ফেনীতে ফসলি জমির মাটি কাটার হালচাল

ইটভাটা সংশ্লিষ্টদের তথ্যমতে, চাহিদা আরও বেশি থাকলেও গতবছর ফেনীতে পোড়ানো হয়েছে প্রায় ৫০ কোটি ইট। প্রতি ঘনফুট মাটি থেকে তৈরি হয় ১০টি ইট। ৫০ কোটি ইট তৈরিতে পোড়ানো হয় প্রায় ৫ কোটি ঘনফুট মাটি। ইটভাটার জন্য মাটি সংক্রান্ত নির্দেশনায় বলা হয়েছে, প্রয়োজনীয় মাটি সংগ্রহ করতে হবে পুকুর, খাল খনন কিংবা পতিত স্থান হতে। তবে ইটভাটায় প্রয়োজনীয় মাটি এসব উৎস হতে কখনোই চাহিদা মেটেনি বলে নিশ্চিত করেছে একাধিক সূত্র।

জেলা ইটভাটা মালিক সমিতি সূত্রে জানা গেছে, ফেনীতে বর্তমানে ৭০টি ইটভাটা চালু রয়েছে। জেলায় মোট শতাধিক ইটভাটা থাকলেও বাকিগুলোতে বিভিন্ন কারণে কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। এই সমিতির সভাপতি জাফর উদ্দিন দাবি করেন, ইটভাটার প্রয়োজনীয় মাটি বিভিন্ন পুকুর এবং অনুমোদিত স্থান হতে সংগ্রহ করা হয়ে থাকে। মানুষ এখন মৎস্য চাষে ঝুঁকছে। সেখান থেকেও মাটি সরবরাহ হয়ে থাকে। তবে, বর্তমানে মাটির সংকট তীব্রতর। ইটভাটায় মাটি সরবরাহের পথ আরও সহজতর না হলে এই শিল্প অস্তিত্ব সংকটে পড়বে।

পুকুর খনন প্রসঙ্গে জেলা মৎস্য বিভাগ হতে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, ফেনীতে পুকুরের সংখ্যা ২৪ হাজার ৩৩২টি। প্রতি বছর কতগুলো পুকুর খনন করা হচ্ছে সেই তথ্য মৎস্য বিভাগে না থাকলেও কার্যালয় সূত্র জানায়, বছরে উল্লেখযোগ্য পুকুর খনন হয় না।


একদিকে উন্নয়ন কাজে ইট বিকল্পহীন, অন্যদিকে পরিবেশের ভারসাম্য এবং ফসলি জমি হ্রাস রোধ করার বিষয়টি দায়িত্বশীল দপ্তরগুলোর জন্য চ্যালেঞ্জ মনে করছেন নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক কর্মকর্তা।

ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন সংশোধিত আইন- ২০১৮তে বলা হয়েছে, জেলা প্রশাসকের অনুমোদনক্রমে কোনো ব্যক্তি ইট প্রস্তুত করবার উদ্দেশ্যে মজা পুকুর বা খাল বা বিল বা খাঁড়ি বা দিঘি বা নদ-নদী বা হাওর-বাওড় বা চরাঞ্চল বা পতিত জায়গা হতে মাটি কাটতে বা সংগ্রহ করতে পারবেন। তবে শর্ত থাকে যে, ইটভাটার লাইসেন্সের জন্য আবেদনপত্রে প্রস্তাবিত ইটভাটার মালিক কর্তৃক ইট প্রস্তুতের মাটির উৎস উল্লেখপূর্বক হলফনামা দাখিল করতে হবে।

ইট তৈরিতে মাটি ব্যবহার কমাতে একই আইনে আরও বলা হয়েছে, ইটের কাঁচামাল হিসাবে মাটির ব্যবহার হ্রাস করবার উদ্দেশ্যে সরকার, সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা, নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে ইটভাটায় উৎপাদিত ইটের একটি নির্দিষ্ট হারে ছিদ্রযুক্ত ইট ও ব্লক প্রস্তুতের জন্য নির্দেশনা জারি করতে পারবে।

