ফেনীতে সেবাখাতগুলোতে দুর্নীতি-অনিয়মের অভিযোগ পুরনো। এখানে দুর্নীতির তালিকায় এসেছে এমপি, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, শিক্ষক, সরকারি কর্মকর্তাসহ অনেকের নাম। দেশের উচ্চ মহল থেকে শুরু করে প্রশাসন, ব্যবসায়ী মহল, চিকিৎসা খাত, শিক্ষা খাত, শিল্পখাত, বিদ্যুৎখাত এমনকি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে বিস্তর।

দুর্নীতি দমন কমিশন সমন্বিত নোয়াখালী জেলা কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ফেনীতে এ পর্যন্ত দুর্নীতির অভিযোগে দায়েরকৃত ২৫টি মামলায় সাজা দেওয়া হয়েছে। কারাদন্ডপ্রাপ্তদের মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত ছিলেন ফেনীর আলোচিত জয়নাল হাজারী। এছাড়া দুর্নীতির অভিযোগে করা আরও আরো ৩০টি মামলা আদলতে বিচারাধীন। ৩০ ব্যক্তির বিরুদ্ধে অনুসন্ধান ও তদন্ত দুদকে চলমান। তাদের মধ্যে রয়েছেন ফেনীর সাবেক সংসদ সদস্যও।

দুর্নীতি ও অনিয়মের শত শত অভিযোগ জমা পড়লেও তপশিল বহির্ভূত অপরাধের কারণে অধিকাংশ অভিযোগ আমলে নিতে পারে না দুদক। দুদক আইন অনুযায়ী কেবল সরকার ও সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী সংশ্লিষ্ট দুর্নীতির সাত ধরনের অভিযোগ অনুসন্ধান করতে পারে সংস্থাটি।

এ প্রসঙ্গে দুদক’র সমন্বিত নোয়াখালী কার্যালয়ের উপপরিচালক মো. ফারুক আহমেদ বলেন, দুর্নীতি দমনে অর্পিত দায়িত্ব পালনে আমরা বদ্ধপরিকর। ইতোমধ্যে দুদক বেশ কয়েকজন প্রভাবশালীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগের প্রকাশ্য অনুসন্ধান শুরু করেছ। জয়নাল হাজারীসহ আরও অসংখ্য রাঘববোয়ালের বিরুদ্ধে দুদক মামলা করে রায়ও পেয়েছে। সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার এই প্রক্রিয়াটি একটু সময়সাপেক্ষ হলেও কার্যকরী।

গত ১৫ বছরে বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকার সম্পদ অর্জনের অভিযোগ রয়েছে ফেনী-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য নিজাম হাজারীর বিরুদ্ধে। তার বিরুদ্ধে জমি দখল, নিয়োগ বাণিজ্য, দলীয় পদ–বাণিজ্যসহ নানা অনিয়ম-দুর্নীতি করে হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার, নিজ ও পরিবারের সদস্যদের নামে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের সত্যতাও মিলেছে দুদক’র গোয়েন্দা দলের অনুসন্ধানে। ইতোমধ্যে তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করেছে দুদক।

কেবল নিজাম হাজারী নন, দুর্নীতির অনুসন্ধান চলছে সাবেক সংসদ সদস্য আলাউদ্দিন আহম্মদ চৌধুরীর সম্পদ নিয়েও। ইতোপূর্বে দুর্নীতির অভিযোগে মামলা করা হয়েছে ফেনী কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ আবুল কালামের বিরুদ্ধে। গত ২০২৩ সালের ৮ নভেম্বর দেড় কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে তার বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। শুধু তাই নয়, ফেনী পৌরসভার সুইপার ছিলেন হানিফ। দুর্নীতির মাধ্যমে কোটি টাকার মালিক বনে যান মাস্টার রোলে দৈনিক ১০০ টাকা বেতনে চাকুরী করা হানিফ। তার বিরুদ্ধেও দুদক তদন্ত করেছে।

দুর্নীতির দায়ে ফেনীর ‘গডফাদার’ হিসেবে খ্যাত আওয়ামী লীগ নেতা জয়নাল হাজারীকে ১০ বছর কারাদন্ড দিয়েছিল আদালত। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সাবেক মন্ত্রী-এমপিদের দুর্নীতির বিস্তর অভিযোগ জমা হয়েছে দুদক’র কাছে। অনুসন্ধানে সোচ্চার দুদকও।

জেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মোতালেব বলেন, দুর্নীতি নেই এমন কোনো স্তর বাংলাদেশে নেই। বাংলাদেশের প্রতিটি স্তরেই কমবেশি দুর্নীতি প্রতিফলিত হয়। দুর্নীতির পেছনের কারণ হচ্ছে নৈতিকতা, মূল্যবোধ এবং যথাযথ সুশাসনের ঘাটতি। দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করতে হলে শুধু সরকার সচেতন হলে চলবে না। সরকারের পাশাপাশি দেশের প্রতিটি নাগরিককে সচেতন নাগরিক হয়ে উঠতে হবে।

জেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সাধারণ সম্পাদক আরিফ রিজভী বলেন, দুর্নীতি পরায়নতা একটি মানসিক রোগের মতো। অনেক আয় করেন এমন মানুষও স্বাচ্ছন্দ্যে দুর্নীতি করে যাচ্ছেন। নৈতিকতার পরিবর্তন না হলে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করা দূরুহ।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) জরিপে উঠে এসেছে, ২০২৩ সালে সালে বাংলাদেশের দুর্নীতিগ্রস্ত খাতের তালিকায় পাসপোর্ট অফিস শীর্ষে রয়েছে। দুর্নীতিগ্রস্ত খাতের তালিকার দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে বিআরটিএ ও তৃতীয় স্থানে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা। এই তিন খাতে ঘুষও নেওয়া হয়েছে সবচেয়ে বেশি।

এ প্রসঙ্গে গতকাল ঢাকায় আয়োজিত এক মানববন্ধনে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, দেশে যত দিন রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক সংস্কৃতির ইতিবাচক পরিবর্তন না আসবে এবং রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক নেতৃত্ব দুর্নীতিবিরোধী চেতনা ধারণ করতে না পারবে, তত দিন দুর্নীতিবিরোধী উদ্যোগ কার্যকর হবে না। পুরো সমাজব্যবস্থার মধ্যে দুর্নীতিবিরোধী চেতনা সৃষ্টি করতে হবে।

জার্মানির বার্লিনভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের দুর্নীতির ধারণাসূচক প্রতিবেদন ২০২৩-এ শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১০তম, যা ২০২২ সালে ছিল ১২তম এবং ২০২১ সালে ছিল ১৩তম।

দুর্নীতি বিরোধী জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য প্রতি বছর ৯ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী দিবস পালন করা হয়। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য, ‘নতুন বাংলাদেশ-দুর্জয় তারুণ্য দুর্নীতি রুখবেই।’

নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে টিআইবি’র ১৪ দফা সুপারিশ
আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী দিবস ২০২৪ উপলক্ষে দুর্নীতি প্রতিরোধে পদক্ষেপ গ্রহণে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) সংশ্লিষ্ট অংশীজনের বিবেচনার জন্য ১৪ দফা সুপারিশ তুলে ধরেছে। রোববার (৮ ডিসেম্বর) জাতীয় সংসদ ভবনের সামনে আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী দিবস ২০২৪ উপলক্ষে আয়োজিত এক মানববন্ধন থেকে এ সুপারিশগুলো তুলে ধরা হয়। সেগুলো হলো-

১. মুক্তিযুদ্ধ ও ছাত্র-জনতার বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের প্রকৃত চেতনার আলোকে রাষ্ট্রকাঠামোর আমূল পরিবর্তনের মাধ্যমে এদেশের সাধারণ মানুষের ভোটাধিকার, ন্যায়বিচার, মতপ্রকাশ ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চয়তাসহ একটি বৈষম্যমুক্ত, এ অসাম্প্রদায়িক, জবাবদিহিমূলক, সুশাসিত, দুর্নীতিমুক্ত, মানবাধিকার-ভিত্তিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতান্ত্রিক ‘নতুন বাংলাদেশ’ বিনির্মাণে উদ্যোগী হতে হবে।

২. ‘নতুন বাংলাদেশে’র মূল চেতনাকে সমুন্নত রাখতে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) জবাবদিহি নিশ্চিতে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। দুদকের চেয়ারম্যান ও কমিশনার নিয়োগ-প্রক্রিয়াসহ সংস্থাটির কার্যক্রম দলীয় প্রভাবমুক্ত ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জন ও অর্থ পাচার বিষয়ে তদন্ত ও ব্যবস্থা গ্রহণে দুদকের ক্ষমতাকে খর্ব করে আইনের (সিভিল সার্ভিস অ্যাক্ট, ২০১৮: মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২; আয়কর আইন, ২০২৩) এমন সংশ্লিষ্ট ধারাসমূহ সংশোধন করতে হবে। সর্বোপরি দুদক সংস্কার কমিশনের সংস্কার প্রস্তাব গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে বাস্তবায়ন করতে হবে।

