ফেনীর আলোচিত সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার শিক্ষার্থী নুসরাত জাহান রাফি হত্যাকাণ্ড নিয়ে নতুন করে জেলা জুড়ে আলোচনা তৈরি হয়েছে। মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের পুলিশি হেফাজতে নির্যাতন করে স্বীকারোক্তি ও অর্থ আদায়ের অভিযোগে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) সাবেক প্রধান বনজ কুমার মজুমদারসহ জড়িত সাত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলার আবেদন করা হয়েছে।

গতকাল বুধবার (২৩ অক্টোবর) দুপুরে নুসরাত হত্যা মামলায় ফাঁসির দন্ডপ্রাপ্ত ইমরান হোসেন মামুনের মা নুর নাহার ফেনীর সোনাগাজী আমলী আদালতের বিচারক সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ফারহানা লোকমানের আদালতে তাদের বিরুদ্ধে মামলার আবেদন করেছেন। একই দিন নুসরাত হত্যা মামলা পুনঃতদন্তের দাবিতে জেলা প্রশাসকের হাতে উপদেষ্টার বরাবর স্মারকলিপি দিয়েছেন ওই মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের পরিবারের সদস্যরা। এ খবর প্রকাশের পর জেলাজুড়ে নুসরাত হত্যাকাণ্ড নিয়ে নতুন আলোচনা তৈরি হয়েছে। আদালত সূত্রে জানা গেছে, এ মামলার ব্যাপারে আজ আদালত আদেশ দিতে পারেন।

মামলায় অন্য আসামিদের মধ্যে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) ফেনীর তৎকালীন পুলিশ সুপার মাঈন উদ্দিন, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ইকবাল হোসেন, পরিদর্শক শাহ আলম, উপ-পরিদর্শক রতেপ চন্দ্র দাস, লুৎফর রহমান ও চট্টগ্রাম পিবিআইয়ের উপ-পরিদর্শক সন্তোষ চাকমার নাম উল্লেখ করা হয়েছে।

মামলার আবেদনে অভিযোগ করা হয়েছে, আলোচিত নুসরাত হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ১৬ আসামিকে মামলায় অব্যাহতি দেওয়ার আশ্বাসে আসামিদের পরিবার ও স্বজন থেকে বিভিন্ন সময়ে মোট ৭৭ লাখ টাকাসহ নানা সুযোগ-সুবিধা নিয়েছেন উক্ত পিবিআই কর্মকর্তারা। কিন্তু এরপরও নির্যাতন করে তাদের জোরপূর্বক স্বীকারোক্তি দিতে বাধ্য করা হয়েছে। পরে আদালত তাদের মৃত্যুদন্ডে দণ্ডিত করেছেন। এ বিষয়ে নুসরাত হত্যা মামলার সাক্ষী পিবিআই উপ-পরিদর্শক জাহাঙ্গীর আলম বাবলু গত ১২ আগস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক নিজের আইডিতে হত্যা মামলাটি পুনরায় তদন্তের প্রয়োজন বলে উল্লেখ করে একটি পোস্ট দেন। সেই পোস্টটি মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত স্বজনদের নজরে এলে নুসরাত হত্যা মামলার ১৩ নম্বর আসামি ইমরান হোসেন মামুনের মা নুর নাহার বাদী হয়ে আদালতে বনজ কুমারসহ ওই পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে এ মামলার আবেদন করেন।

বাদী পক্ষের আইনজীবী কামরুল হাসান দৈনিক ফেনীকে বলেন, পিবিআইয়ের সাবেক প্রধান বনজ কুমারসহ অভিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তারা শুরু থেকেই প্রকৃত ঘটনা আড়াল করে মামলাটি ভিন্ন খাতে নেন। মামলার চার্জশিট দেওয়ার আগে বিভিন্ন সময়ে আসামির স্বজনদের কাছ থেকে বনজ কুমারের কথা বলে তারা ৩০ লাখ টাকা নেন। পরে বিভিন্ন সময় এ কর্মকর্তারা স্বজনদের কাছ থেকে আরো ৪৭ লাখ টাকাসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা আদায় করেছেন।

তিনি বলেন, আসামিরা ইতোমধ্যে আদালতে পিটিশনের সময় পিবিআই কর্মকর্তাদের নির্যাতন ও জোর করে স্বীকারোক্তি আদায়ের কথা বলেছেন।

গত ১৯ জুলাই এ মামলার প্রধান অভিযুক্ত বনজ কুমার চাকুরি থেকে অবসরে যান। অপর অভিযুক্তরা পিবিআইয়ের বিভিন্ন ইউনিটে কর্মরত রয়েছেন।

প্রসঙ্গত, ২০১৯ সালের ২৭ মার্চ সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার আলিম পরীক্ষার্থী নুসরাত জাহানকে যৌন নিপীড়নের দায়ে মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ৬ এপ্রিল ওই মাদরাসা কেন্দ্রের সাইক্লোন শেল্টারের ছাদে নিয়ে অধ্যক্ষের সহযোগীরা নুসরাতের শরীরে আগুন ধরিয়ে দেন। ১০ এপ্রিল রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে মারা যান নুসরাত জাহান রাফি। এ ঘটনায় মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলাকে প্রধান আসামি করে আটজনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত আরও চার-পাঁচ জনকে আসামি করে নুসরাতের ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান ৮ এপ্রিল সোনাগাজী মডেল থানায় মামলা করেন।

নুসরাত হত্যা মামলায় পুলিশ ও পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলাসহ ২১ জনকে বিভিন্ন স্থান থেকে গ্রেপ্তার করে। পরে ওই বছরের ২৯ মে ১৬ জনকে আসামি করে ৮০৮ পৃষ্ঠার অভিযোগপত্র দাখিল করে পিবিআই। ২০১৯ সালের ২৪ অক্টোবর নুসরাত হত্যা মামলায় ১৬ আসামির মৃত্যুদণ্ড দেন আদালত। বর্তমানে এ হত্যা মামলাটি উচ্চ আদালতে ডেথ রেফারেন্স শুনানীর অপেক্ষায় আছে।

মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তরা হলেন সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার সাবেক অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলা, নূর উদ্দিন, শাহাদাত হোসেন শামীম, সোনাগাজী পৌরসভার কাউন্সিলর মাকসুদ আলম, সাইফুর রহমান মোহাম্মদ জোবায়ের, জাবেদ হোসেন ওরফে সাখাওয়াত হোসেন জাবেদ, হাফেজ আব্দুল কাদের, আবছার উদ্দিন, কামরুন নাহার মনি, উম্মে সুলতানা ওরফে পপি ওরফে তুহিন ওরফে শম্পা ওরফে চম্পা, আব্দুর রহিম শরীফ, ইফতেখার উদ্দিন রানা, ইমরান হোসেন ওরফে মামুন, মোহাম্মদ শামীম, মাদরাসার গভর্নিং বডির সহ-সভাপতি রুহুল আমীন ও মহিউদ্দিন শাকিল। তারা সকলে বিভিন্ন কারাগারে রয়েছেন।