২০২৫ সালের জুলাই মাসের ভয়াবহ বন্যায় ফেনীর পাঁচটি উপজেলা ও দুটি পৌরসভার বিস্তীর্ণ জনপদ প্লাবিত হয়ে পড়ে। দুর্যোগ শেষে প্রণীত সরকারি তথ্য অনুযায়ী, এবার জেলায় ১০৬ দশমিক ১৫ বর্গকিলোমিটার এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ক্ষতিগ্রস্ত হয় ১৮ হাজার ১৪৩টি পরিবার, দুর্যোগে আক্রান্ত হয় ৭৭ হাজার ৭০২ জন মানুষ। এর মধ্যে নারীর সংখ্যা ৩২ হাজার ৮৮৪ জন, পুরুষ ৩২ হাজার ৯৫৮ জন ও শিশু ১১ হাজার ৮৬০ জন।

স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্টদের মতে, স্থানচ্যুত হওয়া সব মানুষেরই দুর্ভোগ হলেও আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান নেওয়া নারী ও কন্যা শিশুরা পড়েন সবচেয়ে বড় বিপাকে। স্যানিটেশন ও প্রজনন স্বাস্থ্যসেবার ঘাটতির কারণে নারীরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন। বন্যার ফলে পানিজনিত রোগ ডায়রিয়া, টাইফয়েড ও চর্মরোগ বেড়ে যায়, যার শিকার বেশি হন নারী ও শিশুরা। বাড়ি হারানোর কষ্ট, পরিবারের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ ও আশ্রয়কেন্দ্রে অনিরাপত্তা, নারীদের মানসিক স্বাস্থ্যেও গভীর প্রভাব ফেলে। এছাড়া বন্যাকালীন আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে নারীরা যৌন হয়রানি ও নির্যাতনের ঝুঁকিতে থাকেন বলেও উল্লেখ করছেন সংশ্লিষ্টরা। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে নারীরাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন বলে মত দিয়েছেন তারা।

জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন দপ্তরের দেওয়া তথ্যমতে, এবার জেলায় ৭৭ হাজার ৭০২ জন মানুষ স্থানচ্যুত হয়। বন্যায় কোন মৃতের সংখ্যা না থাকলেও আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নেন হাজারো মানুষ। এরমধ্যে নারী ও শিশুদের সংখ্যা ছিল বেশি। জেলার পাঁচ উপজেলায় ৩২ হাজার ৮৮৪ জন নারী ও ১১ হাজার ৮৬০ জন শিশু স্থানচ্যুত হয়ে বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নেন। ৩২ হাজার ৯৫৮ জন পুরুষ স্থানচ্যুত হয়। এরমধ্য সব থেকে বেশি ফুলগাজী উপজেলায়। এ উপজেলায় ১৯ হাজার ৯২৭ জন নারী, ৬ হাজার ৪০২ জন শিশু এবং ২০ হাজার ৮১৭ জন পুরুষ স্থানচ্যুত হন। অন্যদিকে পরশুরাম উপজেলায় ১১ হাজার ১৯জন নারী, ৫ হাজার ১০০ জন শিশু ও ১০ হাজার ৫৮৭ জন পুরুষ স্থানচ্যুত হয়। ছাগলনাইয়া উপজেলায় ১ হাজার ৮০০ নারী, ৩০০ শিশু ও ১ হাজার ৪০০ পুরুষ স্থানচ্যুত হয়। দাগনভূঞা উপজেলায় ১১০ জন নারী, ৩০০ জন শিশু ও ১২০ জন পুরুষ স্থানচ্যুত হয়। ফেনী সদর উপজেলায় ২৮ জন নারী, ৩৮ জন শিশু ও ৩৪ জন পুরুষ স্থানচ্যুত হয়।

বন্যাকালীন সময়ে কথা হয় ফুলগাজীর নতুন মুন্সিরহাট এলাকায় আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নেওয়া জোহরা বেগমের সঙ্গে। সেসময় নিজের নানা অসুবিধার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, দুই বাচ্চা নিয়ে খুব কষ্টে আছি। কোনো প্রকার শান্তি নেই। মহিলাদের যে কষ্ট তা বলে বুঝানো যাবে না। খাওয়া-দাওয়া ও বাথরুমের অবর্ণনীয় কষ্ট। আশ্রয়কেন্দ্রে নিরাপত্তাসহ অনেক সমস্যায় পড়তে হয়।

