তাহের মধ্যে প্রকল্পটি পৌরসভার কাছে হস্তান্তরের জন্য চাপ দেন। তবে প্রকল্প বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর নিরাপত্তা ও রক্ষণাবেক্ষণে কেন উদ্যোগ নেয়া হয়নি এই প্রশ্ন এড়িয়ে যান তিনি।

চুক্তি অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময় শেষে প্রকল্পটি ফেনী পৌরসভার কাছে হস্তান্তরের কথা থাকলেও কার্যক্রম বন্ধের পর নিরাপত্তা ও রক্ষণাবেক্ষণে কোনো কার্যকর উদ্যোগ দেখা যায়নি।

এ বিষয়ে জানতে সেবক এগ্রোভেট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. খালেদ আমিনের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।