যানজট বাংলাদেশে একটি দীর্ঘমেয়াদী সমস্যা হিসেবে স্বীকৃত, যা আমাদের অর্থনীতি, পরিবেশ, এবং সামাজিক জীবনযাত্রার উপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে। বিশ্বব্যাংকের এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, শুধু ঢাকাতেই প্রতি বছর যানজটের কারণে প্রায় ৩৭০০০ কোটি টাকা অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়। ঢাকার প্রায় ৪০ শতাংশ সড়কে যানজট স্থায়ীভাবে দেখা যায়, এবং এসব সড়কে ঘণ্টায় যানবাহনের গতি ৫ কিলোমিটার বা তারও কম, যা মানুষের জীবনমানকে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত করছে। যানজটের এই সমস্যা সমাধানে নানা পদক্ষেপ এবং সঠিক পরিকল্পনার অভাবেই মূলত এ সংকট আরও ঘনীভূত হচ্ছে।
যানজটের কারণ: সুনির্দিষ্ট বিশ্লেষণ বাংলাদেশে যানজট সমস্যা সৃষ্টির পেছনে অনেকগুলো বিষয় কাজ করছে। এ সমস্যাগুলো একত্রে এমন একটি অবস্থা সৃষ্টি করেছে, যা এখন শুধুমাত্র সুনির্দিষ্ট এবং দীর্ঘমেয়াদী পদক্ষেপের মাধ্যমে সমাধানযোগ্য।
১. অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও ঘনবসতি: ঢাকাসহ প্রধান শহরগুলোতে পরিকল্পনাহীন নগরায়ণ ও বস্তি অঞ্চল বিস্তৃত হচ্ছে, যা সড়ক ব্যবস্থাপনায় বাধা সৃষ্টি করছে। ঢাকা শহরের প্রায় ৫০ শতাংশ জনসংখ্যা সঠিক আবাসনের অভাবে বস্তিগুলোতে বাস করে, যেখানে সড়কের সুবিধা অপ্রতুল। এ কারণে শহরের কেন্দ্রীয় অঞ্চলে লোকসমাগম ও যানজট বৃদ্ধি পায়।
২. অপ্রতুল সড়ক ও উন্মুক্ত স্থান: ঢাকার মোট আয়তনের মাত্র ৭ শতাংশ সড়ক হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে, যেখানে উন্নত দেশের শহরগুলোতে এ হার ২৫ শতাংশের বেশি। উপরন্তু, বাংলাদেশে উন্মুক্ত স্থানের পরিমাণ খুবই সীমিত, ফলে যানবাহনের গতি ধীর হয়ে যায় এবং যানজট বাড়ে।
৩. নিয়ন্ত্রিত গণপরিবহন ব্যবস্থার অভাব: দেশের গণপরিবহন ব্যবস্থা অপরিকল্পিত এবং সীমিত। বাস, ট্রেন, এবং অন্যান্য গণপরিবহনের মান ও সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম, যার ফলে মানুষ ব্যক্তিগত গাড়ির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। সাম্প্রতিক এক সমীক্ষা অনুযায়ী, ঢাকার ৭০ শতাংশের বেশি মানুষ ব্যক্তিগত যানবাহন ব্যবহার করেন, যা সড়কে অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে।
৪. ট্রাফিক আইন লঙ্ঘন ও অপর্যাপ্ত আইন প্রয়োগ: ট্রাফিক আইন লঙ্ঘন এবং আইন প্রয়োগের দুর্বলতা যানজটের জন্য বড় একটি কারণ। সঠিক প্রশিক্ষণ না থাকা এবং পর্যাপ্ত ট্রাফিক পুলিশের অভাবে অনেক চালক ট্রাফিক আইন মানেন না। এ ছাড়া, বিভিন্ন ধরনের অবৈধ পার্কিং ও সড়ক দখল যানজটকে আরও জটিল করে তুলছে।
৫. বিকল্প পথ ও পরিকল্পনার অভাব: শহরের অধিকাংশ অঞ্চলেই বিকল্প সড়ক, বাইপাস বা সংযোগ সড়কের সংখ্যা কম। প্রধান সড়কে অতিরিক্ত চাপ পড়লে বিকল্প সড়ক না থাকায় যানজট দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং স্থায়ী জট তৈরি করে।