ইটভাটা লাইসেন্স প্রদান ও নবায়ন এবং ফসলি জমির মাটি কাটা প্রসঙ্গে জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলাম বলেন, সুনির্দিষ্ট শর্তের মাধ্যমে ইট ভাটার অনুমোদন এবং লাইসেন্স নবায়ন করা হয়ে থাকে। পুকুর, খাল খনন কিংবা পতিত স্থানসহ মাটি সংগ্রহের সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। যে কারণেই হোক, ফসলি জমির মাটি কাটলে কিংবা আইন ভাঙলে মামলা, সাজা, জরিমানার বিধান রয়েছে। ফসলি জমির মাটি কাটার অপরাধে নিয়মিত অভিযান চলছে। এসব অপরাধে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা সবসময় নেওয়া হচ্ছে।


২.

শুষ্ক মৌসুমে রমরমা মাটি ব্যবসা
বছরে কমছে এক শতাংশ আবাদি জমি

 

গত ১০ বছরে ফেনীতে আবাদি জমির পরিমাণ কমেছে ৬ হাজার ৩৭০ হেক্টর। ২০১২ সালে ফসলি জমির পরিমাণ ছিল প্রায় ৭৬ হাজার হেক্টর, ২০২২ সালে তা নেমে আসে ৬৯ হাজার হেক্টরে।


বিভিন্ন প্রয়োজনে মাটির চাহিদা বেড়েছে। চাহিদার সাথে সাথে মাটির দামও বেড়েছে। ফলে ফসলি জমির ওপর এর প্রভাব প্রকট হয়েছে, এমন তথ্য মিলেছে মাঠপর্যায়ে কৃষকের সাথে কথা বলে।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, গত ১০ বছরে ফেনীতে আবাদি জমির পরিমাণ কমেছে ৬ হাজার ৩৭০ হেক্টর। ২০১২ সালে ফসলি জমির পরিমাণ ছিল প্রায় ৭৬ হাজার হেক্টর, ২০২২ সালে তা নেমে আসে ৬৯ হাজার হেক্টরে। তবে একই তথ্যে দেখা গেছে, প্রযুক্তিগত উন্নয়নের কারণে উৎপাদন বেড়েছে ঢের।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ফেনীর উপপরিচালক মো. একরাম উদ্দিন ইতোপূর্বে দৈনিক ফেনীকে একটি প্রতিবেদনে প্রশ্নোত্তরে বলেন, বিভিন্ন কারণে প্রতিবছর ফেনীতে এক শতাংশ আবাদী জমি কমছে। এ ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকলে সংকট ঘণীভূত হবে।

টপ সয়েল বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও শীত এলেই জেলাজুড়ে রাতের আঁধারে মাটি কাটার ধুম পড়ে। কোন কোন আবাদি জমি ভূমির মালিক নিজেই বিক্রি করছেন, কোন কোন জায়গায় ভূমি মালিকদের জোর খাটিয়ে প্ররোচিত করে থাকে মাটিখেকো ব্যবসায়ীরা। মাটি বিক্রি করা এক ভূমি মালিকের সাথে কথা বলে জানা যায়, ব্যবসায়ীরা তাদের মাটি বেচার ব্যাপারে উৎসাহিত করছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই ভূমি মালিক জানান, মাটি ক্রেতারা বলছে টপ সয়েল কাটলে জমির কোন ক্ষতি হবে না। এক বছরের মধ্যেই বর্ষা এলে জমির সেই মাটি পূরণ হয়ে ফসল ফলানো যাবে।

ইটভাটায় প্রয়োজনীয় মাটির প্রধান উৎস হচ্ছে আবাদি জমির টপ সয়েল বা উর্বর অংশ, এমন বক্তব্য এসেছে পরিবেশবিদ, প্রত্যক্ষদর্শী এবং প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষদের কাছ থেকে। এর পক্ষে যুক্তি হিসেবে ২০২০ সাল জুড়ে অবৈধভাবে মাটিকাটা রোধে ফেনীতে ভ্রাম্যমাণ আদালতের তথ্য উল্লেখ করা যেতে পারে। গত ৭ জানুয়ারি ২০২১, দৈনিক ফেনীতে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে দেখা গেছে, অবৈধ বালু উত্তোলন ও আবাদী জমির মাটিকাটা রোধে ৬০টি অভিযান পরিচালনা করেছে ভ্রাম্যমাণ আদালত। অভিযানে ১০৫টি মামলা করা হয় এবং ৪৬ লাখ ৪৯ হাজার ২০০ টাকা জরিমানা করা হয়। চলতি বছর অর্থাৎ, নভেম্বর থেকে ২২ ডিসেম্বর পর্যন্ত ১৫টি ভ্রাম্যমান আদালতের অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। এতে সর্বমোট ৯ লাখ ১৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। যদিও ফসলি জমির মাটি কাটা প্রকট হয়ে ওঠে শীতের শেষদিকে।

