ফেনীর মহিপালে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচিতে হামলা ও মারধরের অভিযোগে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে আরও একটি মামলা হয়েছে। ঘটনার ৯ মাস পর গত সোমবার (৫ মে) ফেনী মডেল থানায় এ মামলা করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সংগঠক মো. আবু জাফর।
মামলায় ফেনী-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নিজাম উদ্দিন হাজারী, সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান শুসেন চন্দ্র শীল, পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাবেক পৌর মেয়র নজরুল ইসলাম স্বপন মিয়াজীসহ ৫৩ জনের নাম উল্লেখ এবং আরও ১৫০-২০০ জনকে অজ্ঞাত আসামি করা হয়েছে।
মামলার বাদী মো. আবু জাফর ফেনী সদর উপজেলার লেমুয়া ইউনিয়নের টঙ্গীরপাড় এলাকার মো. খলিল মাতব্বরের ছেলে।
এ মামলায় উল্লেখযোগ্য অন্য আসামিরা হলেন, জেলা আওয়ামী লীগের আইন বিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট শাহজাহান সাজু, সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি করিম উল্ল্যাহ বিকম, ফেনী আলিয়া মাদ্রাসার বরখাস্ত হওয়া অধ্যক্ষ মাওলানা মাহমুদুল হাসান, ফেনী পৌরসভার কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম রূপক হাজারী, জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি তোফায়েল আহমেদ তপু, সাধারণ সম্পাদক নূর করিম জাবেদ, সহ-সভাপতি দিলারা সুলতানা মিলি, জেলা যুব মহিলা লীগের সভাপতি মঞ্জিলা মিমি, বিএমএ ফেনী জেলা সভাপতি ডা. সাহেদুল ইসলাম কাওসার। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গুলি ও হামলা করতে প্ররোচনা, উসকানি এবং নির্দেশনার অভিযোগে তাদের আসামি করা হয়েছে।
এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে, গেল বছরের ৪ আগস্ট বেলা ১১টার দিকে মহিপাল ফ্লাইওভারের নিচে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন বিক্ষোভ সমাবেশ ও শান্তিপূর্ণ অবস্থান কর্মসূচির আয়োজন করে। এতে জেলার বিভিন্ন এলাকার ছাত্র-জনতার সঙ্গে মামলার বাদী আবু জাফরও অংশ নেন। সেদিন ফেনী পৌরসভা প্রাঙ্গণ থেকে নিজাম উদ্দিন হাজারী কয়েকটি ট্রাভেলিং ব্যাগ থেকে আগ্নেয়াস্ত্র বের করে প্রকাশ্যে আসামিদের হাতে তুলে দিয়ে ছাত্র-জনতার উপর হামলার নির্দেশ প্রদান করেন। পরবর্তী আসামিরা দলবদ্ধ হয়ে স্লোগান দিয়ে মহিপাল গিয়ে ছাত্র-জনতার কর্মসূচিতে এলোপাতাড়ি গুলি ও ককটেল বিস্ফোরণ করেন।
এজাহারের বর্ণনা অনুযায়ী, সেদিন আসামি মামলার বাদী আবু জাফরের বুকে, মাথায়, পিঠে ও শরীরের বিভিন্ন স্থানে উপর্যুপরি গুলি করে। তখন ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে তার মাথার ডান-বাম ও পেছনের অংশ জখম করে। একই সময় আসামিরা বিভিন্ন ধরনের দেশীয় অস্ত্র ও লাঠি দিয়ে আবু জাফরকে আঘাত করে। সেখানে তাদের ছোঁড়া গুলির ১২টি স্প্লিন্টার লেগে গুরুতর আহত হন তিনি। পরে ফেনী জেনারেল হাসপাতাল, চট্টগ্রাম ও সর্বশেষ রাজধানীর ইবনে সিনা হাসপাতালে চিকিৎসা নেন।
মামলায় অন্য আসামিদের মধ্যে রয়েছেন লেমুয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক কামরুজ্জামান তালুকদার, ফেনী ফালাহিয়া মাদ্রাসা ছাত্রলীগের সভাপতি তোফায়েল আহমেদ অপু, সাবেক পৌর কাউন্সিলর লুৎফুর রহমান খোকন হাজারী, জেলা যুবলীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি জিয়াউল আলম মিস্টার, যুবলীগ নেতা সাইফুল ইসলাম পিটু, জিয়া উদ্দিন বাবলু, সদর উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক বেলাল হোসেন, ফেনী কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি নোমান হাবিব, ফেনী পৌর ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ইয়াছিন আরাফাত রাজু প্রমুখ।
দীর্ঘ সময় পর মামলা করার কারণ প্রসঙ্গে জানতে কথা হয় বাদী মো. আবু জাফরের সঙ্গে। দৈনিক ফেনীকে তিনি বলেন, মামলা তো নিয়মিত হচ্ছে, এখনো হচ্ছে। মামলার এজাহার সাজানো ও মূল আসামিদের চিহ্নিত করতে সময় লেগেছে। এছাড়া আমি অনেকদিন ধরে অসুস্থ ছিলাম। এখানে জড়িতদের ব্যতীত অতিরিক্ত কোনো ব্যক্তিকে আসামি করা হয়নি।
