পরশুরামে ছুরিকাঘাতে এমরান হোসেন রিফাত ওরফে রাহিম (১৯) নামের এক কিশোরের মৃত্যু হয়েছে। হত্যাকাণ্ডে প্রধান আসামি হিসেবে আরেক কিশোর রনির নাম উঠে এসেছে। গত বৃহস্পতিবার দুপুরে উপজেলার বক্সমাহমুদ ইউনিয়নের দক্ষিণ কেতরাঙ্গা গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। এর আগে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর গত ৬ আগস্ট রাতে রাহিমের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। ওই সময় হামলায় স্বপন, রনি, হৃদয় ও মীর হোসেন তাকে মারধর করেছেন বলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ক্ষুদে বার্তায় তার এক সুহৃদকে জানান রাহিম। হামলার পর সুহৃদকে পাঠানো ছবিতে রাহিমের দুই হাতে, মাথায়, পায়ে ব্যান্ডেজ দেখা যায়। সেবার হামলার পর বেঁচে ফিরলেও এবার আর ফিরতে পারলেন না রাহিম।

এদিকে তার মৃত্যু নিয়ে জেলাজুড়ে চলছে নানা আলোচনা-সমালোচনা। রাহিম ৫ আগস্ট পূর্ববর্তী সময়ে ছাত্রলীগের (ইতোপূর্বে নিষিদ্ধ সংগঠন) কর্মী ছিলেন বলে দাবি করেছেন একাধিক সূত্র। এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে অনেকে রাজনৈতিক বিরোধকে দায়ী করেছেন। তবে আরেকটি পক্ষ বলছেন, সীমান্তে চোরাকারবারি সংক্রান্ত মতবিরোধ ও দ্বন্দ্বের কারণে রাহিমকে হত্যা করা হয়েছে।

এ ব্যাপারে পরশুরাম মডেল থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ নুরুল হাকিম দৈনিক ফেনীকে বলেন, রাহিম সীমান্তে চোরাকারবারির তথ্য সরবরাহের কারণে এ ঘটনা ঘটতে পারে বলে ধারণা করছি। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত স্বপন ও কাশেম নামের দুজনকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। অন্য আসামিদের গ্রেপ্তারে পুলিশের অভিযান অব্যাহত রয়েছে।

এর আগে বৃহস্পতিবার দুপুরে রনি তার কয়েকজন সহযোগীকে নিয়ে রাহিমের ওপর হামলা করে। একপর্যায়ে ছুরিকাঘাত করলে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। পরে স্থানীয়রা রাহিমকে উদ্ধার করে প্রথমে পরশুরাম উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পরে ফেনী জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যায়। শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পথে তার মৃত্যু হয়েছে।

উল্লেখ্য, শুক্রবার এ ঘটনায় নিহতের বাবা ইসমাইল হোসেন বাদী হয়ে ৬ জনের নাম উল্লেখ ও আরও ৪-৫ জনকে অজ্ঞাত আসামি করে পরশুরাম মডেল থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। মামলার আসামিরা হলেন- দক্ষিণ কেতরাঙ্গা গ্রামের মৃত হাবিব উল্ল্যাহর ছেলে রফিকুল ইসলাম রনি, একই এলাকার ইউছুপ মিয়ার ছেলে ইয়াকুব নবী স্বপন, মোহাম্মদপুর গ্রামের মৃত হোসেন মিয়ার ছেলে আবুল কাশেম, দক্ষিণ কেতরাঙ্গা গ্রামের আবুল হাশেমের ছেলের শাকিল, রুহুল আমিনের ছেলে ইসমাইল এবং সাতকুচিয়া গ্রামের করিম।



রাহিমকে তুলে নেওয়ার হুমকি, কল রেকর্ড ভাইরাল

পরশুরামে ছুরিকাঘাতে রাহিম হত্যাকাণ্ডের পর তাকে তুলে নেওয়ার হুমকি দেওয়া একটি কল রেকর্ড সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। যেখানে স্থানীয় নাজিম পাটোয়ারী নামে এক ব্যক্তি তাকে এ হুমকি দিয়েছেন বলে জানা গেছে।
ভাইরাল হওয়া কল রেকর্ডে নাজিম উদ্দীন বলেন, 'তুমি আমাকে কোনো টাকা-পয়সা কিছু দিতে হবে না। কালকে থেকে ভালার দোকানে (দক্ষিণ কেতরাঙ্গায় স্থানীয় দোকান) থাকিওনা, ওকে। এলাকায় থাকলে তোমাকে লেদা পোলাপাইনে (ছোট ছেলে) মারইব (মারবে), উডাই (তুলে) নিবে। কোন....(অশ্রাব্য বাক্য) পুত(ছেলে) যদি তোয়ারে (তোমাকে) থাকতে বলে, তাহলে হেতের (তার).....(অশ্রাব্য বাক্য), মনি চেয়ারম্যান হলে মনি চেয়ারম্যান। আই (আমি) নাজিমে বলছি তোয়ারে উডাইলামু (তুলে নিব) কালকে। পরবর্তী ভালো থেকো বলে নাজিম সংযোগ কেটে দেন।

অভিযোগ রয়েছে নাজিম দক্ষিণ কেতরাঙ্গায় সীমান্তে চোরাচালানে জড়িতদের কাছ থেকে কমিশন নিয়ে থাকে। নাজিমকে না জানিয়ে রাহিম ভারতীয় চিনি আনায় তাকে হুমকি দিয়েছে।

কল রেকর্ড প্রসঙ্গে জানতে চাইলে নাজিম পাটোয়ারী দৈনিক ফেনীকে বলেন, রাহিম আমার নানার এলাকার সম্পর্কে মামাতো ভাই হয়। তার বিরুদ্ধে মানুষজন বিভিন্ন সময় অভিযোগ দিলেও আমি তাকে রক্ষা করেছি। এজন্য একদিন ভাই হিসেবে কল দিয়ে তাকে শাসিয়েছি। যা এখন ছড়িয়ে পড়েছে। মূলত এ কল রেকর্ডটি আড়াই মাস আগের। এ কলের পরেও পরবর্তী তার বাড়ি গিয়ে খাবার খেয়েছি। চোরাকারবারি প্রসঙ্গে নিজের সম্পৃক্ততার কথা বানানো গল্প বলে তিনি অভিহিত করেছেন।

 

আলোচনায় নাজিম-আলাউদ্দিন
কেতরাঙ্গা এলাকায় সীমান্তে চোরাকারবারি সংক্রান্ত ঘটনার জের ধরে রাহিমকে হত্যার করা হয়েছে বলে একাধিক সূত্র দাবি করছে। আর সীমান্তে এসব কর্মকাণ্ডের স্থানীয় নাজিম পাটোয়ারি ও পরশুরাম পৌর যুবদলের সাবেক প্রচার সম্পাদক ইসলামপুর এলাকার বাসিন্দা আলাউদ্দিন ইসলাম নেতৃত্ব দেন বলে অভিযোগ এসেছে।

স্থানীয় একটি সূত্র দাবি করেন, রনি-রাহিমসহ অন্যরা কেতরাঙ্গা এলাকায় সীমান্তে চোরাকারবারির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল। যেখানে নাজিম ও আলাউদ্দিনকে নিয়মিত কমিশন প্রদান করতে হতো। সম্প্রতি রাহিম ভারতীয় সীমান্ত থেকে পণ্যদ্রব্য নিয়ে আসলেও তা নাজিম থেকে গোপন করেন। এতে তার প্রতি ক্ষিপ্ত হন নাজিম।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে অভিযুক্ত নাজিম উদ্দীন বলেন, গত ৮ আগস্ট আমি প্রবাস থেকে দেশে এসেছি। এ বিষয়ে কোনো কিছুই অবগত না। আমার অতীত জীবনেও কোনো বিতর্ক বা রাজনৈতিক মামলা ছাড়া অন্য কোন মামলার রেকর্ড নেই। গ্রুপিংয়ের রাজনীতির কারণে একটি পক্ষ এসব নিয়ে ষড়যন্ত্র করছে। সীমান্তে চোরাকারবারি, কমিশন বা এই ধরনের কোনো কাজে আমার কোন সম্পৃক্ততা নেই।

এদিকে আলাউদ্দিনের বিরুদ্ধে এ হত্যাকাণ্ডের পর প্রধান আসামি রনিকে আশ্রয় ও পালিয়ে যেতে সহযোগিতার অভিযোগ করছেন নিহত রাহিমের পরিবার।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে অভিযুক্ত আলাউদ্দিন দৈনিক ফেনীকে বলেন, ওই ছেলেরা বিভিন্ন সময় আমাদের কর্মসূচিতে অংশ নেওয়ার সুবাদে দলের নেতাদের সঙ্গে ছবি রয়েছে। ছবি তোলা আমার অপরাধ না। ঘটনার দিন দুপুর ৩টার দিকে রনি আমাকে মোবাইল ফোনে কল করে এক ছেলের সঙ্গে মারামারির ঝামেলা হয়েছে বলে জানান। তার সঙ্গে কল কেটে বিষয়টি আমি উপজেলা বিএনপির সদস্য সচিব ইব্রাহিম খলিল মনি চেয়ারম্যানকে মুঠোফোনে অবগত করি। পরবর্তী আবার রনির সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও সাড়া মেলেনি। কিছুক্ষণ পর তাদের সঙ্গে থাকা এক ছেলে, এ মামলার আসামি শাকিল এসে রনি একটি ঝামেলা করেছেন বলে জানান। তখন তার মাধ্যমে রনির সঙ্গে কথা বলেছি। একইসময় মনি চেয়ারম্যানের সাথেও তাকে কথা বলিয়ে দিয়েছি। আমার অপরাধ হলে এতটুকুই।
সীমান্তে চোরাচালানের সঙ্গে সম্পৃক্ত প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সীমান্ত থেকে আমার বাড়ি অনেক দূরে। মানুষ বললেও আমি ও নাজিম চোরাচালান বা এ ধরনের কোনো কাজের সঙ্গে জড়িত না।

রাহিমের সঙ্গে পরিচয় প্রসঙ্গে আলাউদ্দিন বলেন, তার (রাহিম) সঙ্গে অনেক আগে এক ছোট ভাইয়ের মোবাইল ফোন থেকে কথা হয়েছিল। এছাড়া তেমন চেনা-জানা নেই। কখনো আমাদের রাজনৈতিক কর্মসূচিতেও আসেনি। এছাড়া তার মৃত্যুর পর আওয়ামী লীগের লোকজন তাকে নিজেদের লোক বলে ফেসবুকে পোস্ট করেছেন। সে ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল।

 

এখনো অধরা রনি

রাহিম হত্যা মামলায় এখম পর্যন্ত দুইজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। গত শুক্রবার (১৫ নভেম্বর) তাদের আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। তবে ট ঘটনার তিন দিন পেরিয়ে গেলেও প্রধান আসামি রফিকুল ইসলাম রনিকে এখনো আইনের আওতায় আনতে পারেনি পুলিশ।
নিহত রাহিমের বাবা ইসমাইল হোসেন বলেন, রনির নেতৃত্বে তারা আমার ছেলেকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করেছে। কিন্তু এত সময় পার হলেও প্রশাসন তাকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি। একটি পক্ষ রনিকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করেছে।
একাধিক সূত্র দাবি করেছে, অভিযুক্ত রনি ৫ আগস্টের আগে নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত ছিল। সরকার পতনের পরে তিনি ভোল পাল্টে ছাত্রদলের রাজনীতিতে সক্রিয় হন। একইসাথে বিএনপির বিভিন্ন নেতার সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ ছবিও দেখা গেছে।
রনির সঙ্গে ছবি প্রসঙ্গে জানতে বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও পরশুরাম পৌরসভার সাবেক মেয়র আবু তালেবের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও সাড়া মেলেনি।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, রনি টাকার বিনিময়ে যেকোনো অপরাধমূলক কাজ করতে পারে। রাহিমকে হামলা করতে কেউ তাকে ব্যবহার করতে পারে।