সম্ভাব্য সমাধান: কার্যকর ও স্থায়ী উদ্যোগ যানজট নিরসনে সরকার ও নগর পরিকল্পনাবিদদের কিছু দীর্ঘমেয়াদী ও কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া উচিত। এর মধ্যে কিছু উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ হলো:
১. গণপরিবহন ব্যবস্থার আধুনিকায়ন ও সম্প্রসারণ: ঢাকাসহ অন্যান্য বড় শহরে উন্নত মানের বাস, ট্রেন, এবং মেট্রোরেল সেবা চালু করা দরকার। বিশ্বব্যাংকের পরামর্শ অনুযায়ী, এ ক্ষেত্রে বিআরটি (বাস র্যাপিড ট্রানজিট) এবং মেট্রোরেল প্রকল্পগুলো সময়মতো বাস্তবায়ন করা হলে গণপরিবহন ব্যবহারের হার বাড়বে এবং ব্যক্তিগত গাড়ির ওপর নির্ভরশীলতা কমবে। এতে যানবাহনের চাপ কমে যাবে।
২. সড়ক অবকাঠামোর উন্নয়ন ও পুনর্গঠন: বড় শহরগুলিতে রাস্তার প্রশস্ততা বৃদ্ধি এবং সড়কের মান উন্নত করা জরুরি। নতুন উড়ালসড়ক, আন্ডারপাস, এবং বাইপাস রাস্তা নির্মাণ করলে প্রধান সড়কগুলোতে যানবাহনের চাপ কমবে। উদাহরণস্বরূপ, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন করলে ঢাকায় যানজটের মাত্রা অনেকটাই কমে আসবে।
৩. ডিজিটাল ট্রাফিক সিস্টেম ও সিসিটিভি ব্যবহার: উন্নত দেশগুলোর মতো, আমাদেরও উন্নত ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা চালু করা উচিত। সিসিটিভি ক্যামেরা এবং স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক সিগন্যাল ব্যবস্থা চালু করে সড়কে শৃঙ্খলা আনা সম্ভব। সঠিক প্রযুক্তির মাধ্যমে ট্রাফিক পুলিশের সংখ্যা কমিয়ে কার্যকরী ট্রাফিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব।
৪. ট্রাফিক আইন প্রয়োগ এবং শাস্তির মাত্রা বৃদ্ধি: ট্রাফিক আইন লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে কঠোর শাস্তির বিধান করা হলে মানুষ আইন মানতে আরও সচেতন হবে। পাশাপাশি ট্রাফিক পুলিশদের জন্য আধুনিক প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
৫. অবৈধ পার্কিং ও রাস্তা দখলমুক্ত করা: অবৈধ পার্কিং এবং ফুটপাতের ওপর দখল সরিয়ে পথচারীদের চলাচলের সুষ্ঠু ব্যবস্থা করতে হবে। এতে রাস্তায় যানজট হ্রাস পাবে এবং মানুষ বিকল্প যাতায়াত ব্যবস্থায় আগ্রহী হবে।
৬. সাইকেল ও পথচারী লেনের উন্নয়ন: শহরের ভেতরে সাইকেল লেন এবং পথচারী পথ তৈরি করতে হবে। এতে করে রাস্তার ওপর যানবাহনের চাপ কমবে এবং সবার জন্য নিরাপদ যাতায়াত ব্যবস্থা নিশ্চিত হবে।
উপসংহার বাংলাদেশে যানজট সমস্যা একটি বহুমাত্রিক সংকট, যার সমাধানে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেওয়া ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। এ সমস্যার সমাধান কেবল শহরের মানুষের জন্য নয়, বরং দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের জন্যও জরুরি। সরকার, বিশেষজ্ঞ, এবং জনগণের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় যানজটমুক্ত একটি পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তোলাই আমাদের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত। সময় এসেছে, যখন আমরা শুধু যানজট নিয়ে অভিযোগ নয়, বরং কার্যকর ও টেকসই উদ্যোগ গ্রহণ করে একটি সমাধানের পথে এগিয়ে যাব।