তরকারি আড়তে পাইকারীতে পটলের কেজি ৪০ টাকা, খুচরা বাজারে বিক্রি করা হয়েছে ৭০ টাকা। বেগুন পাইকারিতে ৫৫ টাকা খুচরা বাজারে ১০০ টাকা। গত সোমবার এবং মঙ্গলবার মোট ১৩টি সবজির পাইকারী ও খুচরা দামে দেখা গেছে বিস্তর ফারাক। কেবল খুচরা বাজারে মনগড়া দামই একমাত্র সমস্যা নয়, আড়তে ওজনে হেরফেরও সবজির দাম বৃদ্ধির একটি কারণ বলছেন খুচরা বিক্রেতা। ফেনী শহরের দাউদপুর তরকারি আড়ত, সুলতান মাহমুদ পৌর হকার্স মার্কেটে তরকারি বাজার এবং বড় বাজার ঘুরে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। যদিও দামের এই অসঙ্গতির দায় আড়তদার বা খুচরা বিক্রেতা নিতে রাজি নন, দিনশেষে ভোক্তার ওপরই সকল চাপ।

আড়তদার ও খুচরা ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, তরকারি আড়ত থেকে আধা কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত ফেনী বড় বাজার, পৌর হকার্স মার্কেটে পাইকারি থেকে খুচরা পর্যায়ে দ্বিগুণ কিংবা তার বেশি দামে বিক্রি করা হয়।

পাইকারি ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, তরকারি আড়তে বেপারীরা ট্রাকে করে সবজি নিয়ে আসে। তার সবজির যে দর ঠিক করে দেয় সে অনুযায়ী পাইকারী দর ঠিক করা হয়। বিক্রিতে ১০০ টাকায় সাড়ে ৫ টাকা কমিশন পাওয়া যায়। তবে কৃষকদের কাছ থেকে কেনা দর থেকে অল্প লাভে পাইকারিতে বিক্রি করা হয়। খুচরা সর্বোচ্চ ১০ টাকা কিংবা ক্ষেত্রবিশেষে ২০ টাকা লাভ করার কথা।

খুচরা বাজারে দামের এ তারতম্যের ব্যাপারে জানতে চাইলে বিক্রেতারা বলেন, আড়ত থেকে খুচরা বাজারে আনতে গাড়িভাড়া, শ্রমিক খরচ, পলিথিন ব্যাগ কেনার খরচ, জায়গা ভাড়া, বিদ্যুৎ বিলসহ আরও অনেক খরচ থাকে। এসব খরচ মিটিয়ে লাভ করতে হলে বেশি দামে বিক্রি করা ছাড়া উপায় নেই।

এ ব্যাপারে আব্দুর রহিম নামে ফেনী বড় বাজারের একজন খুচরা সবজি ব্যবসায়ী বলেন, ৩০ টাকা দিয়ে কিনলে প্রতি কেজিতে আরও ৩ টাকা খরচ করতে হয়। বিক্রির সময় অনেক ক্রেতা খুচরা টাকা কম দেয়, বস্তা কিনলে তারমধ্যে ৫ থেকে ৭ কেজি নষ্ট থাকে। গাড়িভাড়া, লেবার খরচ সব মিলিয়ে লাভ হিসাব করেই দাম নির্ধারণ করতে হয় বলে পাইকারী থেকে খুচরায় সবজির দাম এত বাড়ে।

বিপুল নামের আরেক খুচরা ব্যবসায়ী বলেন, কম দামে কিনলেও সব সবজি মানুষ কেনে না। লাভের জন্য দাম বাড়তি নিতে হয়।

পৌর হর্কাস মার্কেটের আজিম নামের আরেক খুচরা ব্যবসায়ী বলেন, পাইকারি বাজার থেকে এখানে আনতে পরিবহন খরচ, লেবার খরচ হয়। আর বর্তমানে সব খরচ বাড়ায় সবজিতেও দাম বেড়েছে।

সকালে এক দরে কেনা সবজি দিনে তিন দরে বিক্রি প্রসঙ্গে খুচারী ব্যবসায়ীরা জানান, বাজারে দাম ওঠা-নামা করে সরবরাহের ওপর। দুপুরে অনেক সময় জিনিসপত্র বেশি থাকে, বিকালে কমে যায়। তখন আমাদের দামও সামান্য বাড়াতে হয়।

এ বিষয়ে ফেনী পৌর তরকারি আড়তের শাহজাহান বাণিজ্যালয়ের শাহজাহান ওমর বলেন, পাইকারিতে কেনা দাম থেকে সর্বোচ্চ ২০ টাকা লাভে সবজি বিক্রি করা যায়। সবজির দাম সকাল ১০টা পর্যন্ত একদরে বিক্রি হয়, দুপুরে আরেক দর, এরপর বিকালে অন্য দরে বিক্রি হয়। কারণ সবজি পচনশীল হওয়ায় ধরে রাখা যায় না। তিনি আরও বলেন, অনেক ভাল মরিচের সাথে পচা মরিচ মিশিয়ে কম দামে বিক্রি করে দেয়।

