ছবিতে ফেনী সদরের কালিদাস পাহালিয়া নদীর আগ্রাসী ভাঙন রোধে যেস্থানে বালুর বস্তা ফেলা হচ্ছে সেখানে কিছুদিন আগেও অনেক পরিবারের বসতি ছিল। নদী ভাঙনে বসতি হারিয়ে আশ্রয়হীন কয়েক পরিবার বর্তমানে ফেনীতে বাসা ভাড়া করে থাকছেন। ফেনী সদরের ছনুয়া ইউনিয়নের টঙ্গীপাড়ায় আলী আজম মোল্লা বাড়িতে তোলা এ ছবিতে দেখা যাচ্ছে এভাবে বাঁশের বেড়া দিয়ে বস্তাভর্তি বালু ফেলে ভাঙনরোধের চেষ্টা করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। ভাঙনে ইতোমধ্যে আলী আজম মোল্লা বাড়ির পাশে পেশকার বাড়ির শতাধিক পরিবারের বসতি নদীতে বিলীন হয়ে গেছে।
গতকাল মঙ্গলবার (১৯ নভেম্বর) সরেজমিনে লেমুয়া ইউনিয়নের নেয়ামতপুর, ছনুয়ার টঙ্গিপাড়া, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের লেমুয়া ব্রিজ জামে মসজিদ সংলগ্ন ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে। ভাঙনস্থানে বাঁশের ফালি দিয়ে বেড়া দিয়ে সেখানে ছোট ছোট প্লাস্টিকের বস্তাভর্তি বালি ফেলে ভাঙন রোধের চেষ্টা করছে পাউবো। যেস্থানে ভেঙেছে সেখানে নদী থেকে বালু তোলা হচ্ছে।
পাউবো সূত্রে জানা গেছে, ‘সাময়িকভাবে’ নদীতীর রক্ষার জুরুরী ভিত্তিতে বাঁশের বেড়া দিয়ে বস্তাভর্তি বালি ফেলা হচ্ছে। স্থায়ীভাবে রক্ষায় বরাদ্দ না পাওয়ায় জরুরী ভিত্তিতে ভাঙন ঠেকাতে এমন পন্থা অবলম্বন করা হয়েছে। টঙ্গিপাড়ায় ৭০ মিটার, নেয়ামতপুরে ৪০ মিটার, মহাসড়কের লেমুয়া ব্রিজ জামে মসজিদের পাশে ৮২ মিটার স্থানে ভাঙন রোধের কাজ করা হয়েছে।
স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ভাঙন রোধে এ পন্থায় কাজ করতে ঠিকাদার নিয়োগ করেছে পাউবো। নদীতীর রক্ষায় পাউবো’র এমন চেষ্টা নিয়ে তাদের মনে দুশ্চিন্তা আরও বেড়েছে। ভাঙন রোধে তা কতদিন কার্যকর থাকবে তা নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, পানি উন্নয়ন বোর্ডের দায়সারা কাজের খেসারত দিতে হচ্ছে নদীতীরের বাসিন্দাদের। ভাঙনরোধে স্থায়ী পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য স্থানীয়রা দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানালেও পাউবো তা করছে না। ভাঙনে বহু পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হলেও লাভ হয় তাদের। ভাঙন রোধে জিও ব্যাগের পরিবর্তে সাধারণ প্লাস্টিকের ব্যাগে বালি ভরে ফেলা হচ্ছে। পানির ¯্রােতে সেগুলো ভেসে যেতে পারে।
এ ব্যাপারে পাউবো ফেনীর উপবিভাগীয় প্রকৌশলী অলক কান্তি দাস জানান, অস্থায়ীভাবে জরুরী বরাদ্দে নদী ভাঙন রোধে বাঁশ-কাঠ ও বালির বস্তা দিয়ে কাজ করা হচ্ছে। স্থায়ীভাবে ভাঙন রোধ করতে হলে ব্লক বসাতে হবে। এ ব্যাপারে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। ভাঙন রোধে স্থায়ী পদক্ষেপ গ্রহণে বিশ^ব্যাংকের বরাদ্দ দেওয়ার কথা রয়েছে। সেটি এলে স্থায়ীভাবে ভাঙন রোধের কাজ শুরু করা হবে।
