গেল বছরের জুলাই-আগস্টে ঘটে যাওয়া ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান বদলে গেছে দেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপট। রাষ্ট্র কাঠামো বদলের ডাক নিয়ে রাস্তায় নেমেছিল লাখো মানুষ সেই উত্তাল সময়ে ফেনীর বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শত তরুণী শিক্ষার্থী মাঠে নেমে এসেছিল। আন্দোলনে নারীদের অবস্থান ছিল দৃঢ়। অনেকেই পরিবারের নিষেধ অমান্য করে দেশের জন্য লড়েছিল। কিন্তু মাত্র ক’মাসের ব্যবধানে সেই নারীরাই যেন আড়ালে। সময়ের সঙ্গে আন্দোলনকারী নারীদের নিরবতা ও অনুপস্থিতি নিয়ে এখন প্রশ্ন উঠেছে রাজনৈতিক ও সচেতন মহলে। এ প্রসঙ্গে জানতে ফেনীর একাধিক নারী আন্দোলনকারীর সঙ্গে কথা বলেন দৈনিক ফেনী।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকারীদের সূত্রে জানা গেছে, শুরুতে ‘কোটা আন্দোলন’ নামে একটি ফেসবুক গ্রুপে যুক্ত হওয়ার মাধ্যমে বেশিরভাগ নারীর আন্দোলনে যাত্রা শুরু করেন। পরবর্তী ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে আন্দোলনে সক্রিয়তা। বিক্ষোভ থেকে শুরু করে সড়ক অবরোধ কিংবা পুলিশ ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের হামলার মাঝেও সম্মুখে থেকে লড়ে যান তারা। যেখানে স্কুল, কলেজ ও বিশ^বিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থী থেকে সাধারণ নারীরাও অংশ নেন।
এ প্রসঙ্গে কথা হয় ফেনী সরকারি জিয়া মহিলা কলেজের শিক্ষার্থী সুরাইয়া ইয়াছমিনের সঙ্গে। দৈনিক ফেনীকে তিনি বলেন, ৭ জুলাই আমি ‘কোটা আন্দোলন’ নামে একটি ফেসবুক গ্রুপে যুক্ত হই। তখন দেশের অবস্থা দেখে ঘরে বসে থাকতে পারিনি। ওই গ্রুপে জানানো হয় যারা আন্দোলনে অংশ নিতে চায়, তারা ম্যাসেঞ্জার গ্রুপে যুক্ত হতে। আমিই ছিলাম ম্যাসেঞ্জার গ্রুপের প্রথম নারী সদস্য। ধীরে ধীরে অনেক মেয়েরা যুক্ত হন। পরে কেন্দ্র থেকে সমন্বয়ক হওয়ার জন্য নাম, ঠিকানা, মোবাইল নম্বর দিতে বলা হয়। তখন জাফর ও তাজিম ভাইয়ের কথামতো আমি রাজি হয়েছিলাম। পরে কেন্দ্রীয়ভাবে ঘোষিত ১৮ জন সমন্বয়কের তালিকায় ফেনী জেলা নারী সমন্বয়ক হিসেবে আমার নাম ছয় নম্বরে আসে। দায়িত্ব পাওয়ার পর প্ল্যাকার্ড তৈরি থেকে শুরু করে আন্দোলনের বিভিন্ন প্রস্তুতিমূলক কাজে যুক্ত ছিলাম। এ আন্দোলনে অংশ নেওয়া আমার জন্য সহজ ছিল না। আমি এমন এলাকায় বসবাস করি যেখানে চারপাশে আওয়ামী লীগের লোকজন। জুলাইয়ের পর থেকে মেয়েদের আন্দোলনে খুব একটা দেখা যায় না। পরিবার থেকে বলা হয়-তুমি মেয়ে মানুষ, ঘরে থাকো। এসব আন্দোলনে তোমাদের এখন আর প্রয়োজন নেই।
ফেনীতে আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল চট্টগ্রাম বিএফ শাহীন কলেজের শিক্ষার্থী আদিবা ইবনাত রিদিকা। নিজের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন পোস্টের মাধ্যমে আলোচনা শুরু করি। সেখান থেকে সংগঠিত হয়ে একটি দল গঠনের মাধ্যমে ১৫ জুলাই প্রথমবারের মতো ফেনীতে মাঠে নেমেছিলাম। কিছু ছাত্রীর সঙ্গে অভিভাবকরাও সঙ্গে ছিল। পরে আওয়ামী সন্ত্রাসী বাহিনী আমাদের ওপর হামলা চালায়, গায়ে হাত তোলে, বেঁধে মারধর করে। আন্দোলন চলাকালীন বক্তব্য ও স্লোগান দিয়েছিলাম। মেয়েরা ছিলাম সামনে, ভাইয়েরা ছিল পেছনে। সবসময় সংগ্রাম ছিল দেশের জন্য। লক্ষ্য ছিল স্বৈরাচার ও দুর্নীতিমুক্ত