২৫ মার্চ রাত থেকে পাকিস্তানি হানাদারের নির্বিচারে বাঙালি নিধনের শুরু। প্রাণে বাঁচতে মানুষ শহর ছেড়ে গ্রামে, দেশে ছেড়ে সীমান্ত পাড়ি দিচ্ছিলেন। তখন একদল মানুষ ফেনীতে ঘুরে দাঁড়ালেন পাকিস্তানি হানাদারদের প্রতিরোধে। ১৯৭১ সালের ২৭-২৮ মার্চ মুক্তিকামী বাঙালি যুদ্ধ করে তৎকালীন ফেনী সিও অফিসে অবস্থান নেওয়া পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একটি দলের সাথে। আধুনিক অস্ত্রসজ্জিত পাকিস্তানি হানাদারের মুখোমুখি হয় ফেনীর ছাত্র-জনতা, ফেনী ও নোয়াখালী হতে আসা পুলিশ সদস্য, ফেনীতে অবস্থানরত অবসরপ্রাপ্ত ইপিআর ও সেনাসদস্য এবং সীমান্ত হতে এসে যুদ্ধে যোগদানকারী ইপিআর সদস্যরা। এই যুদ্ধের প্রধান পরিকল্পনাকারী তৎকালীন সংগ্রাম পরিষদ সভাপতি খাজা আহমদ।

এ যুদ্ধে অংশ নেওয়া একাধিক মুক্তিযোদ্ধার তথ্যমতে, এটি ফেনী হতে প্রথম প্রতিরোধ যুদ্ধ। এ যুদ্ধে নিহত কনস্টেবল মনিরুল হক ফেনীতে প্রথম শহিদ বীর মুক্তিযোদ্ধা। এ যুদ্ধে নিহত হয় মতান্তরে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন ফারুকীসহ ১৭ সেনাসদস্য।

ফেনীর এ প্রতিরোধ যুদ্ধের ওপর প্রত্যক্ষ প্রভাব ছিল ২৬ মার্চ নোয়াখালী জেলা শহরে উর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও জেলার রাজনৈতিক নেতাদের অংশগ্রহনে বিশেষ সভার। নোয়াখালী জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে তৎকালীন জেলা প্রশাসক মনযূর উল করীম, পুলিশ সুপার আবদুল হাকিমের সাথে জরুরি সভা করেন নোয়খালী জেলা সংগ্রাম পরিষদ। এ পরিষদের অন্যতম সদস্য ছিলেন খাজা আহমদ। এ সভায় নোয়াখালী জেলা পুলিশের তৎকালীন একাধিক থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। সভার একটি গোপন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রতিটি থানার অস্ত্রাগার উন্মুক্ত করে দেওয়া হয় (সূত্র-মুক্তিযুদ্ধে পুলিশ : নোয়াখালী জেলা)। এসময় ফেনী থানার ওসি ছিলেন মোহাম্মদ আলী।

অস্ত্রাগার উন্মুক্ত করা প্রসঙ্গে বীর মুক্তিযোদ্ধা জয়নাল আবেদীন (ভিপি জয়নাল) জানান, সিও অফিস যুদ্ধে ফেনী থানার অস্ত্রগুলো ব্যবহৃত হয়েছিল পাকিস্তানী হানাদারদের বিরুদ্ধে। আমাদের অসীম সাহস আর বীরত্বের কারণেই যুদ্ধে আমরা জয়ী হই।

বীর মুক্তিযোদ্ধা ও ফেনী সদর উপজেলা পরিষদের প্রয়াত চেয়ারম্যান আবদুর রহমান বিকম যুদ্ধ প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ২৭ মার্চের পর ২৮ মার্চ সারাদিন পাকিস্তানি আর্মিদের মাইকে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেয়া হলেও তারা আত্মসমর্পণ করেনি। বরং পাল্টা গুলিবর্ষণ করে। এরপর রাতে খড়ের আগুন দিয়ে ধোঁয়া তৈরি করে ও পাল্টা গুলিবর্ষণ করা হয়। রাতের এক পর্যায়ে বাঙালি আর্মি সদস্যরা পালিয়ে গেলেও পাকিস্তানি আর্মির পাঁচ সদস্য দ্বিধান্বিত হয়ে পড়ে। এ যুদ্ধে পালাতে গিয়ে পাকিস্তানি আর্মিরা নিহত হয়।

বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মোতালেব বলেন, প্রায় দুই রাত দুই দিন এখানে কৌশলগত ও থেমে থেমে যুদ্ধ চলে। যুদ্ধে অংশ নেন অবসরপ্রাপ্ত সামরিক ও ইপিআর সদস্য। এর সাথে ওতোপ্রতোভাবে যুক্ত ছিল ছাত্র-জনতা। পরিকল্পনায় ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা খাজা আহমদ। মূলত তার অসীম সাহস আর বুদ্ধিমত্তায় প্রথম যুদ্ধেই আমরা জয়লাভ করি।