ফারজানা আক্তার নামে আরেকজন বলেন, আশ্রয়কেন্দ্রে নারী-পুরুষ সবাই একসঙ্গে থাকে। নারীরা সাবলীলভাবে টয়লেটে যেতে পারেনা। পাশাপাশি উঠতি বয়সের মেয়েদের নিয়ে মা-বাবাদের চিন্তিত থাকতে হয়। এছাড়া মেয়েদের গোপনীয়তা ঠিকভাবে রক্ষা হয় না। পানি ও খাবারের কষ্টে নানা রোগে আক্রান্ত হতে হয়। ঘরবাড়ি ছেড়ে অন্য জায়গায় গিয়ে থাকা খুব কষ্টের।

এ ব্যাপারে স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও জলবায়ু কর্মী ড. আহমদ কামরুজ্জামান বলেন, যেকোনো দুর্যোগে নারী ও শিশুরাই সবচেয়ে বেশি অসুবিধার মধ্যে থাকে। আর্থিকভাবে সকলের ক্ষতি হলেও শারীরিক ও মানসিকভাবে নারীদের ওপর প্রভাব পড়ে বেশি। নারীরা যখন ঘর ছেড়ে অন্যত্র যায়, তখন নিজের দেখভালের পাশাপাশি ঘর, সন্তান ও নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকেন। তারা একা হয়ে পড়েন, ফলে মানসিক চাপ বহুগুণে বেড়ে যায়।

তিনি বলেন,আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে নামাজের আলাদা জায়গা, ব্রেস্টফিডিং কর্নার, আলাদা টয়লেট কিংবা নারীদের গোপনীয়তা রক্ষার কোনো সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা নেই। এতে নারীরা চরম বিপাকে পড়েন। এছাড়া যৌন হয়রানির ঝুঁকিও থাকে, যা অস্বীকার করা যায় না। তাই বন্যাপ্রবণ এলাকাগুলোতে নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আলাদা ব্যবস্থা নেওয়ার এখনই সময়। এ বিষয়ে সরকারের মনোযোগ জরুরি।

জেলা মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের উপপরিচালক নাছরীন আক্তার দৈনিক ফেনীকে বলেন, দুর্যোগে নারীরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। নারীদের মৌলিক চাহিদা বিশেষ করে খাদ্য, স্যানিটেশন ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র বিঘ্নিত হয়। ঘরের বাইরে অবস্থান করতে গিয়ে মেয়েরা পিরিয়ডকালীন কিংবা গর্ভাবস্থায় ভীষণ সমস্যায় পড়েন। মন্ত্রণালয় থেকে সরাসরি কোনো বরাদ্দ না থাকলেও বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। সেই ভিত্তিতে আমরা স্যানিটারি ন্যাপকিন, প্রয়োজনীয় ওষুধ, শিশুদের জন্য খাদ্য ও খেলনাসহ কিছু জরুরি সামগ্রী সরবরাহ করি।

সাইডস্টোরি-১

বন্যায় জেলায় যত ক্ষতি
এবারের বন্যায় ফেনী জেলায় আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৩৮ কোটি ৪০ লাখ ৪৬ হাজার ৪৩১ টাকা। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে কৃষি ও অবকাঠামো খাতে।

জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, বন্যায় কৃষিখাতে ২ হাজার ৭২৫ দশমিক ৬ হেক্টর জমির শস্যক্ষেত ও বীজতলা সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে নষ্ট হয়ে যায়। এ খাতে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় ৭৫ কোটি ২ লাখ ৪৩ হাজার টাকা। কৃষকদের মতে, বছরের পর বছর গুরুত্বপূর্ণ মৌসুমে এমন ক্ষতির প্রভাব পুরো বছরের খাদ্যনিরাপত্তা ও কৃষি উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

এদিকে পানিতে ভেসে গেছে মাছের ঘের ও পুকুর। বন্যার পানিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৪৪০ দশমিক ১০ হেক্টর হ্যাচারি ও ১ হাজার ৬৭৭টি পুকুর-জলাশয়। এতে ক্ষতি হয়েছে ৮ কোটি ৩৬ লাখ ২৬ হাজার ১৪৬ টাকা।