৩. দুর্নীতির বিরুদ্ধে সাধারণ জনগণ, গণমাধ্যম ও বেসরকারি সংগঠনসমূহ যাতে সোচ্চার ভূমিকা পালন করতে পারে, তার উপযুক্ত পরিবেশ এবং এ রূপ সংস্থার গঠন, নিবন্ধন, ব্যবস্থাপনা-প্রক্রিয়া সহজতর করাসহ উদ্দেশ্যমূলকভাবে প্রশাসনিক হয়রানি বন্ধ করতে হবে।

৪. বিচার বিভাগের নিয়োগ, পদায়ন, বদলিসহ বিচারিক প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে অবিলম্বে বিচার বিভাগের জন্য পৃথক সচিবালয় গঠন করতে হবে।

৫. দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির দ্রুত উন্নয়নের পাশাপাশি একটি জনবান্ধব পুলিশ বাহিনী তৈরিতে এর ব্যবস্থাপনা ও কর্মকাঠামো পুরোপুরি ঢেলে সাজানোর পাশাপাশি বাহিনীটির কাঙ্ক্ষিত পেশাগত উৎকর্ষ এবং প্রাতিষ্ঠানিক স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি-কাঠামো নিশ্চিত করতে হবে।

৬. দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূণ্য সহনশীলতার ফাঁকাবুলির সংস্কৃতি পরিহার করে সকল প্রকার বিশেষ করে উচ্চ পর্যায়ের দুর্নীতির বিচারহীনতা বন্ধে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।

৭. ব্যাংকিং খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ব্যাংকিং খাত-সংশ্লিষ্ট নিরপেক্ষ, স্বার্থের দ্বন্দ্বমুক্ত, স্বাধীনভাবে কাজ করতে সক্ষম এমন দক্ষ বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি ‘স্বাধীন ব্যাংকিং কমিশন গঠন’ করতে হবে।

৮. সংশ্লিষ্ট আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের মাধ্যমে অর্থ পাচার বন্ধ ও পাচারকৃত অর্থ ফিরিয়ে আনতে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ এবং যে সকল দেশে অর্থ পাচার হয়েছে সে সকল দেশের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আইনি সহায়তা জোরদারসহ জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহের সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে।

৯. কর ফাঁকি ও অর্থপাচার রোধে ব্যাংক ও আর্থিক খাতে দেশে-বিদেশে সকল প্রকার লেনদেনের স্বয়ংক্রিয় তথ্য আদান- প্রদান সহায়ক ‘কমন রিপোর্টিং স্ট্যান্ডার্ড’ (সিআরএস) অনতিবিলম্বে বাস্তবায়ন করতে হবে।

১০. সরকারি ক্রয়-ব্যবস্থায় প্রতিযোগিতার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সকল দরপত্র ই-জিপি প্রক্রিয়ায় সম্পাদন এবং উন্মুক্ত ও সীমিত দরপত্র-পদ্ধতিতে মূল্যসীমার বিধান বাতিল করতে হবে।

১১. সরকারি কার্যে ব্যক্তি স্বার্থ চরিতার্থতা, স্বজনপ্রীতি ও অনিয়ম-দুর্নীতি প্রতিরোধে ‘স্বার্থের দ্বন্দ্ব আইন’ প্রণয়ন করতে হবে।

১২. অবাধ তথ্যপ্রবাহের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির পাশাপাশি ভিন্নমত, বাক ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা পরিপন্থী নজরদারিভিত্তিক ভীতিকর পরিবেশ, তথা সকল জনগণের জন্য নিরাপত্তাহীনতার বোধ সৃষ্টির সংস্কৃতি যেন আবার ফিরে না আসে এমন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

১৩. রাজনৈতিক দলের সকল প্রকার গৃহীত অনুদান, আয়-ব্যয়, বিশেষ কার্যক্রমভিত্তিক সংগৃহীত অর্থ ও ব্যয়, প্রচারণাসহ নির্বাচনী ব্যয়, মনোনয়ন-কেন্দ্রিক আর্থিক লেনদেনকে একটি প্রাতিষ্ঠানিক নিয়ন্ত্রণ ও তদারকি ব্যবস্থার আওতায় নিয়ে আসতে প্রয়োজনীয় আইনি সংস্কার করতে হবে। এবং

১৪. সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে গণশুনানির মতো জনগণের অংশগ্রহণমূলক কার্যক্রম নিশ্চিত করতে হবে।