মুহুরী কহুয়া নদী বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মাণে ৪ হাজার ৬৩৫ দশমিক ৩৯ কোটি টাকার খসড়া প্রস্তাবনা তৈরি করা হয়েছে। এ প্রস্তাবনায় যুক্ত হয়নি প্রয়োজনীয় ভূমি অধিগ্রহণ ব্যয়। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও বিশ্লেষকের মতে অধিগ্রহণসহ প্রকল্প ব্যয় দশ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে। গতকাল শনিবার (১৫ মার্চ) সকালে শহরের গ্র্যান্ড সুলতান কনভেনশন হলে মুহুরী কহুয়া বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ, পানি নিষ্কাশন ও সেচ প্রকল্পের পুনর্বাসন সমীক্ষার খসড়া প্রতিবেদন উপস্থাপন ও মতবিনিময় অনুষ্ঠিত হয়। এতে প্রস্তাবিত খসড়া প্রকল্পে সম্ভাব্য ব্যয় সংক্রান্ত তথ্যটি উপস্থাপন করা হয়।
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের উদ্যোগে এবং ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিং (আইডব্লিউএম) ও সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল এন্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিসেস (সিইজিআইএস) এর যৌথ সহযোগিতায় এই আয়োজন করা হয়। এতে মুহুরী-কহুয়া বন্যা নিয়ন্ত্রণ, পানি নিষ্কাশন এবং সেচ ব্যবস্থা প্রকল্পের পুনর্বাসনের সম্ভাব্যতা সমীক্ষার প্রস্তাবিত অবকাঠামো পরিকল্পনা এবং সামাজিক ও পরিবেশগত প্রভাব বিষয়ে তথ্য উপস্থাপন করা হয়।
ভূমি অধিগ্রহণ ব্যতিত বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ পুননির্মাণ, নদীর ভাঙনকবলিত তীর সংরক্ষণ, জলাধার পুনঃখনন, রেগুলেটর তৈরিসহ ১০ খাতে ৪ হাজার ৬৩৫ দশমিক ৩৯ কোটি টাকা প্রস্তাবিত ব্যয় উল্লেখ করা হয়। এরমধ্যে বর্তমান বাঁধে গাছ, ঝোপঝাড় দূরীকরণে ধরা হয়েছে প্রায় ৪৬ কোটি টাকা।
প্রস্তাবিত প্রকল্পের কারিগরি সমীক্ষা প্রসঙ্গে তথ্য উপস্থাপন করেন আইডব্লিউএম এর পরিচালক তরুণ কান্তি মজুমদার। তিনি উল্লেখ করেন, গত দুই বছরের সমীক্ষায় প্রকল্প এলাকার আয়তন ৫৫৭ বর্গ কিলোমিটার। প্রকল্প এলাকায় খাল রয়েছে ১৮৪টি, দৈর্ঘ্য ৫০০ কিলোমিটার। গতবছর বন্যায় মুহুরী-কহুয়া-সিলোনিয়া নদী বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ১০২ স্থানে ভাঙন সৃষ্টি হয়েছিল। নদীগুলোতে পানি ধারণ ক্ষমতা কম, অপরিকল্পিত বালু উত্তোলনসহ নানা কারণে ভয়াবহ বন্যার সৃষ্টি হয়। প্রকল্পের শেষ স্থান ধরা হয়েছে মুহুরী রেগুলেটর, যেখানে ২০ ব্যান্ডের আরও একটি রেগুলেটরের প্রস্তাব করা হয়েছে। খাল খনন, নদী খনন, জলাধার তৈরিসহ বিভিন্ন কারিগরি দিক উপস্থাপনায় তুলে ধরা হয়েছে।
