ফেনীতে ভোগ্য পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণে সরকারি দপ্তরগুলো কাজ করলেও সংশ্লিষ্ট দপ্তর ও পরীক্ষাগারের অভাবে মান নিয়ন্ত্রণে সংশয় কাটছে না। সাধারণ ভোক্তারা বলছেন, অভিযান হয়, জরিমানাও হয়, তবে পণ্যের মান নিয়ে অসন্তোষ রয়ে গেছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, ফেনীতে যদি সংশ্লিষ্ট দপ্তর থাকত বা পণ্যের মান পরীক্ষা করার জন্য একটি ল্যাবরেটরি স্থাপন করা হত, তাহলে এ সমস্যাগুলো সহজেই সমাধান করা যেত।

বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই) হতে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণে গত বছরে ফেনীতে মোট ২২টি অভিযান পরিচালিত হয়, যার মধ্যে ১৭টি প্রতিষ্ঠানকে ৫ লাখ ৬৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। জরিমানা করা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে বেশিরভাগ বেকারি ও মিষ্টান্ন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান। তবে অভিযানের পরও ফেনীতে তৈরি ভোগ্যপণ্যের মান নিয়ে ভোক্তাদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা যাচ্ছে।

ভোক্তারা জানান, অভিযান পরিচালনা করা হলেও ফেনীতে তৈরি ভোগ্যপণ্যের মান পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার জন্য বিএসটিআইয়ের কোনো নির্দিষ্ট দপ্তর ও ল্যাবরেটরি নেই যার কারণে পণ্যে মান নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সংশয় থেকেই যায়।

একই কথা বলছে ফেনীতে ভোগ্যপণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। তাদের দাবি, পণ্যের মান বজায় রাখতে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা করেন তারা। ফেনীতে যদি বিএসটিআইয়ের দপ্তর এবং উন্নত মানের ল্যাব সুবিধা থাকত তাহলে পণ্যের মান যাচাই ও নিশ্চিতকরণ প্রক্রিয়া আরও সহজতর এবং কার্যকর হত। এতে পণ্য দিয়ে ভোক্তাদের সংশয় দূর হত।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ফেনীর একটি প্রতিষ্ঠানের পরিচালক বলেন, পণ্য উৎপাদনে আমরা সর্বোচ্চ মান বজায় রাখার চেষ্টা করি। তবে, স্থানীয়ভাবে বিএসটিআইয়ের কোনো ল্যাবরেটরি বা অফিস না থাকায় মান পরীক্ষা করার জন্য আঞ্চলিক অফিসে আবেদন করতে হয়। সেখানে পণ্যের মান যাচাই করে সনদ দেওয়া হয়। কিন্তু এটি সময়সাপেক্ষ এবং ব্যয়সাপেক্ষ, যা ছোট ও মাঝারি আকারের উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য চ্যালেঞ্জের বিষয়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক প্রতিষ্ঠানের পরিচালক বলেন, মানহীন পণ্য উৎপাদন আমাদের উদ্দেশ্য নয়। তবে, অনেক সময় পণ্যের মান নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় পরীক্ষা করা সম্ভব হয় না। ফেনীতে যদি সংশ্লিষ্ট দপ্তর থাকত বা পণ্যের মান পরীক্ষা করার জন্য একটি ল্যাবরেটরি স্থাপন করা হত, তাহলে এ সমস্যাগুলো সহজেই সমাধান করা যেত।

এ প্রসঙ্গে বিএসটিআই নোয়াখালী আঞ্চলিক কার্যালয়ের উপপরিচালক (রসায়ন) ও অফিস প্রধান শেখ মাসুম বিল্লাহ দৈনিক ফেনীকে বলেন, বিএসটিআইয়ের অভিযান পরিচালনার সময় জেলা প্রশাসনসহ বিএসটিআইয়ের অন্যান্য কর্মকর্তারা মিলে অভিযান পরিচালনা করে থাকে। যদিও কিছু নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে লক্ষ্য করে অভিযান পরিচালিত হয়, তবে ঢালাওভাবে অভিযান পরিচালনা করা সম্ভব হয় না। যদি বিএসটিআইয়ের নিজস্ব ম্যাজিস্ট্রেট ও বাহিনী থাকত তাহলে এটি সহজতর হত।

উপপরিচালক আরও বলেন, নোয়াখালী অঞ্চলে জেলা বা উপজেলা পর্যায়ে ল্যাবরেটরি স্থাপন করা হলে পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণ আরো কঠোরভাবে করা সম্ভব হত। তবে এ বিষয়ে জেলা প্রশাসন বা বিভাগীয় প্রশাসন কিছু করতে পারবে না কারণ এটি মন্ত্রণালয়ের আওতায়।

