পাঁচ বছর আগে দাগনভূঞা উপজেলার বেকেরবাজারে এক রাতে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে প্রাণ হারান নৈশপ্রহরী আবদুল মান্নান (৫০)। ডাকাতদল সে রাতে তাকে হত্যা করে। অবশেষে সেই মামলার বিচার কার্যক্রম শুরু হয়েছে জেলা ও দায়রা জজ আদালতে। গত ২৬ আগস্ট জেলা ও দায়রা জজ আদালত মামলার চার্জ গঠন করেন এবং সাক্ষ্যগ্রহণের দিন ধার্য করেন।

২০২০ সালের ২৫ জুন ভোর রাত সাড়ে তিনটা। মেসার্স শরিয়ত অ্যান্ড ব্রাদার্স নামে একটি দোকান টার্গেট করে ডাকা দল ট্রাক নিয়ে বাজারে প্রবেশ করে। বাজার পাহারা দিচ্ছিলেন নৈশপ্রহরী আবদুল মান্নান মনু ও রফিকুল ইসলাম। ডাকাতদের নড়াচড়া টের পেয়ে তারা বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেন। আর তখনই শুরু হয় নির্মমতা।

ডাকাতরা প্রথমে দুজন নৈশপ্রহরীর হাত-পা গামছা দিয়ে বেঁধে ফেলে। রফিকুল ইসলামকে বেধড়ক মারধর করে অজ্ঞান করে ফেলে রেখে যায় টিপু মার্কেটের গলিতে। আর আবদুল মান্নান চিৎকার করলে তার মুখে গামছা গুঁজে দেয় দুলাল প্যাদা। এরপর টর্চলাইট দিয়ে মাথায় আঘাত করলে ঘটনাস্থলেই তিনি মারা যান। হত্যার পর তার লাশও রফিকুলের পাশে ফেলে রাখা হয়।

পরে দোকানের তালা ভেঙে ২০ বস্তা চাল, ২০ বস্তা মসুর ডাল ও ২৮ কেজি রৌশনসহ আনুমানিক ৪৬ হাজার টাকা মূল্যের মালামাল ট্রাকে তুলে নেয় ডাকাতরা। কিন্তু বাজারের লোকজন টের পেয়ে মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিলে এলাকাবাসী এগিয়ে আসে। আতঙ্কে ডাকাতরা পালাতে গিয়ে পুলিশের সঙ্গে গুলিবিনিময়ে জড়িয়ে পড়ে।

ঘটনাস্থলে পুলিশ ও গ্রামবাসীর ধাওয়ায় ডাকাত দলের সঙ্গে সংঘর্ষ বাঁধে। জঙ্গলের ভেতরে লুকিয়ে থাকা ডাকাতরা পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি চালায়। পাল্টা গুলিতে নিহত হয় ডাকাত দলের তিন সদস্য বরগুনার দুলাল মোল্লা (৪৫), বাবুল মোল্লা (৪০) এবং নওগাঁর বিদ্যুৎ (৩৯)।

এ সময় পুলিশের কয়েকজন সদস্য আহত হন। ঘটনাস্থল থেকে পুলিশ উদ্ধার করে একটি একনলা বন্দুক, এক রাউন্ড কার্তুজ, দুটি কিরিচ, একটি চাইনিজ কুড়াল, তালা কাটার যন্ত্র, চারটি মোবাইল ফোন, লুণ্ঠিত চাল-ডাল ও ডাকাতি কাজে ব্যবহৃত ট্রাক (ঢাকা মেট্রো ড-১১-০৩৪৬)। সেদিন রাতেই পুলিশ গ্রেপ্তার করে দুলাল প্যাদাকে। ঘটনার পরপরই দোকান মালিক শরিয়ত উল্লাহ বাদী হয়ে দাগনভূঞা থানায় ডাকাত দলের পাঁচ সদস্যের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। মামলার তদন্তভার নেন তৎকালীন তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশ পরিদর্শক পার্থ প্রতিম দেব। দীর্ঘ তদন্ত শেষে ৫ জনকে আসামি করে ২০২২ সালের ৩১ জানুয়ারি আদালতে ৪১২ পৃষ্ঠার অভিযোগপত্র জমা দেন তিনি। মামলায় মোট ৫০ জনকে সাক্ষী করা হয়।

তদন্তে জানা যায়, দুলাল প্যাদা, বাবুল মোল্লা ও ট্রাক মালিক রিয়াজ কুমিল্লার গরিপুর বাজারে মিলিত হয়ে ডাকাতির পরিকল্পনা করেন। এরপর ডাকাত দল রিয়াজের ট্রাক (ঢাকা মেট্রো ড-১১-০৩৪৬) নিয়ে ভোর রাতে বেকের বাজারে যায়। নৈশপ্রহরীরা বিষয়টি বুঝতে পেরে বাধা দিলে তাদের হাত-পা বেঁধে ফেলা হয়। রফিকুল ইসলামকে মারধর করে অজ্ঞান করে বাজারের গলিতে ফেলে রাখা হয়। আর আবদুল মান্নান চিৎকার করলে তার মুখে গামছা গুঁজে টর্চলাইট দিয়ে আঘাত করে হত্যা করা হয়।

আসামিরা হলেন, পটুয়াখালীর মাদার বুনিয়ার দুলাল প্যাদা (৩২), বরগুনার আমতলীর মনির হোসেন গাজী (৩৬), একই এলাকার ফয়েজ খান (৪০), পটুয়াখালীর জামাল খান (৪০) ও লক্ষ্মীপুরের রিয়াজ (২৮)। তাদের মধ্যে তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। ২০২০ সালের ২১ আগস্ট গ্রেপ্তার হন ট্রাকের মালিক রিয়াজ। আদালতে তিনি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। একই বছর ২৬ জুন দুলাল প্যাদাও তৎকালীন সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আব্দুল্লাহ খাঁনের আদালতে দায় স্বীকার করেন। ২০২১ সালের ১৮ আগস্ট গ্রেপ্তার হন মনির হোসেন। তবে ফয়েজ খান ও জামাল খান এখনো পলাতক।

জেলা দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) মো. মেজবাহ উদ্দিন খাঁন বলেন, বিগত সরকারের আমলে চাঞ্চল্যকর এ মামলার চার্জ গঠন হয়নি। বর্তমান আদালত দ্রুত চার্জ গঠন করে বিচার শুরু করেছে। আমরা আশা করছি, এই মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি হবে। এতে বাদীপক্ষ ন্যায়বিচার পাবে এবং অপরাধীরা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ভোগ করবে।

নিহত নৈশপ্রহরী আবদুল মান্নান মনু (৪৫) ছিলেন দাগনভূঞা উপজেলার আশ্রাফপুর গ্রামের মৃত নুর নবীর ছেলে। আহত নৈশপ্রহরী রফিকুল ইসলাম (৪৫) উত্তর আলীপুর গ্রামের ফরিদ আহমদের ছেলে।