একাধিক সাক্ষাৎকারে দেখা গেছে, দক্ষ ও হিংস্র পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে এমন যুদ্ধে জয় পাওয়া প্রায় অসম্ভব ধারণা করা হলেও পিছপা হননি খাজা আহমদ। সাবেক সংসদ সদস্য এবিএম তালেব আলী নিজের একটি লেখায় ফেনীতে প্রথম যুদ্ধ প্রসঙ্গে কিছু স্মৃতিকথা উল্লেখ করেছেন। পাকিস্তানি আর্মিদের ঘেরাও ও আক্রমণ প্রসঙ্গে তিনি খাজা আহমদের অসীম সাহসিকতার কথা উল্লেখ করেন। তাঁর লেখায়, খাজা আহমদ বলেন জনতাকে সঙ্গে নিয়ে পাক সৈন্যদের আক্রমণ করতে হবে। নিজেদের সামর্থের কথা মনে করিয়ে দিলে খাজা আহমদ বলেন, তোমার কথায় যুক্তি আছে কিন্তু আমাদের বাঁচার কোন উপকরণ নেই। হারি বা জিতি আক্রমণ চালাতেই হবে। জনতার উচ্ছ্বাস ও সংগৃহীত কয়েকটি রাইফেল, স্টেনগান, কতিপয় আর্মি, ইপিআর, মারমুখো জনতা নিয়েই আক্রমণ করবো।

মুক্তিযুদ্ধে ২ নং সাব সেক্টর কমান্ডার জাফর ইমাম সিও অফিস যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের ভূমিকা প্রসঙ্গে বলেন, মুক্তিযুদ্ধের প্রারম্ভে নোয়াখালীতে সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হলে আবদুল মালেক উকিল, খাজা আহমদ, নুরুল হক মিয়া, অধ্যাপক মোহাম্মদ হানিফ, শহীদ উদ্দিন ইস্কান্দার প্রমুখ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের ডাকে সাড়া দিয়ে পুলিশ বাহিনী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাদের মধ্যে জেলা পুলিশ সুপার আবদুল হাকিম, সিআই লুৎফর রহমান চৌধুরী, ডিআইও ওয়ান আশরাফ আলী চৌধুরী, আর আই ছদ্রতুল্লাহ খান চৌধুরী, ফেনীর ওসি মোহাম্মদ আলীর নাম উল্লেখযোগ্য (সূত্র-মুক্তিযুদ্ধে পুলিশ : নোয়াখালী জেলা)।

এ যুদ্ধে অংশ নেওয়া বীর মুক্তিযোদ্ধা হারাধন বণিক জানান, সীমান্ত এলাকা থেকে বাঙালি ইপিআর সদস্যরা এসে যোগ দেয় এ যুদ্ধে। একাধিক সূত্রে পাওয়া যায়, ২৭ মার্চ সিও অফিসে পাকিস্তানি সেনাদের প্রতিরোধের সময় ইপিআরের শালধর বাজার হতে নায়েব বাদশা মিয়া তার প্লাটুনের সদস্যদের সাথে নিয়ে যুুদ্ধে যোগ দেন। একই সময় যোগ দেন ইপিআরের নায়েব আফতাব উদ্দিন ও তার প্লাটুনের সদস্যরা।
আরেক বীর মুক্তিযোদ্ধা অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ সুপার ফারুক আহমেদ উল্লেখ করেন, ২৮ মার্চ ১৫জন ছাত্র-বন্ধুসহ এ যুদ্ধে যোগ দেই। এ যুদ্ধের পরিকল্পনায় নোয়াখালী হতে পুলিশ সদস্যদের আনা হয়। সীমান্ত থেকে বাঙালি ইপিআর সদস্যদের আনা হয়। প্রধান শক্তি হিসেবে কাজ করে স্থানীয় ছাত্র-জনতা। যুদ্ধজয়ের পেছনে তীক্ষ্ণ রণকৌশল।

বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মোতালেব জানান, এ যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ইপিআর অবসারপ্রাপ্ত কর্মককর্তা আবু আহাম্মদ, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ২৩ নম্বর আসামী ফ্লাইট সার্জেন্ট শামছুল হক, অবসরপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন আবদুর রউফ, শামছু ব্যাটালিয়নও ছিলেন।

যুদ্ধের একপর্যায়ে ভীতসন্তস্ত্র পাকিস্তানি হানাদারদের বেপরোয়া গুলিতে ৪ জন সাধারণ মানুষ নিহত হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। তবে হানাদারদের সাথে সম্মুখ যুদ্ধে দুইজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধে পুলিশ : নোয়াখালী জেলা গ্রন্থে দেখা যায়, শহীদদের একজন ছিলেন পুলিশ কনস্টেবল মোঃ মনিরুল হক। তাঁর একজন সহযোদ্ধা জানান, ২৭ মার্চ পাল্টাপাল্টি গোলাগুলির একপর্যায়ে মনিরুল হকের বুকে গুলি লাগে। কিছুক্ষণ কাতরানোর পর তার দেহ নিস্তেজ হয়ে পড়ে। এই যুদ্ধে সে প্রথম শহিদ বীর মুক্তিযোদ্ধা।

একই সূত্রে দেখা যায়, শহীদ মনিরুল হক (কনস্টেবল/১৫৯) ছিলেন নোয়াখালী পুলিশ লাইনের একজন রিজার্ভ সদস্য। ২৭ মার্চ তিনি সিও অফিস যুদ্ধে শহীদ হন। তার গ্রামের বাড়ি ছিল কুমিল্লা জেলার দেবীদ্বারের সূর্যপুর গ্রামে (ডাকঘর: সাহারপাড়)।


ছবি  : তৎকালীন সিও অফিস ভবন। বর্তমানে এটি সদর উপজেলা পরিষদ কম্পাউন্ডের মধ্যে রয়েছে/ছবি সংগৃহীত