সামাজিক সংগঠক আসাদুজ্জামান দারা বলেন, ফেনী একটি ছোট জেলা হলেও এখানে বিভিন্ন ভোগ্যপণ্য উৎপাদিত হয়। এ কারণে বিএসটিআইয়ের একটি জেলা অফিস স্থাপন অত্যন্ত জরুরি। যদি ল্যাব ফ্যাসিলিটিরও ব্যবস্থা নিশ্চিত করা যায় তাহলে স্থানীয় উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো মানসম্মত পণ্য তৈরিতে আরও সচেতন ও সজাগ হবে।

সাজ্জাদুল ইসলাম একজন ভোক্তা বলেন, ফেনীতে মান নিয়ন্ত্রণের জন্য অভিযান পরিচালনা করা হলেও, এখানে এমন কোনো নির্দিষ্ট দপ্তর নেই যা ফেনীতে উৎপাদিত বিভিন্ন পণ্যের মান পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে সক্ষম। ফেনী বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ জেলা যেখানে বেশ কিছু উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানগুলোর তৈরি পণ্যের গুণগত মান নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি কার্যকরী সুষ্ঠু মান নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গড়ে তোলা প্রয়োজন।

নূরুল হুদা নামের আরেক ভোক্তা বলেন, অভিযান হয়, জরিমানাও হয়, তবে মানহীন পণ্যে তো কমছে না। প্রত্যেক পণ্যে এখন ভেজাল। ভেজাল ও মানহীন পণ্যে নিয়ন্ত্রণ করতে সরকারের তৈরি দপ্তরগুলোর জেলা ও উপজেলা ভিত্তিক কার্যক্রম আরও বাড়ানো উচিত। তিনি আরও বলেন, আমার জানামতে বিএসটিআই আঞ্চলিক কার্যালয়গুলো একসাথে অনেকগুলো জেলায় অভিযান করে থাকে যার কারণে তারা একসাথে ভেজাল ও মানহীন পণ্যে নিয়ন্ত্রণ করতে হিমশিম খায়। কাজেই মানহীন পণ্যে নিয়ন্ত্রণ করতে ফেনীসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ জেলায় এসব দপ্তরগুলো প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন।



বেকারি ও মিষ্টান্ন পণ্যে জরিমানা হয়েছে বেশি
ফেনী জেলায় ২০২৪ সালে বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই) কুমিল্লা ও নোয়াখালী কার্যালয় মোট ৪০টি অভিযান পরিচালনা করে ৩৬টি প্রতিষ্ঠানকে ৮ লাখ ৫৭ হাজার টাকা জরিমানা করেছে। বিএসটিআই সূত্রে জানা গেছে, জরিমানা করা প্রতিষ্ঠানগুলোর বেশিরভাগই বেকারি ও মিষ্টান্ন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান।

বিএসটিআই হতে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত বিএসটিআইয়ের কুমিল্লা কার্যালয় ১০টি ওজন পরিমাপ নিয়ন্ত্রণ অভিযানে ১০টি প্রতিষ্ঠানকে ২ লাখ ৩২ হাজার টাকা জরিমানা করে। একই সময়ে পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণ অভিযানে ১১টি অভিযান চালিয়ে ৭টি প্রতিষ্ঠান থেকে ২ লাখ ৭৫ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করা হয়। এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত বিএসটিআইয়ের নোয়াখালী কার্যালয় ১০টি ওজন পরিমাপ অভিযানে ১১টি প্রতিষ্ঠানকে ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করে। এসময় পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণে ১১টি অভিযানে ১০টি প্রতিষ্ঠান থেকে ২ লাখ ৯০ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করা হয়।

বিএসটিআই কুমিল্লা কার্যালয়ের উপপরিচালক কে এম হানিফ জানান, ২০২৩ সালে মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত পরিচালিত ৩৪টি অভিযানে এসব জরিমানা করা হয়।

বিএসটিআই নোয়াখালী কার্যালয়ের উপপরিচালক শেখ মাসুম বিল্লাহ বলেন, প্রশাসনের সহায়তায় ফেনীতে মাসে ২-৩টি অভিযান পরিচালনা করা হয়। মাঝে মাঝে বিশেষ অভিযানও পরিচালিত হয়।

এর আগে, ২০২৩ সালে বছরজুড়ে ফেনী জেলায় ৩৪টি অভিযান পরিচালনা করে ৩৬টি প্রতিষ্ঠান থেকে ৬ লাখ ৩ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছিল।