আজকের দিনে প্রযুক্তির হাত ধরে সারা বিশ্ব আমাদের হাতের মুঠোয়। ইন্টারনেটের অবারিত ব্যবহারে তরুণরা নানা সুযোগ কাজে লাগিয়ে নিজেকে গড়ে তুলছে, আয় করছে এবং বিশ্ব অর্থনীতির সাথে একীভূত হচ্ছে। তবে, প্রযুক্তির এই অগ্রগতির মাঝেও এক অশুভ শক্তি যুবসমাজের জন্য বিপদ ডেকে আনছে অনলাইন জুয়া। এর প্রভাবে তরুণ সমাজ হারাচ্ছে সম্ভাবনার পথ, বাড়ছে অপরাধপ্রবণতা ও মানসিক হতাশা।

কিছুদিন আগেও বিকেলবেলায় পাড়া-মহল্লার অলিগলিতে তরুণরা খেলাধুলায় মেতে উঠত। কিন্তু করোনাকালে এই চিত্র বদলে যায়। সেসময়ে অনলাইনে বিভিন্ন গেমের প্রতি আগ্রহ বাড়তে থাকে, যার থেকে একসময় অনেকেই ঝুঁকে পড়ে অনলাইনভিত্তিক জুয়ার দিকে। প্রথমে হয়তো কৌতূহল থেকেই জুয়া খেলা শুরু করে, কিন্তু শিগগিরই এটি হয়ে যায় আসক্তির কারণ।

অনেক তরুণ আজ আর ফুটবল বা ক্রিকেটের খেলাধুলা নিয়ে আলোচনা করে না, বরং কে কত টাকা জিতেছে বা হারিয়েছে, সে প্রসঙ্গ উঠে আসে তাদের আলোচনায়। এই জুয়ার নেশায় ডুবে অনেকে এমন অসামাজিক কাজের দিকে ঝুঁকছে যা এক সময় সমাজের জন্য বড় বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। এর ফলে সামাজিক অপরাধ, যেমন চুরি, ডাকাতি এবং ছিনতাই বাড়ছে। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা যায়, তরুণদের বড় একটি অংশের জীবনে এই আসক্তি বড় ধরনের মানসিক ও আর্থিক সংকট সৃষ্টি করেছে। যা উঠে এসেছে তাদেরই বক্তব্যে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক তরুণ জানায়, তার প্রিয় তারকার বিজ্ঞাপন দেখে অনলাইন জুয়ার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে সে জুয়া খেলা শুরু করে। আরেকজন যুবক বলেন, তার বন্ধু মাত্র ৫৫০ টাকা বিনিয়োগ করে বিশাল অঙ্কের টাকা জিতেছিল, যা তাকে প্রলুব্ধ করে। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই তিনি ঋণের ভারে জর্জরিত হয়ে যান।

এ নিয়ে আরেক যুবক তার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে বলেন, তিনি তার বন্ধুকে একবার মাত্র ৫৫০ টাকা দিয়ে ফুটবল লিগের "মাল্টি" নামক অপশনে জুয়া ধরে ৫৫,০০০ টাকা জিততে দেখেন। তার প্রভাবে তিনিও জুয়া খেলায় আসক্ত হন। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই তিনি বিপুল পরিমাণ টাকা হারিয়ে ঋণের ভারে জর্জরিত হয়ে পড়েন। এমনকি এক পর্যায়ে নিজের মোটরবাইকও বিক্রি করে দেন, কিন্তু তাও ঋণ পরিশোধ করতে সক্ষম হননি।

আরেক তরুণ জানায়, জুয়ায় বিপুল পরিমাণ ঋণে ডুবে তিনি এক পর্যায়ে এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যান। সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের অভিজ্ঞতা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, সবাইকেই এই নেশায় টেনে আনার পেছনের কারণগুলো প্রায় একই রকম।

এই সংকট নিরসনে সরকার সম্প্রতি নতুন ‘জুয়া প্রতিরোধ আইন, ২০২৩’-এর খসড়া তৈরি করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ। মূলত ১৮৬৭ সালের পুরোনো ‘দ্য পাবলিক গ্যাম্বলিং অ্যাক্ট’কে যুগোপযোগী করে নতুন আইনে প্রণয়ন করা হচ্ছে।

নতুন আইনে অনলাইন জুয়াকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কারণ, অনলাইন জুয়ার মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে এবং এতে বহু মানুষ নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে। অনলাইন জুয়ার প্রভাবে সংঘর্ষ, এমনকি খুনের ঘটনাও ঘটছে। পাতানো খেলা বা ম্যাচ ফিক্সিংও একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা নতুন খসড়া আইনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। নতুন আইনে জুয়ার শাস্তি সর্বোচ্চ তিন বছরের কারাদ- বা ৫ লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দ- হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে। আগের আইনে সর্বোচ্চ শাস্তি ছিল ৫০০ টাকা জরিমানা ও তিন মাসের কারাদ-।

তবে, শুধুমাত্র আইন প্রণয়ন করলেই সমাধান আসবে না। পরিবার, সমাজ, এবং গণমাধ্যমেরও বড় ভূমিকা রয়েছে এই সংকট মোকাবিলায়। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সেলিব্রিটিদের উচিত এই ধরণের প্ল্যাটফর্মের প্রচার থেকে বিরত থাকা এবং যুবসমাজকে সচেতন করা। এছাড়া শিক্ষিত সমাজ, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, এবং অভিভাবকদেরও উচিত এই সমস্যা সমাধানে সম্মিলিতভাবে কাজ করা।

তরুণদের সম্ভাবনাকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতে এখনই প্রয়োজন সচেতনতা এবং দায়িত্বশীলতা। পরিবারের ছোট্ট পরিসর থেকে শুরু করে জাতীয় পর্যায় পর্যন্ত, সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সম্ভব হবে এই সমস্যা নিরসন।

লেখক: শিক্ষার্থী
আইন বিভাগ
ফেনী ইউনিভার্সিটি