খসড়া প্রস্তাবনার গণশুনানিতে বিভিন্ন নেতিবাচক দিক ও প্রশ্ন তুলে ধরেন প্রকল্প সংশ্লিষ্ট একাধিক ব্যক্তি। এ প্রসঙ্গে ছাত্র প্রতিনিধি ও গবেষক কাওসার হামিদ মুন্না মতামত প্রকাশ করে বলেন, বন্যা নিয়ন্ত্রণে বৃহৎ প্রকল্পটির প্রস্তাবনা উজান থেকে শুরু হয়ে মুহুরী রেগুলেটরে শেষ করা হয়েছে। এটি আরও দীর্ঘ করে সন্দ্বীপ চ্যানেল পর্যন্ত নেওয়া প্রয়োজন। জানতে পেরেছি উড়িরচরে একটি বৃহৎ বরাদ্দের ড্যাম তৈরির এমওইউ স্বাক্ষরের অপেক্ষায়। এটি বাস্তবায়িত হলে আমাদের উপকূলে ব্যাপক পলি জমার শঙ্কা রয়েছে অথবা, এর পরিণতি মডেল প্রকল্প করে দেখতে হবে। তা না হলে উজান থেকে পানি নেমে এসে সাগরে যেতে বাধাপ্রাপ্ত হলে আমরা জলমগ্ন হব। একইসাথে নির্বিচারে মাটিকাটার ফলে ভূমি নিচু হচ্ছে।
তিনি বলেন, প্রকল্প এলাকায় ১৮৪টি খালের দৈর্ঘ্য ৫০০ কিলোমিটার উল্লেখ করা হয়েছে। অথচ প্রকল্প প্রস্তাবনায় ২১টি খালের ৪৮ কিলোমিটার খননের কথা বলা হচ্ছে। যেহেতু প্রকল্পটি বাঁধ ছাড়াও সেচ ব্যবস্থাপনার কথা বলা হয়েছে তাই সকল খাল এর আওতাভুক্ত না হলে সেচ ব্যবস্থা ব্যহত হবে। প্রায় ৬০০ কোটি টাকার প্রশ্নবিদ্ধ প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলেও কৃষক সেচ সুবিধা পাবে না। ছাগলাইয়া-শুভপুর প্রকল্পের আওতাধীন হলেও ফেনী নদী প্রসঙ্গে কোন পরিকল্পনা দেখা যায়নি। ফেনী নদী হতে নির্বিচারে বালু উত্তোলনে ক্ষতি সমাধানে করণীয় বলা হয়নি। তাছাড়া ভারতের সাথে চুক্তি না হওয়ায় মুহুরী কুহুয়া ও সিলোনিয়া নদীর সাড়ে ৬ কিলোমিটার সীমান্তবর্তী অংশে বাঁধ নির্মাণ, নদী প্রশস্তকরণ কিংবা কী উপায়ে সংস্কার হবে তা স্পষ্ট নয়।
একই প্রসঙ্গে মুহুরী আধুনিক সেচ প্রকল্পের কৃষক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক মাইন উদ্দিন আহমেদ কামরান বলেন, সমীক্ষায় কৃষক সমিতির কোন বক্তব্য নেওয়া হয়নি, কৃষকের মতামতকে অগ্রাহ্য করা হয়েছে।
মতবিনিময়ে জেলা ছাত্রপ্রতিনিধি ওমর ফারুক বলেন, অবৈধ বালু উত্তোলনের ফলে ছাগলনাইয়ার শুভপুর নদীর আকার বিকৃত হয়েছে। পাশাপাশি ফুলগাজী পরশুরাম ছাগলনাইয়ার স্থানীয় জনগণ ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে, যা সমাধানের ক্ষেত্রে ইসিএ তথা ইকোলজিকাল ক্রিটিক্যাল এরিয়া ঘোষণা করা প্রস্তাব করছি।
পানিসম্পদ গবেষণাভিত্তিক বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা সিইজিআইএস কর্মকর্তা নওশিন তাবাসসুম বাঁধ, সেচ প্রকল্পের বিষয়ে পরিবেশ ও সামাজিক প্রভাব বিষয় তথ্য উপস্থাপন করেন। তিনি উল্লেখ করেন, ফেনী নদীর ধারণ ক্ষমতা কমেছে এবং দ্রুত দিক পরিবর্তন হয়েছে। সোনাগাজী উপকূলে মাছের ঘেরের কারণে দ্রুত গতিপথ পরিবর্তন হয়েছে। এতে জলাধারের আয়তন কমেছে। ২০০৩ সালে ২৭০ হেক্টর মাছের ঘের থাকলেও ২০২৪ সালে তা বেড়ে ৩ হাজার ৪৫৪ হেক্টরে দাঁড়িয়েছে। ফলে উজান থেকে আসা পানি দ্রুত সরতে পারছে না।
মতবিনিময়ে স্বাগত বক্তব্য রাখেন প্রকল্প পরিচালক শরীফুল আলম। সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (পূর্বাঞ্চল, কুমিল্লা)।
অনলাইনে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব নাজমুল আহসান। তিনি বলেন, বন্যানিয়ন্ত্রণে বাঁধ নির্মাণ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন জরুরি। এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (পরিকল্পনা অনুবিভাগ) মোহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, প্রস্তাবিত প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হলে ভূমি অধিগ্রহণ করতে হবে। এক্ষেত্রে স্থানীয়দের স্বপ্রণোদিত হয়ে এগিয়ে আসতে হবে।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (উন্নয়ন অনুবিভাগ) ড. আ.ন.ম বজলুর রশিদ বলেন, যে সমীক্ষা করা হয়েছে তা তুলে ধরার উদ্দেশ্য হল, অংশীজনের মতামত পাওয়া। সমীক্ষার চূড়ান্ত প্রতিবেদনে তা প্রতিফলিত হবে।
অনলাইনে বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের মহাপরিচালক (পূর্ব রিজিয়ন) মো. এনায়েত উল্লাহ।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিকল্পনা, নকশা ও গবেষণা) মো. জহিরুল ইসলাম বলেন, ফেনীর ভয়াবহ বন্যার ক্ষতি রোধে বৃহৎ প্রকল্পের পরিকল্পনা করা হয়েছে। যেসব মতামত এসেছে বিবেচনায় আনা হবে।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলাম বলেন, পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা সম্পর্কিত স্থানীয় কমিটির সাথে মতবিনিময় করার প্রয়োজন রয়েছে। উড়িরচরে প্রস্তাবিত ড্যাম তৈরি হলে ফেনী উপকূলে প্রভাব খতিয়ে দেখতে হবে। ফেনী নদীতে অবৈধ বালু উত্তোলনরোধে সমন্বিত ভূমিকার প্রয়োজন রয়েছে।
কর্মশালায় বক্তব্য রাখেন পরশুরাম পৌরসভার সাবেক মেয়র আবু তালেব, সাংবাদিক নাজমুল হক শামীম, এনজিও প্লাস এর নির্বাহী পরিচালক জোহরা আক্তার রুমা, নদী তীরবর্তী ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার মানুষজন।
কর্মশালায় জানানো হয় প্রকল্পের প্রস্তাবিত ব্যয় ধরা হয়েছে ১২৬ দশমিক ৭ কিলোমিটার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাদ পুনঃনির্মাণ ২৭৬৩ দশমিক ৩৯ কোটি, ভাঙ্গন কবলিত স্থানে নদীর তীর সংরক্ষণ ২২৫ দশমিক ৫৪ কোটি, নদীখাল জলধার পূনঃখনন ৬৪৪ দশমিক ৮৮ কোটি, পানি নিষ্কাশন কাঠামো রেগুলেটর নির্মাণ ৯৫ কোটি, হাইড্রোলিক এলিভেটেড ড্যাম নির্মাণ ৫শ কোটি, ফ্ল্যাড বাইপাস/ফিউজ নির্মাণ ২৭ দশমিক ২০ কোটি, সেচ ইন্টেল নির্মাণ সাড়ে ৬ কোটি, বিদ্যমান অবকাঠামো পুনঃনির্মাণ ৭ দশমিক ৬৫ কোটি, গাছ ঝোপঝাড় দূরীকরণ ৪৫ দশমিক ৮৪ কোটি ও লুককাট ৯ দশমিক ৬৬ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে।
মতবিনিময় ও কর্মশালায় বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, জেলা প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, কৃষি বিভাগের কর্মকতাসহ বিভিন্ন দপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, গণমাধ্যম কর্মী ও নদী পাড়ের ক্ষতিগ্রস্ত গ্রামবাসীদের প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন।