দাগনভূঞা উপজেলায় একের পর এক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলেও ফায়ার সার্ভিস স্টেশন নির্মাণের উদ্যোগ থমকে আছে ভূমি অধিগ্রহণজনিত জটিলতায়। ২০১০-১১ অর্থবছরে এই প্রকল্পের যাত্রা শুরু হলেও ১৫ বছর পেরিয়ে গেলেও আলোর মুখ দেখেনি ফায়ার স্টেশন নির্মাণ।

ফেনী ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স সূত্র জানায়, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের আওতায় দাগনভূঞায় ‘সি’ ক্যাটাগরির ফায়ার স্টেশন নির্মাণের জন্য প্রয়োজন ১ একর (১০০ শতক) ভূমি। এর মধ্যে ৩৩ শতক ভূমি ইতোমধ্যে অধিগ্রহণ করা হলেও বাকি ৬৭ শতক জমি অধিগ্রহণের অনুমোদন এখনও জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) অপেক্ষায় রয়েছে।

অন্যদিকে, ২৫ জুলাই রাতে দাগনভূঞার সিলোনিয়া বাজারে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ওষুধের দোকানসহ দুটি দোকান পুড়ে যায়। এতে প্রায় ১০ লাখ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়। এমন অগ্নিকাণ্ডে আগুন নিয়ন্ত্রণে ফেনী, সেনবাগ ও কোম্পানীগঞ্জ ফায়ার সার্ভিসের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। অনেক সময় খবর পাওয়ার পর ফায়ার সার্ভিস ঘটনাস্থলে পৌঁছানোর আগেই আগুনে সব কিছু পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে।

উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, দাগনভূঞা আটটি ইউনিয়ন ও একটি প্রথম শ্রেণির পৌরসভা নিয়ে গঠিত একটি গুরুত্বপূর্ণ উপজেলা। এখানে একটি সরকারি কলেজসহ বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরেও এখানকার জনগণের প্রত্যাশিত একটি ফায়ার সার্ভিস স্টেশন গড়ে ওঠেনি।

২০১০-১১ অর্থবছরে তৎকালীন জেলা প্রশাসক আবদুল কুদ্দুস খান দাগনভূঞায় ফায়ার সার্ভিস স্টেশন নির্মাণের জন্য প্রথম ভূমি অধিগ্রহণ করেন। তবে মালিকদের মামলার কারণে নির্মাণ কাজ বন্ধ হয়ে যায়। ওই মামলায় ভূমি সচিবসহ ছয়জন সরকারি কর্মকর্তাকে আসামি করা হয়। ফলে সেই জমি ব্যবহার অযোগ্য হয়ে পড়ে।

২০১৪ সালে নতুনভাবে দুলামিয়া কটন মিলস সংলগ্ন কৃঞ্চরামপুর মৌজায় ৩৩ শতক জমি অধিগ্রহণ করা হয় এবং ২০১৮ সালে জমির মালিকদের ক্ষতিপূরণ প্রদান করা হয়। তবে প্রকল্পের খরচ বৃদ্ধি ও মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ায় কার্যাদেশপ্রাপ্ত ঠিকাদাররা কাজ শুরু করেনি। এতে করে ফায়ার স্টেশন নির্মাণ কার্যক্রম একপ্রকার স্থবির হয়ে পড়ে।

এই সময়ের মধ্যে দাগনভূঞা ফায়ার স্টেশনের নামে বরাদ্দ পাওয়া ১২ জন ফায়ার ফাইটার কর্মস্থল হিসেবে ফেনী ফায়ার স্টেশনে সংযুক্ত রয়েছেন। যদিও তাদের বেতন-ভাতা দাগনভূঞার নামে বরাদ্দ হচ্ছে।

জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলাম জানান, ভূমি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে এবং প্রয়োজনে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা হবে।

দাগনভূঞা সহকারী কমিশনার (ভূমি) সাহিদুল আলম জানান, ৩৩ শতক জমি ইতোমধ্যে নামজারি সম্পন্ন হয়েছে ও ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে। নতুন করে ৬৭ শতক জমির জন্য ২০২৩ সালের ৩১ জানুয়ারিতে আবেদন করা হয়, যা এখন একনেকের অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে।

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স ফেনীর উপ-সহকারী পরিচালক আবদুল্লাহ হারুন পাশা জানান, নতুন ৬৭ শতক ভূমি অধিগ্রহণে ৫ কোটি ৭৪ লাখ ৫০ হাজার ৭৮০ টাকা ব্যয় হবে। এই জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া এখনো সম্পন্ন হয়নি বলেই প্রকল্পটি স্থবির হয়ে আছে। দাগনভূঞার ফায়ার সার্ভিসের নিয়োগকৃত জনবল ১২ জন ফেনী ফায়ার ষ্টেশনে সংযুক্ত আছেন।

