গত শনিবার (১৭ মে) রাত আনুমানিক সাড়ে ৯টার দিকে গুরুতর আহত অবস্থায় কলেজ শিক্ষার্থী মিতা রানী নাথকে ফেনী জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যান অজয় সাহা নামে এক যুবক। হাসপাতালের জরুরি বিভাগে চিকিৎসার পর তাকে নেওয়া হয় নতুন ভবনের চতুর্থ তলায়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় এক ঘণ্টা পর মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে মিতা। অন্যদিকে তার মৃত্যুর চারদিন পেরিয়ে গেলেও এ নিয়ে কাটেনি ধোঁয়াশা। ঘটনার পর থেকে গা ডাকা দিয়েছেন সেদিন মিতাকে হাসপাতালে নেওয়া যুবক অজয়। মিতার মৃত্যুর রহস্য ও নানা প্রশ্নোত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছে দৈনিক ফেনী টিম।

নিহতের স্বজন, পরিবার ও পুলিশ সূত্রে জানা যায়, শহরের সহদেবপুর এলাকার বাসিন্দা তপন লাল নাথের মেয়ে ফুলগাজী সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী মিতা রানী গত শনিবার বিকেলে প্রাইভেট পড়ার কথা বলে বাসা থেকে বের হন। পরবর্তী সেদিন রাত ৯টা ১২ মিনিটে অজয় সাহা নামের এক যুবক মিতার বড় বোন অপর্ণাকে মুঠোফোনে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় তার আহত হওয়ার কথা জানান। একই সঙ্গে তাকে ফেনী জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে আসার কথাও বলেন অজয়। পরবর্তী হাসপাতালে মিতার মৃত্যুর পরপরই সটকে পড়েন অজয়। তারপর থেকে এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত (মঙ্গলবার রাত ৯টা) তার কোনো খোঁজ মেলেনি।

ফেনী জেনারেল হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, সেদিন রাতে অজয়সহ আরও এক যুবক ও এক যুবতী মিতাকে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে যায়। তখন অজয় চিকিৎসককে মিতার বন্ধু পরিচয় দিয়ে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় আহত হওয়ার কথা জানান।
নিহতের বড় বোন অপর্ণা দৈনিক ফেনীকে বলেন, অজয়ের সঙ্গে মিতার বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিল। সেদিন রাত ৮টা ৫২ মিনিটে মিতার সঙ্গে সর্বশেষ কথা হয়। তখন সে দ্রুত বাসার ফিরছে বলে বাবাকে জানাতে বলেছিল। তারপর ৯টা ১২ মিনিটে অজয়ের নম্বর থেকে কল দিয়ে দুর্ঘটনার কথা জানান। খবর পেয়ে তাৎক্ষণিক আমার ভাইকে হাসপাতালে পাঠিয়েছিলাম। সেখানে নিশাত নামে এক ব্যক্তি ও তার স্ত্রীসহ অজয় ছিল। একপর্যায়ে তারা আমার বোনকে হাসপাতালে রেখে সটকে পড়েন। আমরা চাই এসব ঘটনার সকল রহস্য বের হোক। সেদিন যদি দুর্ঘটনা হয়েও থাকে তাহলে দুর্ঘটনাস্থল কোথায় বা কিভাবে এ দুর্ঘটনা আমরা জানতে চাই। এছাড়া অজয় যদি কোনো অপরাধ না করে তাহলে কেন পালিয়ে গেল? এজন্যই আমরা সন্দেহ করছি।

এদিকে মিতার মৃত্যুর ঘটনায় সোমবার (১৯ মে) তার বাবা তপন লাল নাথ বাদী হয়ে ফেনী মডেল থানায় একটি মামলা করেছেন। এতে ফেনী পৌরসভার পশ্চিম মধুপুর এলাকার জয়ন্ত সাহার ছেলে ও ফেনী সরকারি কলেজের ডিগ্রি প্রথমবর্ষের শিক্ষার্থী অজয় সাহাকে আসামি করা হয়েছে। এ মামলার এজাহারে শহরতলীর লালপোলে এ দুর্ঘটনা ঘটে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
এজহারে উল্লেখ করা হয়, অজয় সাহা মিতাকে নিয়ে মহাসড়কের লালপোল এলাকায় বেপরোয়া গতিতে মোটরসাইকেল চালানোর সময় ছিটকে পড়ে মারা যায় মিতা। এজন্য তাকে আসামি করে সড়ক পরিবহন আইনের ৯৮/১০৫ ধারায় এ মামলা করা হয়েছে।