একটি বাংলাদেশ। তবে এখনো কাঙ্খিত পরিবর্তন আসেনি। স্বৈরাচারের দোসররা এখনো সমাজে বিচরণ করছে। বর্তমানে রাজনৈতিক দলগুলোও নিজেদের ক্ষমতা নিয়ে ব্যস্ত। ফলে নারীরা উপেক্ষিত ও পিছিয়ে পড়েছেন। আন্দোলনের পরেও নারীরা নানাভাবে হুমকির মুখে পড়ছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক নারী আন্দোলনকারী বলেন, তখন দেশের স্বার্থে আওয়ামী দুঃশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে রাস্তায় নেমেছিলাম। ৫ আগস্ট পরবর্তী এ প্ল্যাটফর্মের কতিপয় কিছু লোকের বির্তকিত কর্মকা-ের কারণে আমরা সরে দাঁড়িয়েছি। আমাদের চাওয়া ছিল দেশ ফ্যাসিবাদ মুক্ত হোক, সেটি হয়েছিল।
ফেনীর আন্দোলনে নারীদের প্রতি আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের হামলার স্মৃতি তুলে ধরে ফেনী কম্পিউটার ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী তাসফিয়া তাসনিম বলেন, আন্দোলনের সময়ে নারীরা প্রথম সারির প্রতিরোধের ঢাল হয়ে উঠেছিল। বিশেষ করে ১৭ জুলাই ট্রাংক রোডে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের অতর্কিত হামলার পর অনেক মেয়ে আর মাঠে ফিরতে পারেনি, কিন্তু আমরা ছিলাম ভাইদের রক্ষক হয়ে। ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের ছেলেরা আমাকে নিয়মিত খোঁজ করতো। নিজের নিরাপত্তার জন্য বাড়ি ফেরার পথও পরিবর্তন করতে হয়েছে। এখন নিজের শিক্ষাজীবনকে গুছিয়ে নিতে আগের ছন্দে ফিরি যেতে চাই। কখনো কোনো রাজনৈতিক দলে ছিলাম না, আগামীতেও যাবো না। আমার অংশগ্রহণ ছিল কেবল একজন সচেতন নাগরিক ও শিক্ষার্থী হিসেবে অবিচার ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের জায়গা থেকে।
ফেনীতে নারীদের আন্দোলনে ভূমিকা ও পরবর্তী সময়ে সরে যাওয়া প্রসঙ্গে কথা হয় জেলা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের তৎকালীন সংগঠক আবদুল্লাহ আল জুবায়েরের সঙ্গে। দৈনিক ফেনীকে তিনি বলেন, ফেনীর আন্দোলনে নারীদের ভূমিকা ছিল অগ্রগামী। তারা শুধু পাশে ছিলেন না, অনেক ক্ষেত্রে ভাইদের রক্ষাকারী হিসেবে সামনে দাঁড়িয়েছিল। আন্দোলনের সময় ছেলেদের ওপর হামলার ঘটনায় অনেক নারী ক্ষোভ জানিয়ে মাঠে নামেন। আন্দোলন সফল হওয়ার পর অনেকে নিজ নিজ গন্তব্যে ফিরে গেছে। আমরা তাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেছি। তারা বলেছেন, আন্দোলন শেষ, এখন তারা পড়াশোনায় মনোযোগী হতে চায়।
কিছু সদস্যের বিতর্কিত কর্মকা-ে নারী সদস্যরা সরে গেছেন-এমন অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের কাছে কেউ এমন কোনো অভিযোগ করেননি। যারা সরে দাঁড়িয়েছে, তারা মূলত পারিবারিক বা ব্যক্তিগত কারণে সরে গেছে।
জেলা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের তৎকালীন আরেক সংগঠক ওমর ফারুক বলেন, আন্দোলনের সময় আমাদের বোনেরা সামনে থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। তারা শুধু উপস্থিত হননি, বরং আন্দোলনের প্রতিটি ধাপে আমাদের পাশে ছিল। তবে এখন অনেকে পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেছে। অনেকেই তখন এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার্থী ছিল, যার ফলে বর্তমানে কেউ কেউ ফেনীর বাইরে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করছে। এজন্য অনেকে এখন দূরে রয়েছে।