চলতি বছর দস্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে ৯২৮ দশমিক ৩৪ বর্গ কিলোমিটারের ভাটির জনপদ ফেনী। ভয়াবহ এ বন্যায় অন্তত ১৭০০ পরিবার গৃহহীন হয়ে সর্বস্ব হারালেও সরকারিভাবে পুনর্বাসন কার্যক্রমের গতিশীলতা বাড়েনি। বন্যার পর থেকে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনকে ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখলেও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের তুলনায় তা একেবারে অপ্রতুল বলছেন সাধারণ মানুষ।
ক্ষতিগ্রস্ত মানুষরা বলছেন, বন্যার তিন মাস পার হলেও এখনো দুঃখ ঘোচেনি হাজারো পরিবারের। বন্যায় মাথা গোঁজার ঠাঁই না পেয়ে এখনো মানবেতর জীবনযাপন করছে শতশত পরিবার। অনেকে এখনো খোলা আকাশের নিচে বসবাস করছেন।
সরেজমিনে দেখা গেছে, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ফুলগাজীর জগতপুর, পরশুরামের পূর্ব সাহেব নগর, বক্সমাহমুদ, টেটেশ্বর, ফেনী সদরের কাজীরবাগ, গিল্লাবাড়িয়াসহ জেলার বেশ কয়েকটি এলাকায় বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের উদ্যোগে কিছু ঘর নির্মাণ করে দেওয়া হয়েছে। তবে ক্ষতিগ্রস্তের তুলনায় যা সংখ্যায় একবারেই নগন্য।
ফুলগাজীল আমজাদহাট ইউনিয়নের মনিপুর এলাকার আবু তাহের মজুমদার বলেন, বন্যায় সব হারিয়ে তিন মাস ধরে মানবেতর জীবনযাপন করছি। বাড়ির জিনিসপত্র থেকে শুরু করে জমির ফসল সবকিছুই নষ্ট হয়ে গেছে। এতদিন যেমন-তেমন দিন পার করলেও এখন শীতের রাতে খুব কষ্ট করতে হচ্ছে। লোকজন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যদ্রব্য দিয়ে সহযোগিতা করেছে। তবে কেউ আমার ঘর করে দিলে খুব উপকার হয়।
বন্যায় ঘর হারিয়ে আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন ফুলগাজীর জগতপুর এলাকার আছমা আক্তার। দৈনিক ফেনীকে তিনি বলেন, বন্যার পর থেকে কয়েক দফায় বাড়িতে এসে নাম নিয়েছে। তবে এখনো মাথা গোঁজার ঠাঁই হয়নি। ছেলে-মেয়ে নিয়ে এক আত্মীয়ের বাড়িতে রাত কাটাচ্ছি। আবার দিনের বেলায় বাড়ি এসে খোলা আকাশের নিচে থাকতে হচ্ছে। এমন কষ্ট কাউকে বুঝাতে পারব না।
ছাগলনাইয়ার নজরুল ইসলাম নামে আরেক ক্ষতিগ্রস্ত বলেন, আমাদের সহযোগিতায় অনেকে অনেক কিছু করেছে শুনি। তবে তা এখনো খাতা-কলমে আর বক্তব্যেই সীমাবদ্ধ। বন্যার তিন মাস হয়ে গেলেও অন্যের বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে থাকতে হচ্ছে। সরকারি সহায়তা ছাড়া আমাদের ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব না।
বন্যায় ঘর হারানো সদর উপজেলার কাজীরবাগ ইউনিয়নের গিল্লাবাড়িয়া এলাকার বাসিন্দা আমেনা আক্তার বলেন, বন্যার পানি থেকে অল্প কিছু জিনিসপত্র রক্ষা করতে পারলেও গত তিন মাস ধরে খোলা আকাশের নিচে থেকে সেগুলোও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। অনেক কষ্ট করে গড়ে তোলা সাজানো সংসারের সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেছে। সন্তান নিয়ে খুব কষ্টে দিনযাপন করছি।
বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনে এখন পর্যন্ত ব্যক্তিগত উদ্যোগ, বিভিন্ন এনজিও এবং স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনই একমাত্র ভরসা। তাদের মধ্যে একটি ঘুরে দাঁড়াবে ফেনী প্ল্যাটফর্ম।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সংগঠক শরিফুল ইসলাম অপু দৈনিক ফেনীকে বলেন, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনে এখন পর্যন্ত সরকারি সহায়তা একদমই অপ্রতুল। ঘরবাড়ি হারিয়ে শত শত পরিবার মানবেতর জীবনযাপন করছে। এখন পর্যন্ত ব্যক্তিগত উদ্যোগ, বিভিন্ন এনজিও ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের ভূমিকাই উল্লেখযোগ্য। আমাদের প্ল্যাটফর্ম থেকেও ক্ষতিগ্রস্ত বেশকিছু পরিবারকে ঘর ও বিভিন্ন সহায়তা প্রদান করা হয়েছে। এখনো আরও কিছু ঘর নির্মাণের কাজ চলমান রয়েছে। সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ যদি এ ব্যাপারে গুরুত্ব দিয়ে একটি উদ্যোগ নেন মানুষগুলো অনেক উপকৃত হবে।