ফেনী ফায়ার সার্ভিস সূত্রে জানা যায়, ২০১০-১১ অর্থবছরে প্রথম ৩৩ শতক ভূমি অধিগ্রহণ করা হয়, যার মূল্য ছিল ২২ লাখ ২১ হাজার ৫১০ টাকা। মামলার কারণে সেই জমি ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়ে। এরপর ২০১৪ সালের ৯ সেপ্টেম্বর নতুন জমি অধিগ্রহণ কার্যক্রম শুরু হয় এবং ২০১৮ সালের ১০ সেপ্টেম্বর ভূমি অধিগ্রহণ সম্পন্ন হয়। ঠিকাদাররা কাজ শুরু না করায় প্রকল্পটি আবারো থেমে যায়। নতুন নির্দেশনায় দাগনভূঞা ফায়ার স্টেশনের জন্য ৬৭ শতাংশ জমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া শুরু হলেও তা এখনো ঝুলে আছে। দাগনভূঞা ফায়ার স্টেশনের জন্য ৬৭ শতাংশ জমি অধিগ্রহণ করতে ২০২৩ সালে ৩১ জানুয়ারি সহকারি কমিশনার (ভূমি) দাগনভূঞা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে অবহিত করেন। ২০২৩ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি ফেনী জেলা প্রশাসক ৬৭ শতাংশ ভূমি অধিগ্রহণের প্রসঙ্গে ফায়ার সার্ভিস এন্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরে অবহিত করেন। বর্তমানে ৬৭ শতাংশ ভূমি অধিগ্রহণের জটিলতায় আটকে আছে। ৫৬টি ফায়ার স্টেশন নির্মাণ প্রকল্পের সাথে ২০১৩ সালে ছাগলনাইয়া ও ফুলগাজী উপজেলায় ফায়ার স্টেশন নির্মাণ হয়েছে। এরপরে ৭৮টি ফায়ার স্টেশন নির্মাণ প্রকল্পের সাথে সোনাগাজী ও পরশুরাম উপজেলায় ফায়ার স্টেশন নির্মাণ করা হলেও দাগনভূঞা ফায়ার সার্ভিস স্টেশনের নির্মাণে এখনো হয়নি।

প্রসঙ্গত, দেশের ৫১টি গুরুত্বপূর্ণ ফায়ার স্টেশন নির্মাণ প্রকল্পের ২৭ নম্বরে রয়েছে দাগনভূঞা। অথচ এই উপজেলার চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত ছাগলনাইয়া, ফুলগাজী, সোনাগাজী ও পরশুরামে ইতোমধ্যে ফায়ার স্টেশন নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে। দাগনভূঞাবাসীর দীর্ঘদিনের প্রত্যাশিত একটি আধুনিক ফায়ার সার্ভিস স্টেশন আজ শুধুই ভূমি অধিগ্রহণের আনুষ্ঠানিকতার অপেক্ষায়। অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধে উপজেলার সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য এটি সময়োপযোগী ও অত্যাবশ্যকীয় একটি প্রয়োজন।


নেই স্টেশন, আছে জনবল
দাগনভূঞায় এখনো ফায়ার সার্ভিস স্টেশন নির্মাণ হয়নি, তবে এর জন্য জনবল নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। নিয়োগপ্রাপ্ত ১২ জন কর্মী বর্তমানে ফেনী ফায়ার সার্ভিসে সংযুক্ত রয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছেন একজন লিডার ও ১১ জন ফায়ার ফাইটার। তারা গত তিন বছর ফেনী ফায়ার সার্ভিস থেকে বেতনসহ অন্যান্য সরকারি সুবিধা ভোগ করছেন।

নিয়োগপ্রাপ্তরা হলেন লিডার মো. সোলেমান, ফায়ার ফাইটার লিমন সরকার, নাহিদ আহমেদ সৈকত, রবিউল ইসলাম, মমিনুল ইসলাম, সুমন মিয়া, মো. পাপন মিয়া, মো. মিজানুর রহমান, মো. রাসেল পাঠান, মো. ফরহাদ, গাড়িচালক নুরুল আবসার ও নজরুল ইসলাম। লিডার মো. সোলেমান নোয়াখালী ফায়ার সার্ভিসে কর্মরত। তাদের মধ্যে নাহিদ আহমেদ সৈকত ও রবিউল ইসলাম ফায়ার সার্ভিস অধিদপ্তরে সংযুক্ত রয়েছেন। ফায়ার ফাইটার মো. ফরহাদ উচ্চতর প্রশিক্ষণে জাপানে অবস্থান করছেন।


ফেনীতে অগ্নিকাণ্ডে নিহত ৩, আহত ৭২
ফায়ার সার্ভিস এন্ড সিভিল ডিফেন্স সূত্র জানায়, ২০২৪ সালে ফেনী জেলা জুড়ে ১৯৫টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় আনুমানিক ২ কোটি ৫৫ লাখ ৫০০ টাকার সম্পদের ক্ষতি হয়েছে। তবে ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা সময়মতো সাড়া দিয়ে ৮ কোটি ৭১ লাখ ২০ হাজার টাকার মালামাল উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছেন। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের উপ-সহকারী পরিচালক আবদুল্লাহ হারুন পাশা এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
তিনি জানান, অগ্নিকাণ্ডে ৭২ জন আহত হয়েছেন এর মধ্যে ৬৯ জন পুরুষ ও ৩ জন নারী। প্রাণ হারিয়েছেন ৩ জন, যাদের মধ্যে ১ জন পুরুষ এবং ২ জন নারী। মাসভিত্তিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গতবছর মার্চ মাসে সর্বোচ্চ ৩৩টি এবং অক্টোবর মাসে সর্বনিম্ন ৪টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে।