ইলেকট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফার (ইএফটি) জটিলতায় দুই মাস ধরে বেতন উত্তোলন করতে পাচ্ছেন না মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষক ও কর্মচারীরা। ঈদের আগে বেতন বোনাস উত্তোলন করতে না পারায় বিপাকে পড়েছেন জেলার ৩ হাজার ৩০০ শিক্ষক। এতে তাদের মধ্যে ক্ষোভ ও অসন্তোষ বিরাজ করছে।

বেতন না পাওয়া শিক্ষকরা জানান, আর কিছুদিন পর ঈদ। বেতন না পাওয়ায় অনেক শিক্ষক পরিবারে ঈদের আনন্দ নেই। অন্যদিকে ৪ মার্চ যোগদানকৃত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষকরা বেতন-বোনাস পাচ্ছেন। শুধু মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বেতন বোনাস পাওয়া নিয়ে দুশ্চিন্তা রয়েছে।

মঙ্গলবার (২৫ মার্চ) এ প্রতিবেদন লিখা পর্যন্ত অনেক শিক্ষক এখন ম্যাসেজ পাননি বলে জানিয়েছেন। শিক্ষকরা ম্যাসেজ পাওয়ার অপেক্ষায় আছে। গত কয়েক মাসেরও বেশি সময় ধরে বেতনের অপেক্ষায় থাকা শিক্ষকরা আর্থিক সংকটে পড়েন। যার কারণে ঈদকে কেন্দ্র করে তারা ছেলে মেয়েদের জন্য ঈদের কেনাকাটা করতে পারছে না।

ফেনী জেলা শিক্ষক সমিতির সদস্য সচিব ও ফকিরহাট আবু বক্কর উচ্চ বিদ্যলয়ের প্রধান শিক্ষক মোহাং আলমগীর হোসেন চৌধুরী ক্ষোভ প্রকাশ করে দৈনিক ফেনীকে বলেন, গত ডিসেম্বর বেতন পেয়েছিলাম। এরপর থেকে আর বেতন পাইনি। ইলেকট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফার সমস্যার সমাধান করতে পারেননি। এ জটিলতায় বেতন না পেয়ে শিক্ষকরা তাদের পরিবার-পরিজন নিয়ে কষ্টে দিন পার করছেন। ঈদের আগে বেতন-বোনাস পাওয়ার সম্ভবনা নেই। আমাদের বিদ্যালয়ে ১৮ শিক্ষক জানুয়ারি মাস থেকে বেতন-বোনাস পায়নি। যার কারণে শিক্ষকদের মাঝে ঈদের আনন্দ নেই।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক প্রধান শিক্ষক বলেন, কোনো তথ্যগত অসংগতির কারণে ইএফটিতে বেতন না দিতে পারলে আগের পদ্ধতিতে পরিশোধ করা হোক। পরে তথ্য সংশোধন সাপেক্ষে ইএফটিতে দেওয়া যেতে পারে।

এ ব্যাপারে ফেনী জনতা ব্যাংকের এক কর্মকর্তা বলেন, এটি টেকনিক্যাল সমস্যা। ইএফটিতে বেতন চালু হওয়ায় অনেক শিক্ষক ভুল করে অনলাইনে না দিয়ে নরমাল দেওয়ায় এ সমস্যা হচ্ছে।

ফেনী জেলা শিক্ষক সমিতির সভাপতি মোঃ হারুন অর রশীদ ভূইয়া বলেন, ইএফটি জটিলতার কারণে আমাদের বিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক বেতন পাচ্ছে না। আশা করি দ্রুত এই সমস্যার সমাধান হবে।

এ ব্যাপারে ফেনী জেলা শিক্ষক সমিতির নেতারা বলেন, রোজার মাস চলছে আর কয়েক দিন পর ঈদ। এ অবস্থায় সামান্য বেতন পাওয়া শিক্ষকরা কষ্টে দিন পার করেছেন। শিক্ষক-কর্মচারীদের দুর্বিষহ অবস্থা ছিল। অথচ কথা দেওয়া হয়েছিল, আইবাস ডাবল প্লাস সফটওয়্যারে ইলেকট্রনিকস ফান্ড ট্রান্সফারের (ইএফটি) মাধ্যমে শিক্ষক-কর্মচারীরা প্রত্যেক মাসের শুরুতেই বেতন-ভাতা পাবেন।
অন্যদিকে, শিক্ষকদের বেতন না পাওয়ার কষ্টের মাঝে নতুন আতঙ্ক হিসেবে হাজির হয়েছে ইএফটি তথ্য সংশোধন। মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি)-এর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ভুলে সার্ভারে উঠেছে ভুল তথ্য, আবার তা সংশোধনে বিলম্বের কারণও মাউশির গাফিলতি। অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষকরা সঠিক তথ্য দিলেও মাউশির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তা সার্ভারে তুলতে গিয়ে ভুল করেছেন। এ কারণে ইএফটির তথ্যের সঙ্গে এমপিওর তথ্য, এনআইডির তথ্য এবং ব্যাংকের তথ্যে গরমিল দেখা দিয়েছে।

 


‘এসএমএসের’ অপেক্ষায় মাধ্যমিক শিক্ষকরা
আসন্ন ঈদকে সামনে রেখে যখন সবাই কেনাকাটায় ব্যস্ত, তখন বেতন পাওয়ার আশায় এসএমএসের অপেক্ষায় দিন কাটাচ্ছেন ফেনীর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। ইলেকট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফার (ইএফটি) জটিলতার কারণে এখনো তাদের বেতন হস্তান্তর হয়নি, ফলে ঈদের আনন্দের বদলে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন তারা।