কৃষি জমির মাটি কাটা ক্ষতির প্রসঙ্গে কৃষিবিদ তোফায়েল আহমেদ চৌধুরী বলেন, প্রাকৃতিক সম্পদের মধ্যে মাটি সবচেয়ে মূল্যবান। উপরিভাগের ৬ হতে ৭ ইঞ্চিতেই থাকেই সব ধরনের জৈব গুনাগুণ এবং উৎপাদনশীলতা। অথচ কেটে ফেলা হচ্ছে ১০ থেকে ১২ ইঞ্চি মাটি। ফলে জমির উৎপাদনশীলতা হ্রাস পাচ্ছে আশঙ্কাজনক হারে। একবার টপ সয়েল কেটে নিলে তা পূর্বের অবস্থায় ফিরে আসতে এক যুগ সময় লাগে। এতে সহজে অনুমেয় ক্ষতির পরিমাণ কতটা প্রকট।

নির্বিচারে মাটি কাটায় ক্ষতি প্রসঙ্গে স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর ও বায়ুম-লীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) চেয়ারম্যান ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার বলেন, ইটের চাহিদা মেটাতে গিয়ে কাঁচামাল হিসেবে ফসলি জমির উর্বর অংশ কেটে নেওয়া হচ্ছে। ফলে ভূমি উৎপাদন ক্ষমতা হারাচ্ছে। পোড়ানো ইটের পরিবর্তে ব্লক ইট তৈরি নিশ্চিত করতে হবে। ২০২৫ সালের মধ্যে শতভাগ ব্লক ইট উৎপাদনের কথা থাকলেও তা এখন ২০২৮ সাল পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। প্রয়োজনে উৎপাদনকারীদের প্রণোদনা দিতে হবে। জনসচেতনতা বাড়াতে হবে।

মাটির বর্তমান দাম প্রসঙ্গে জেলা ইটভাটা মালিক সমিতির সভাপতি জাফর উদ্দিন জানান, কাছাকাছি দুরত্বে একশ ফুট মাটি পরিবহনসহ খরচ পড়ছে এক হাজার দুইশ টাকা। এক দশক পূর্বে এর দাম ছিল ৫শ টাকা।

যমুনা ব্রিকফিল্ডের মালিক মো. কিরণ জানান, ইট প্রস্তুতে তার প্রতিষ্ঠানে বছরে প্রয়োজন হয় ১২ লাখ ঘনফুট মাটি। তিনি দাবি করেছেন, পতিত স্থান, পুকুর হতেই এই মাটি সংগ্রহ করেন।

মাঠপর্যায়ে দেখা গেছে, ফসলি জমির মাটি ক্রয়-বিক্রয়ে বেশিরভাগক্ষেত্রে ভূমি মালিক স্বেচ্ছায় জমির উপরিভাগ বিক্রয় করছেন। এ জেলায় মোট দশজন ভূমি মালিকের সাথে কথা হয়েছে প্রতিবেদকের সাথে। এক শতক জমি হতে মাটি বিক্রয় করে যে পরিমাণ টাকা পাওয়া যায় তা চাষাবাদ করে আশা করা যায় না।

 


অনীহা ব্লক ইটে
ফেনী ডেস্ক


ক্রমবর্ধমান নগরায়ণের ফলে কাঠ ও টিনের ঘরের বদলে ইট-কংক্রিটের বহুতল ভবনের চাহিদা যেমন বেড়েছে, তেমনি তার সাথে বেড়েছে পোড়া মাটির ইটের ব্যবহার। কিন্তু ব্লক ইট ব্যবহারে সরকার গুরুত্বারোপ করলেও দেশে এখন পরিবেশবান্ধব ব্লক ইট ব্যবহারের প্রচলন তেমন একটা চোখে পড়ে না। বিশ্ব ব্যাংকের জরিপ অনুযায়ী, দেশে মাটি থেকে পোড়ানো ইট উৎপাদনে বছরে ১২ লাখ মেট্রিক টনের বেশি জমির আবাদ নষ্ট হয়ে থাকে। এর সঙ্গে ৫৬ লাখ মেট্রিক টন কয়লা পোড়ানো হয়ে থাকে।