জানতে চাইলে এ ব্যাপারে প্রকল্পের ঠিকাদার মো আতিক বলেন, আমরা নকশা অনুযায়ী কাজ করছি। বাড়তি কিছু করার সুযোগ আমাদের নেই। স্থায়ীভাবে নদীভাঙন রোধ করতে হলে ব্লক বসাতে হবে। এজন্য বড় বরাদ্দের প্রকল্প প্রয়োজন।
নুরুল আবছার নামে টঙ্গিপাড়ার আলি আজম মোল্লা বাড়ির এক বাসিন্দা জানান, নদীতীরে যেখানে বস্তা ফেলা হয়েছে তার মাত্র কয়েকহাত দূরে তার বসতঘর। ইতোমধ্যে তিনবার স্থান পরিবর্তন করতে হয়েছে। বর্তমানে তিন ছেলে এক মেয়েকে নিয়ে মাথা গোঁজার আশ্রয় হারানোর শঙ্কা নিয়ে তিনি জীবনযাপন করছেন। পাউবো যেভাবে ভাঙন ঠেকানোর চেষ্টা করছে তা আমাদের আশা যোগায়নি, আরও হতাশ করেছে। এভাবে সরকারের টাকার অপচয় হচ্ছে, এর কোন সুফল আমরা পাচ্ছি না। ইতোমধ্যে নদীভাঙন আতঙ্কে আমাদের পাশ^বর্তী জাকির আহমেদ ও বেলাল হোসেনসহ কয়েক পরিবার ঘরবাড়ি ছেড়ে ফেনী শহরে বাসা ভাড়া নিয়েছেন। নিজের চোখে দেখেছি সোহাগের ঘরটা ভেঙে নদীতে বিলীন হয়ে গেছে।
লেমুয়া ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি শাহ আলম মিয়াজী জানান, ভাঙন রোধে ফেনী পানি উন্নয়ন বোর্ড কার্যকর ব্যবস্থা নেয়নি। দায়সারাভাবে কাজ করছে। নেয়ামতপুরের পর নতুন করে কাজী বাড়ি, মহিন উদ্দিন বাড়ি ও জলদাস পাড়ায় ভাঙন দেখা দিয়েছে। দ্রুতই ভাঙন রোধ করা না গেলে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাবে কয়েকটি গ্রামসহ কৃষিজমি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। বাঁকা নদী সোজা করা না হলে ভাঙন রোধে যতই বালির বস্তা ফেলা হোক, তা কাজে আসবে না।
চাঁদপুর আদর্শ সমাজের সাধারণ সম্পাদক ও জেলা স্বেচ্ছাসেবক দল সহসভাপতি আলী মনসুর সুমন বলেন, লেমুয়া বেইলি ব্রিজের পূর্ব ও পশ্চিম পাশে নদীভাঙন তীব্রতর হচ্ছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা পরিদর্শনের সময় লিখিত অভিযোগ দেওয়া হয়েছে। এ নিয়ে একাধিকবার তাদের অফিসে গেলেও প্রয়োজনীয় কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি পাউবো।
উল্লেখ্য, সম্প্রতি শতাব্দীয় ভয়াবহ বন্যার পানি নেমে গেলে ফেনী সদরের কালিদাস ও পাহালিয়া নদীতীরে তীব্র ভাঙন দেখা দেয়। কেবল ফেনী সদরের লেমুয়া ও ছনুয়ায় নয়, এর প্রভাব পড়েছে সোনাগাজীর নবাবপুর ইউনিয়নের নদী তীরবর্তী লোকালয়ে। ইতোমধ্যে ভাঙন আতঙ্কে ওইসব অঞ্চলে বহু পরিবার ভিটেমাটি হারিয়েছেন, আরও বহু পরিবার বসতি হারানোর শঙ্কায় দিন কাটাচ্ছেন। এ নিয়ে একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে দৈনিক ফেনী।