এছাড়া প্রাণিসম্পদ খাতেও ব্যাপক ক্ষতির চিত্র উঠে এসেছে। জেলার বিভিন্ন এলাকায় বন্যায় ৬৬ হাজার ৮২৫টি প্রাণী মৃত ও ভেসে যায়। এর মধ্যে ভেড়া ১৩টি, ছাগল ৩টি, গরু ৯টি ও মুরগি ৬৬ হাজার ৮০০টি। প্রাণিসম্পদ খাতে ক্ষয়ক্ষতির আর্থিক পরিমাণ ১ কোটি ৩২ লাখ ৭২ হাজার ৫০০ টাকা।

বন্যার প্রবল স্রোতে জেলার ৩১৯ দশমিক ৬ কিলোমিটার পাকা-আধাপাকা ও কাঁচা সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এলজিইডি ও সড়ক বিভাগ জানায়, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অন্তত ৬১টি ব্রিজ-কালভার্টসহ অন্যান্য স্থাপনা। অবকাঠামোগত এ ক্ষতির আর্থিক পরিমাণ ৮২ কোটি ৩০ লাখ ৬৯ হাজার টাকা।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের হিসাব অনুযায়ী, জেলায় অন্তত ৪৩ দশমিক ৩৭৩ কিলোমিটার বাঁধ ভেঙে গেছে। এতে ক্ষতির পরিমাণ ধরা হয়েছে ৫৩ কোটি ৮৩ লাখ ৮৯ হাজার ৫০০ টাকা।

বন্যায় জেলায় ৫১টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে ৪০টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ৭টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ২টি কলেজ ও ২টি মাদ্রাসা আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ খাতে ক্ষতির পরিমাণ ধরা হয়েছে ৩৬ লাখ টাকা। স্বাস্থ্য খাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১৪টি স্বাস্থ্যকেন্দ্র। যার মধ্যে ৪টি হাসপাতাল ও ১০টি কমিউনিটি ক্লিনিক রয়েছে। এতে ক্ষতির পরিমাণ ১৭ লাখ টাকা।

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের ক্ষতির পরিমাণ ১৪ কোটি ৫ লাখ ২৪ হাজার টাকা। এর মধ্যে রয়েছে ৩ হাজার ১৮৮টি গভীর, অগভীর ও হস্তচালিত নলকূপ এবং ২ হাজার ৭৪০টি স্বাস্থ্যসম্মত বাথরুম।

বন বিভাগ জানিয়েছে, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৩৯ দশমিক ৫ হেক্টর বনায়ন ও ৮ হাজার ২৬টি নার্সারি। এতে ক্ষতির পরিমাণ ১৯ লাখ ৮৭ হাজার ২৩৪ টাকা। বিদ্যুৎ বিভাগ জানায়, বন্যায় ৭৫ দশমিক ২০ কিলোমিটার বৈদ্যুতিক লাইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতির পরিমাণ ধরা হয়েছে ৪৪ লাখ ৩৪ হাজার টাকা।

জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মাহবুব আলম জানান, সব ধরনের ক্ষয়ক্ষতির তালিকা করে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত ঘরবাড়ির জন্য বরাদ্দ এলে পুনর্গঠন কার্যক্রম শুরু হবে। আংশিক ক্ষয়ক্ষতির ক্ষেত্রে স্থানীয় পর্যায়ে সহযোগিতা করা হচ্ছে। এনজিও ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের যৌথ সমন্বয়ে পুনর্বাসনে কাজ করা হবে। পাশাপাশি বিভিন্ন দপ্তর তাদের নিজ নিজ ক্ষয়ক্ষতির হিসাব অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন পাঠিয়েছে। সে অনুযায়ী পুনর্বাসন প্রক্রিয়া এগিয়ে যাবে।

তিনি বলেন, ২০২৪ সালের বন্যা ও এবারের বন্যার অভিজ্ঞতায় আমরা দেখেছি জেলায় আরও বেশি আশ্রয়কেন্দ্র প্রয়োজন। ফেনী এখন একটি বন্যা প্রবণ এলাকা। জেলা প্রশাসন এ বিষয়ে ইতোমধ্যে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে জানাতে উদ্যোগ নিয়েছে।