ফেনী সদর উপজেলার ছনুয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক এনামুল হক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে এক পোস্টে লেখেন, ‘বেতন পেতে ম্যাসেজ পাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছি।’’

শুধু এনামুল হক নন, তার মতো আরও অনেক শিক্ষক ও কর্মচারী একই পরিস্থিতির মুখোমুখি। তারা বলছেন, সামনে ঈদ, অথচ বেতন না পাওয়ায় পরিবারের প্রয়োজনীয় খরচ মেটানো কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষক জানান, ইএফটি জটিলতার কারণে কয়েক মাস ধরে বেতন পেতে দেরি হচ্ছে। এর ফলে আমাদের জীবিকা নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকতে হচ্ছে।

একই প্রসঙ্গে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেকজন শিক্ষক বলেন, গত কয়েক মাস ধরে বেতন বন্ধ রয়েছে। এখন শুধু বেতনের মেসেজের অপেক্ষায় আছি। বেতন পেলেই ঈদের কেনাকাটা শুরু করবো, কিন্তু সেই মেসেজ কবে আসবে, তা অনিশ্চিত।



‘বেতন পাচ্ছেন অল্প কিছু শিক্ষক’
ফেনীতে কিছু শিক্ষক বেতন পাচ্ছেন না, এমনটি স্বীকার করেছেন জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মো. শফী উল্লাহ। তিনি জানান, ইলেকট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফার (ইএফটি) জটিলতার কারণে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। অনেক শিক্ষক বেতন পাচ্ছেন, তবে যাদের নাম, মোবাইল নম্বর অথবা এনআইডি কার্ডে ভুল রয়েছে, তারা এখনও বেতন পাননি। যাদের তথ্য সংশোধন হয়েছে, তারা বেতন পাচ্ছেন।

জেলা সহকারী শিক্ষা অফিসার নাসির উদ্দিন আশরাফী বলেন, ফেনীতে প্রায় ৩৩ হাজার মাধ্যমিক শিক্ষক রয়েছেন, এর মধ্যে ৫০ শতাংশ শিক্ষক বেতন পাচ্ছেন। যাদের ইএফটি সংশোধন করা হয়েছে, তারা ঈদের আগেই বেতন পাবেন। ২০ মার্চ পর্যন্ত সংশোধনের সময় দেওয়া হয়েছে। সংশোধন সম্পন্ন হলে সকল শিক্ষক তাদের বেতন ও বোনাস পাবেন।

 

 


প্রথম মাসেই বেতন-বোনাস পেলেন প্রাথমিকের নবীন শিক্ষকরা
ফেনীর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সদ্য নিয়োগ পাওয়া সহকারী শিক্ষকরা প্রথম মাসেই বেতন ও বোনাস পাচ্ছেন। নবনিযুক্ত ১১৯ জন শিক্ষক ইতোমধ্যে তাদের বেতন ও উৎসব ভাতা উত্তোলন করেছেন, যা তাদের ঈদ উদযাপনকে আরও আনন্দময় করে তুলবে বলে জানিয়েছেন জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ফিরোজ আহাম্মদ। তিনি জানান, নবনিযুক্ত শিক্ষকদের যোগদানের তারিখ থেকেই তাদের বেতন কার্যকর হয়েছে। জেলার বিভিন্ন উপজেলায় নিয়োগ পাওয়া শিক্ষকরা ইতোমধ্যে বেতন উত্তোলন করেছেন।

জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা যায়, ফেনীতে মোট ১২৪ জন নতুন শিক্ষক যোগদানের জন্য মনোনীত হলেও এখন পর্যন্ত ১১৯ জন তাদের কার্যক্রম শুরু করেছেন। ফেনী সদরে ৭ জনের মধ্যে ৬ জন, সোনাগাজীতে ৪৫ জনের মধ্যে ৪২ জন, দাগনভূঞায় ২২ জনের মধ্যে ২১ জন, ছাগলনাইয়ায় ১৫ জন, ফুলগাজীতে ১৫ জন এবং পরশুরামে ২০ জন শিক্ষক ইতোমধ্যে দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন।

ফেনীতে সহকারী শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকারী এনামুল হক দৈনিক ফেনীকে বলেন, অনেক আন্দোলন সংগ্রামের পর আদালতের রায়ের পর তারা চাকুরিতে যোগদান করার সুযোগ পেয়েছে। চাকুরী প্রথম বেতন দিয়ে ঈদের আনন্দ উদযাপন করতে তাদের কাছে বড় আনন্দের বিষয়। তিনি জেলা, উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তাদের ধন্যবাদ জানান।

প্রসঙ্গত, নবনিযুক্ত এই শিক্ষকরা দীর্ঘ ২৬ দিন আন্দোলনের পর সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের রায়ের মাধ্যমে নিয়োগ পেয়েছেন। সরকারি নির্দেশে ৩ মার্চ থেকে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এই নিয়োগ কার্যক্রম বাস্তবায়ন শুরু করেন।

ফেনীতে সহকারী শিক্ষক নিয়োগের লিখিত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয় ২০২৪ সালের ২৯ মার্চ। ওই বছরের ২২ এপ্রিল পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হলে প্রায় ৯০০ জন প্রার্থী উত্তীর্ণ হন। পরে ১৪ মে থেকে ৮ জুন পর্যন্ত মৌখিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে ১৩৭ জন প্রার্থী চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত হন। কিন্তু তাদের মধ্যে ১৩ জন ইতোমধ্যে অন্যত্র চাকরিতে যোগ দেওয়ায় বর্তমানে ১২৪ জনের নিয়োগ কার্যকর রয়েছে।