এ ব্যাপারে ফেনী মডেল থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ সামসুজ্জামান বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত কেউ যদি নয় মাস পরে এসে মামলা করে সেখানে আমার কিছু বলার থাকে না। এখানে আমার প্রশ্ন করারও কোনো সুযোগ নেই। বাদী চিকিৎসাধীন থাকায় মামলা করতে বিলম্ব হয়েছে বলে জানিয়েছেন। যেহেতু এটি ফৌজদারি অপরাধ তাই বিলম্ব হলেও আইনগতভাবে কোনো জটিলতা নেই।
আ. লীগের তিন নেতা কারাগারে
শহর প্রতিনিধি
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে হতাহতের একাধিক মামলায় ফেনী জেলা আওয়ামী লীগের আইন বিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট এম শাহজাহান সাজু ও সোনাগাজী আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি অ্যাডভোকেট নাসির উদ্দিন বাহার গতকাল মঙ্গলবার (৬ মে) দুপুরে কারাগারে প্রেরণ করে আদালত। এর আগে সোমবার জেলা যুবলীগের সাংস্কৃতিক বিষয়ক সম্পাদক হুমায়ুন কবির মজুমদারকে কারাগারে প্রেরণ করে আদালত।
এ প্রসঙ্গে অ্যাডভোকেট মেজবাহ উদ্দিন ভূঞা বলেন, সোনাগাজী আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি ও জেলা ও দায়রা জজ আদালতের আইনজীবী নাসির উদ্দিন বাহার এবং উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য অ্যাডভোকেট ছোটন কংস বণিক বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একটি হত্যা মামলার আসামি হিসেবে উচ্চ আদালত থেকে জামিনে ছিলেন। জামিনের মেয়াদ শেষ হওয়ায় ২২ এপ্রিল ফেনী জেলা ও দায়রা জজ সিরাজউদ্দৌলা কুতুবীর আদালতে হাজির হয়ে তারা পুনরায় জামিনের আবেদন করেন। জেলা ও দায়রা জজ সিরাজউদ্দৌলা কুতুবী জামিনের বিষয়ে শুনানির জন্য ৬ মে দিন ধার্য করেন। একই সঙ্গে মামলার এজাহারে উল্লিখিত ঘটনার দিন দুই আসামির অবস্থান কোথায় ছিল তা নির্ধারণ করে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট থানাকে নির্দেশ দেন। পুলিশের তদন্তের রিপোর্টের আলোকে গতকাল মঙ্গলবার সকালে জেলা ও দায়রা জজ আদালতে জামিন শুনানি শেষে সোনাগাজী উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি অ্যাডভোকেট নাসির উদ্দিন বাহারের জামিন নামঞ্জুর করে জেল হাজতে পাঠানোর নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে অপর আইনজীবী ছোটন কংস বণিকের জামিন মঞ্জুর করেন।
অ্যাডভোকেট মেজবাহ উদ্দিন ভূঞা আরো বলেন, জেলা আওয়ামী লীগের আইন বিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট এম শাহ জাহান সাজুকে সোমবার সন্ধ্যায় ফেনী শহরের শহিদ মিনার সংলগ্ন তার চেম্বার থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ৪ আগস্ট মহিপালে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ফেনী সদর উপজেলার খলিল মাতব্বরে ছেলে মো. আবু জাফর আহত হয়। এই ঘটনায় সোমবার রাতে মো. আবু জাফর ফেনী মডেল থানায় বাদী হয়ে শাহজাহান সাজুসহ ৫৩ জনের নাম উল্লেখ করে মামলা দায়ের করে। ওই মামলায় সাজুকে গ্রেফতার দেখিয়ে গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে অতিরিক্ত চীফ জুড়িসিয়াল মাজিষ্ট্রেট শামসাদ বেগমের আদালতে হাজির করা হয়। পরে আদালত জেল হাজতে প্রেরণের নির্দেশ দেয়। তিনি জেলা যুবলীগ ও ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও দাগনভূঞা উপজেলার ১নং সিন্দুরপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান।
এদিকে ফেনী জেলা যুবলীগের সংস্কৃতি বিষয়ক সম্পাদক হুমায়ুন কবীর মজুমদারকে সোমবার আদালতের মাধ্যমে জেল হাজতে প্রেরণ করা হয়েছে। তাকে ফেনী শহরের সহদেবপুর এলাকার একটি বাসা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। হুমায়ুন ফেনী সদর উপজেলার কালীদহ ইউনিয়নের গোহাড়ুয়া গ্রামের মকবুল আহাম্মদের ছেলে। জেলা জেলা যুবলীগের সাংস্কৃতিক সম্পাদকের পাশাপাশি সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের ফেনী জেলা সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলেন।
ফেনী মডেল থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ সামসুজ্জামান বলেন, হুমায়নকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে মহিপালে গুলিবিদ্ধ সরোয়ার জাহান মাসুম হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতের মাধ্যমে জেল হাজতে প্রেরণ করা হয়েছে।