এজাহারে উল্লিখিত ঘটনাস্থল ও দুর্ঘটনা প্রসঙ্গে জানতে লালপোল ও খাইয়ারা এলাকার একাধিক স্থানীয় বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলে দৈনিক ফেনী। তবে কেউই এ ধরনের দুর্ঘটনার তথ্য নিশ্চিত করতে পারেনি। লালপোল এলাকার ব্যবসায়ী মো. রুবেল বলেন, প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে রাত সাড়ে ১০টা পর্যন্ত এখানে কাজ করি। সেদিন আশপাশে এমন কোনো দুর্ঘটনার তথ্য পাইনি। এছাড়াও এ সড়কে যেকোনো দুর্ঘটনা ঘটলে আমরা শুনতে পাই। সেদিন এমন কিছু কারো কাছে শুনিনি।

খাইয়ারা এলাকার বাসিন্দা রিফাত হোসেন বলেন, সেদিন আমাদের এলাকায় এমন কোনো দুর্ঘটনা ঘটেনি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিষয়টি দেখে এলাকায় খোঁজখবর নিয়েছি। কিন্তু কেউই এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য জানাতে পারেনি।

অন্যদিকে ছেলের লাপাত্তা ও মিতার মৃত্যু নিয়ে কথা হয় অজয়ের বাবা ফেনী বড় বাজারের ব্যবসায়ী জয়ন্ত সাহার সঙ্গে। দৈনিক ফেনীকে তিনি বলেন, ১৮ মে থেকে ফেনী কলেজে অজয়ের ডিগ্রি প্রথম বর্ষের পরীক্ষা ছিল। শনিবার বিকেলে কিছুক্ষণের জন্য বাইরে যাওয়ার কথা বলে সে দোকান থেকে বের হয়। রাত সাড়ে ১০টার দিকে বাসায় ফিরে এক মেয়ে তার মোটরসাইকেল থেকে ছিটকে পড়ে দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে জানান। তখন তার সঙ্গে নিশাত ছিল। পরবর্তী রাতে অজয় বাসা থেকে বের হয়ে যায়। তারপর এখনো আমাদের সঙ্গে আর কোনো যোগাযোগ হয়নি। ব্যবহৃত নম্বরও বন্ধ রয়েছে।

অজয়ের চাচা প্রশান্ত সাহা বলেন, আমরা দুই ভাই শারীরিকভাবে খুবই অসুস্থ। অজয় আমাদের চালের দোকানে বসতেন। এ সম্পর্কের বিষয়েও আমরা জানতাম না। কিভাবে কি হয়ে গেছে কিছুই বুঝতে পারছি না।

মিতার বাবা তপন লাল বলেন, মেয়েকে হারিয়ে পুরো পরিবার বাকরুদ্ধ। এসব বিষয় নিয়ে কথা বলার মতো শক্তি নেই।

এ ব্যাপারে মহিপাল হাইওয়ে থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হারুন উর রশিদ দৈনিক ফেনীকে বলেন, এ ঘটনায় একটি মামলা হয়েছে। ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন পেলে প্রকৃত ঘটনা জানা যাবে। অভিযুক্ত যুবককে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

 


