সীসা দূষণ বর্তমান বিশ্বে অন্যতম গুরুতর পরিবেশগত সমস্যা। যা মানুষের স্বাস্থ্য ও পরিবেশের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে। সীসা একটি বিষাক্ত ধাতু, যা প্রধানত বায়ু, মাটি, পানি এবং খাদ্যের মাধ্যমে মানুষের শরীরে প্রবেশ করে এবং দীর্ঘমেয়াদি সংস্পর্শে মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্য ক্ষতির সম্মুখীন করে। বিশেষ করে শিশুদের ক্ষেত্রে, সীসা তাদের মস্তিষ্কের বিকাশে বাধা সৃষ্টি করে, শিখন ক্ষমতা হ্রাস করে এবং আচরণগত সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে।
সীসা দূষণ হল পরিবেশে সীসা পদার্থের অতিরিক্ত উপস্থিতি, যা মানবদেহের পাশাপাশি অন্যান্য জীব এবং পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। এটি প্রধানত বিভিন্ন শিল্পকারখানা, যানবাহন, পুরনো ব্যাটারি, এবং সীসাযুক্ত পণ্য যেমন রং এবং পাইপের মাধ্যমে পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ে। এছাড়াও আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অনেক জিনিসপত্র, যেমন খেলনা, সিরামিকের তৈজসপত্র, কিছু ধরনের কসমেটিক্স, এবং পানির পুরনো পাইপেও সিসার উপস্থিতি থাকতে পারে। সীসার অতিরিক্ত উপস্থিতি মাটি, পানি এবং বায়ুকে দূষিত করে এবং এর প্রভাবে বিভিন্ন স্বাস্থ্যঝুঁকি সৃষ্টি হয়। সিসার ক্ষতিকর প্রভাবের কারণে স্নায়ুতন্ত্র, হৃদপিণ্ড এবং কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। শিশুদের জন্য এটি আরও বেশি ক্ষতিকর, কারণ সীসা তাদের মস্তিষ্কের বিকাশে বাধা দেয় এবং দীর্ঘমেয়াদি মানসিক ও শারীরিক সমস্যা সৃষ্টি করে। এমনকি গর্ভবতী নারীদের ক্ষেত্রেও সিসার সংস্পর্শ গর্ভস্থ শিশুর বিকাশে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে, যার ফলে শিশুর সঠিক শারীরিক ও মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়।
সীসা দূষণের ক্ষতিকর প্রভাব মোকাবেলায় সরকার এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্রিয় ভূমিকা অপরিহার্য। সরকার কঠোর আইন প্রণয়ন এবং সীসাযুক্ত পণ্যের উৎপাদন ও ব্যবহার নিষিদ্ধ করার মাধ্যমে সঅসা দূষণ প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারে। পুরনো শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোতে পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির প্রয়োগ বাধ্যতামূলক করে এবং সিসাযুক্ত জ্বালানির বিকল্প জ্বালানির প্রচলন নিশ্চিত করাও সরকারের দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত। একইসাথে, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো জনগণের মধ্যে সিসা দূষণ সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে। যেমন, সীসার ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও স্থানীয় কমিউনিটিতে সচেতনতামূলক কর্মসূচি আয়োজন করা যেতে পারে, যা মানুষকে সীসার ঝুঁকি সম্পর্কে জানাতে এবং সচেতন করে তুলতে সহায়তা করবে।
এছাড়াও সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি এবং জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ সীসা দূষণ প্রতিরোধের ক্ষেত্রে অপরিহার্য। সীসা দূষণের বিরূপ প্রভাব থেকে সমাজকে রক্ষা করতে হলে, সাধারণ জনগণকে সিসার উৎস এবং এর ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে অবহিত করা প্রয়োজন। জনগণের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানোর মাধ্যমে আমরা সীসা দূষণের ক্ষতি থেকে মুক্ত থাকতে পারব।
প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন সীসা দূষণ প্রতিরোধে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। উদ্ভাবনী সীসামুক্ত প্রযুক্তি এবং নতুন ধরনের ফিল্টার ব্যবস্থা দূষণ কমাতে সক্ষম। পুরনো শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোতে পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির প্রয়োগ বাধ্যতামূলক করার মাধ্যমে দূষণের মাত্রা কমানো সম্ভব। পুনর্ব্যবহারযোগ্য উপকরণের ব্যবহারও সিসা দূষণ প্রতিরোধে একটি কার্যকর পন্থা হিসেবে কাজ করতে পারে।
“সীসা দূষণ বন্ধ হলে, বাড়বে শিশু বুদ্ধি-বলে” এই বছরের আন্তর্জাতিক সীসা বিষক্রিয়া প্রতিরোধ সপ্তাহের প্রতিপাদ্য আমাদের সামনে সীসা দূষণ প্রতিরোধের গুরুত্বকে তুলে ধরছে। সীসার বিষাক্ত প্রভাব শিশুদের মানসিক ও শারীরিক বিকাশে মারাত্মক প্রভাব ফেলে, যা তাদের ভবিষ্যতের সম্ভাবনাকে সীমিত করে দিতে পারে। সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমেই আমরা সীসা দূষণের বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারি। সরকার, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, স্থানীয় সম্প্রদায় এবং আন্তর্জাতিক সংস্থার সমন্বিত পদক্ষেপ সীসা দূষণের ক্ষতি থেকে রক্ষা পাওয়ার একমাত্র উপায়। এই প্রচেষ্টার মাধ্যমে আমরা একটি সীসামুক্ত, স্বাস্থ্যকর ভবিষ্যত নিশ্চিত করতে পারব, যেখানে আমাদের শিশুদের বুদ্ধি-বিকাশ সুরক্ষিত থাকবে।
লেখক
শিক্ষার্থী, পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ, স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ
পরিবেশ ও দূষণ নিয়ন্ত্রণ সমন্বয়কারী, ইয়ুথনেট ফর ক্লাইমেট জাস্টিস