পরিবেশবিদদের মতে, বাংলাদেশে সাধারণত জমির উপরিভাগের মাটি পুড়িয়ে ইট প্রস্তুত করা হয়। এ কারণে এতে পরিবেশের নানামুখী ক্ষতি হচ্ছে। এমনিতেই এ দেশে আবাদি জমির পরিমাণ অপ্রতুল। ইটভাটার জন্য এই জমি আরও সংকুচিত হচ্ছে। ইটভাটাসংলগ্ন জমিও হারাচ্ছে তার উর্বরতা। এর সাথে ইট পোড়ানোর কারণে উজাড় হয়ে যাচ্ছে বৃক্ষসম্পদ। গাছ কাটা হচ্ছে ইটভাটায় পোড়ানোর জন্য। ইটভাটার চিমনি থেকে নির্গত বিষাক্ত ধোঁয়া দূষিত করছে বাতাস এবং হুমকির মুখে পড়ছে জনস্বাস্থ্য।

প্রকৌশলীরা বলছেন, ভবন নির্মাণে ইটের বদলে ব্লকের ব্যবহার করলে ব্যয় অন্তত ২৫ শতাংশ পর্যন্ত কমে যায়। কারণ, ভবন নির্মাণের সময় যেখানে একটি হলো ব্লকের ব্যবহার করা হয়, সেই সমপরিমাণ স্থানে পাঁচটি পোড়া ইটের দরকার হয়। এছাড়া কংক্রিট ব্লকের দেয়ালের গাঁথুনিতে সিমেন্ট-বালু কম লাগে। এটি ব্যবহারে ভবনের ওজন কম হয় ও ভবন নির্মাণের সময়ও কম লাগে। কংক্রিটের হওয়ায় এটি মজবুত হয় এবং নির্মাণের স্থায়িত্ব বাড়ে। লাল ইটের মতো এতে নোনা ধরে কম। এছাড়া শব্দদূষণ ও তাপ পরিবহনের পরিমাণ তুলনামূলকভাবে ৪০ শতাংশ কম থাকে। ব্লকের তৈরি দেওয়ালে শুধু রং দিয়েই ফিনিশিং দেওয়া যায়। এতে খরচও কমে। বাইরের প্রাচীরে ব্লক গাঁথুনির মাধ্যমে বৈচিত্র্যও আনা যায়।

তবে নির্মাণকাজে ব্লক ইট ব্যবহারের নানা সুবিধা থাকলেও সেটি ব্যবহারে অনীহা প্রসঙ্গে জেলা ইটভাটা মালিক সমিতির সভাপতি জাফর উদ্দিন বলেন, ব্লক ইট এখনো বাজারে জনপ্রিয়তা পায়নি। মিস্ত্রিরা এ ইট ব্যবহার সম্পর্কে অভিজ্ঞ নয়। তাই তারা নির্মাণকাজে ব্লক ইট ব্যবহারে মালিকদের নিরুৎসাহিত করে থাকে।

প্রচলিত ইটের ব্যবহার নিরুৎসাহিত করতে ২০২৫ সালের মধ্যে সরকারি উন্নয়নকাজে ব্লক ইট ব্যবহারের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। ২০১৯ সালে ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন করা হয়েছে। সংশোধিত আইনে সরকারি নির্মাণ, মেরামত ও সম্প্রসারণের কাজে ব্লক ইটের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। পরিবেশবিদরা বলছেন, ২০২৭ সালের মধ্যে পোড়ামাটির ইটের ব্যবহার শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনতে যে পরিকল্পনা সরকার গ্রহণ করেছে তা বাস্তবায়ন করতে ইটের জায়গায় ব্লকের ব্যবহার বাড়ানো জরুরি। এক্ষেত্রে সবাইকে সচেতন করে তুলতে হবে।