পুনর্বাসনে সরকারি উদ্যোগ
জেলা প্রশাসনের তথ্যমতে, স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় ফেনীতে ১ হাজার ৭১৮টি ঘরবাড়ি সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বন্যায় ফেনীতে ৮ হাজার ৯৫টি কাঁচাঘর, ২৫০টি আধাপাকা ঘর সম্পূর্ণ ধ্বসে যায়। এতে আনুমানিক ক্ষতি হয়েছে ১৬৩ কোটি ১১ লাখ ৭০ হাজার টাকা। ৫৩ হাজার ৪৩৩টি কাঁচাঘর এবং ২ হাজার ৬৩২টি আধাপাকা ঘরের আংশিক ক্ষতির আর্থিক পরিমাণ ৩৭০ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। সবমিলিয়ে ৬৪ হাজার ৪১৫টি ঘরবাড়িতে মোট ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ৫৩৩ কোটি ৮৯ লাখ ৭০ হাজার টাকা।
তবে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের অভিযোগ, বন্যার তিন মাস গেলেও পুনর্বাসন কার্যক্রমে সরকারিভাবে তেমন উল্লেখযোগ্য সহযোগিতা তারা পাননি। ক্ষতিগ্রস্তের তুলনায় সহযোগিতার পরিমাণ একেবারে নগণ্য বলছেন তারা।
এ ব্যাপারে ফেনীর নবাগত জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলাম দৈনিক ফেনীকে বলেন, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের এখনো সম্পূর্ণ পুনর্বাসন নিশ্চিত করা যায়নি। তবে আংশিক পুনর্বাসনের আওতায় বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্তদের সুযোগ-সুবিধা প্রদান করা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত ১ হাজার ৭১৮টি পরিবারের তালিকা এসেছে। ইতোমধ্যে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে একটি বিশেষ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এ প্রকল্পের আওতায় প্রাথমিক পর্যায়ে জেলায় ১১০টি ঘর করে দেওয়া হবে। পর্যায়ক্রমে ক্ষতিগ্রস্ত সবাইকে পুনর্বাসন করার সর্বোচ্চ চেষ্টা অব্যাহত থাকবে।
এ ব্যাপারে কথা হয় জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. মাহবুব আলমের সঙ্গে। দৈনিক ফেনীকে তিনি বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে সহায়তায় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে ২০ হাজার বান্ডেল টিন ও নগদ ৬ কোটি টাকা বরাদ্দ চাওয়া হয়েছিল। তারমধ্যে এখন পর্যন্ত ৪০০ বান্ডেল টিন ও নগদ ১২ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত উপজেলাগুলোতে পরিবার প্রতি এক বান্ডেল টিন ও নগদ ৩ হাজার টাকা করে বিতরণ করা হচ্ছে। আশা করি চলতি সপ্তাহের মধ্যেই আরও কিছু বরাদ্দ আসতে পারে।
বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের বেসরকারি সহায়তার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, পুনর্বাসনে ইউএনডিপি তিন হাজার পরিবারকে ৩৪ হাজার ৫০০ টাকা করে, রেড ক্রিসেন্টের পক্ষ থেকে আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত ছয় হাজার পরিবারকে ৫ হাজার ৫০০ টাকা, মাস্তুল ফাউন্ডেশন ৯৯২ জনকে ১১ লাখ টাকা, রিকের পক্ষ থেকে ১ হাজার ৪৪৫ জনকে ৯৯ লাখ টাকা, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ইপসা ১ হাজার ৫৬০ পরিবারকে ১ কোটি ৬০ লাখ টাকা সহায়তা প্রদান করছে। এছাড়া সাড়ে ৬ লাখ টাকায় ১৫৭ পরিবারকে চার বান্ডেল করে টিন দিচ্ছে সেনাবাহিনী।
মো. মাহবুব আলম আরও বলেন, বন্যায় সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত ১ হাজার ৭১৮টি ঘরের মধ্য থেকে পাইলট প্রোগ্রামের আওতায় জেলায় ১১০টি পাকাঘর করে দেওয়া হবে। তারমধ্যে ফেনী সদর উপজেলায় ৩৫টি, ফুলগাজী, পরশুরাম ও ছাগলনাইয়া উপজেলায় ২০টি করে, দাগনভূঞায় ১০টি ও সোনাগাজী উপজেলায় ৫টি ঘর করা হবে। ইতোমধ্যে উপকারভোগীর তালিকা তৈরির কাজ চলছে। শিগগিরই বরাদ্দ আসবে বলে আশা করছি। পরবর্তী ধারাবাহিকভাবে অন্যদেরও এ সহায়তা প্রদান করা হবে।