সেদিন অজয়ের সঙ্গে হাসপাতালে যান কারা

এদিকে মিতার মৃত্যুর ঘটনার পর থেকে আলোচনায় অভিযুক্ত অজয়ের সঙ্গে সেদিন ফেনী জেনারেল হাসপাতালে যাওয়া দুই যুবক-যুবতী। দৈনিক ফেনীর অনুসন্ধানে উঠে এসেছে তাদের পরিচয় ও সেদিনের নানা তথ্য।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, অজয়ের সঙ্গে সেদিন হাসপাতালে যাওয়া যুবকের নাম নিশাত চন্দ্র দাস। তিনি শহরের মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ের পেছনে একটি বাসায় পরিবার নিয়ে বসবাস করছেন। অজয়ের পাশ্ববর্তী বাসা ও দোকানের সুবাদে তাদের মধ্যে ভালো সম্পর্ক রয়েছে। একইসময় হাসপাতালে ছিলেন নিশাতের স্ত্রীও।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে নিশাত চন্দ্র দাস দৈনিক ফেনীকে বলেন, অজয় আমার খুব কাছের ছোট ভাই। আমার পরিবারের সঙ্গেও তার ভালো সম্পর্ক রয়েছে। সেদিন রাত ৯টা ২০ মিনিটে আমাকে কল দিয়ে একটি মেয়ে দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে বলে জানান। আমাকে দ্রুত ফেনী জেনারেল হাসপাতালে যেতে বলেন। পথিমধ্যে জেল রোড পৌঁছালে আমার স্ত্রীর কল করে আবার বাসায় গিয়ে তাকে নিয়ে আসতে বলেন। জানতে চাইলে অজয় তাকে (নিশাতের স্ত্রী) কল দিয়ে একটি জামা নিয়ে যাওয়ার জন্য বলেছেন বলে জানান।

তিনি বলেন, পরবর্তী বাসায় গিয়ে আমার স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে হাসপাতালে পৌঁছাই। তখন হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে অজয় একটি পিকআপ ভ্যানে মিতাকে নিয়ে অবস্থান করছিল। পরে হাসপাতালের দায়িত্বরতদের সহযোগিতায় মিতাকে নামিয়ে জরুরি বিভাগে নিয়ে যাই। একপর্যায়ে মিতার ভাইও সেখানে উপস্থিত হন। তারপর তার পরিবারের সঙ্গে কথা বলে চিকিৎসকের পরামর্শে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে তাকে হাসপাতালের নতুন ভবনের চতুর্থ তলায় নিয়ে যাই। এসময়ে সার্বক্ষণিক আমার স্ত্রী মিতার পাশে থেকে সহযোগিতা করেছে। তখনও মিতা কথা বলেছিল এবং শরীরের বিভিন্ন স্থানে ব্যথার কথা জানান। একসময় আমার ব্যস্ততার কারণে সেখান থেকে অজয়সহ বাসায় ফিরে আসি।

নিশাত আরও বলেন, অজয়ের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক থাকলেও মিতার বিষয়ে তেমন জানাশোনা ছিল না। তাদের মধ্যে ভালো সম্পর্ক রয়েছে বলে জানতাম। সেদিন রাত থেকে অজয়ের সঙ্গে আর কোনো যোগাযোগ নেই। এখানে আমার বা স্ত্রীর কোনো কিছুই নেই। শুধু খবর পেয়ে সহযোগিতার উদ্দেশ্যে স্বামী-স্ত্রী হাসপাতালে গিয়েছিলাম। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যেভাবে দুই সঙ্গীকে নিয়ে লেখালেখি চলছে তাতে আমরা রীতিমতো বিব্রত।

 

 

অজয়ের ছিল না মোটরসাইকেল, তবুও..

অন্যদিকে অজয়ের মোটরসাইকেল (ফেনী-ল ১২৩৬৬৩) থেকে ছিটকে পড়ে মিতার মৃত্যুর কথা বলা হলেও এ নিয়ে চলছে নানা আলোচনা। দৈনিক ফেনীর অনুসন্ধানে জানা গেছে, অজয়ের নিজের কোনো মোটরসাইকেল ছিল না। সেদিন বিকেলে ঘুরতে যাওয়ার কথা বলে নিশাত চন্দ্র দাসের মোটরসাইকেল নিয়ে যায় অজয়। ঘটনার পর মোটরসাইকেলটি অক্ষত অবস্থায় বর্তমানে নিশাতের কাছেই রয়েছে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে নিশাত চন্দ্র দাস বলেন, শখের বসে আমি মোটরসাইকেল কিনেছিলাম। কিন্তু অসুস্থতার জন্য মোটরসাইকেল চালানো হয় না। গাড়ির একটি চাবি বাড়িওয়ালার ছেলের কাছে থাকতো। শনিবার তার কাছ থেকেই অজয় ঘুরতে যাওয়ার কথা বলে মোটরসাইকেল নিয়ে যায়। সেদিন হাসপাতাল থেকে মোটরসাইকেল নিয়ে এসেছি। গাড়ির সবকিছু আগের মতোই রয়েছে। একদম কোনো ধরনের দাগ বা ক্ষতিও হয়নি।