ফেনী পৌর তরকারি আড়ত ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক কাজী আবু জাফর বলেন, আড়তে প্রতিদিন ১ থেকে দেড় কোটি টাকার সবজি বেচাবিক্রি হয়ে থাকে। এতে ব্যবসায়ীদের সর্বোচ্চ ২০ হাজার সর্বনিম্ম ৫ হাজার লাভ হত। তবে এখানে কেউ চাঁদা নেয় না। বেপারীর কাছ থেকে নগদ টাকা সবজি কিনতে হয়। তবে খুচরা বাজারে মনিটরিং বেশি প্রয়োজন, যাতে ১০ টাকার বেশি লাভে বিক্রি করতে না পারে।

এ বিষয়ে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর এর সহকারী পরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) মোঃ কাওছার মিয়া বলেন, কাঁচাপণ্যের বাজার দর নিয়ন্ত্রণ করে কৃষি বিপণন অফিস। জেলা মার্কেটিং অফিসার তদারকি করে থাকেন। শাক-সবজির ক্ষেত্রে ভোক্তা অধিকার আইনে ধারা অনেক কম। তবে কম দামে কিনে বেশি দামে বিক্রি করা আইনগতভাবে অপরাধ। এমন অভিযোগ ফেলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান তিনি।

সরেজমিনে বাজারে গিয়ে দেখা যায়, পাইকারির চেয়ে দ্বিগুণ দামে সবজি বিক্রি করা হচ্ছে। পাইকারিতে কাঁচামরিচ বিক্রি হচ্ছে ২২০ থেকে ৩০০ টাকা দরে, খুচরা বাজারে তা বিক্রি হচ্ছে ৩৪০-৩৫০ টাকায়। তবে পাইকারি বাজারে এলসি মরিচ (পঁচনশীল) বিক্রি করা হচ্ছে ১২০ টাকায়। খুচরা ব্যবসায়ীরা দুইপ্রকারের মরিচ একসাথে মিশিয়ে দাম বাড়িয়ে বিক্রি করে থাকেন এমন তথ্য জানিয়েছেন একাধিক পাইকারী ব্যবসায়ী।

এছাড়া পাইকারীতে কেজিপ্রতি পটল ৩০ টাকা খুচরা বাজারে ৭০ টাকা, পেঁপে ১৫ টাকা খুচরায় ৩৫ টাকা, লতি ও কচুর মুখি পাইকারিতে ৪৫ থেকে ৫০ টাকা বিক্রি করলেও খুচরা বাজারে তা ৮০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। বেগুন পাইকারিতে ৫৫ টাকা হলেও খুচরা বাজারে ১০০ টাকা, টমেটো পাইকারিতে ১৫০ টাকা, তা খুচরা বাজারে ১৮০ থেকে ১৯০ টাকা, আলু পাইকারিতে ৪৭ টাকা হলেও খুচরা বাজারে ৫৫ টাকা, লেবু প্রতি পিস ৫ টাকা হলেও খুচরায় ১০ টাকা, কাঁকরোল পাইকারিতে ৬০ টাকা খুচরায় ১০০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। এছাড়াও পাইকারিতে মুলা ৫০ টাকা, ফুলকপি ১০০ টাকা, কাঁচকলা ৫০ টাকা, সিম ১৮০ টাকা, মিষ্টি কুমড়া ৬০ টাকা, ধনিয়াপাতা ৪০০ টাকা, পেঁয়াজ ১০৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

ভ্যানগাড়িতে তরকারি বিক্রি করেন মামুনুর রশীদ। তিনি বলেন, প্রতিদিন তরকারি আড়ত থেকে সবজি কিনে গ্রামে বিক্রি করি, এরমধ্যে অনেক পঁচা থাকে। ফেলে দিতে হয়। যার জন্য কেনার চাইতে বেশী দামে বিক্রি করতে হয়।



চট্টগ্রাম-নোয়াখালীর সবজির দাম বেশি
ফেনী পৌর তরকারি আড়তে ৪৪টি দোকান রয়েছে। যেখানে ২০ থেকে ২৫ জন বেপারীর মাধ্যমে উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলা যশোর, পাবনা, মেহেরপুর, বগুড়া, খুলনাসহ বিভিন্ন জেলা থেকে পণ্য আসে। আগের দিন দুপুরে রওনা দিয়ে পরদিন সকালে ফেনীতে পৌঁছায়। এ অঞ্চলের সবজিগুলো একদামে বিক্রি হলেও চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী থেকে আসা সবজি বেশি দামে বিক্রি হয় বলে জানান আড়তদাররা।

তারা বলেন, চট্টগ্রাম-নোয়াখালীর পণ্য খুব সহজে ফেনী চলে আসে। কারণ দুরত্ব কম। এতে ভোক্তা পর্যায়ে ভালো ও তাজা পণ্য সরবরাহ করা সম্ভব হয়। যার কারনে অন্যান্য জেলার সবজির চাইতে এ অঞ্চলের পণ্যর দাম একটু বেশি।

খুরশিদ আলম নামে পৌর তরকারি আড়তের এক ব্যবসায়ী বলেন, দাম নির্ধারণ করে বেপারীরা। নিজ খরচে কৃষক থেকে সবজি সংগ্রহ করে তারা আড়তে আনে। আমরা শুধু কমিশনে বিক্রি করি। কাঁচামালের বাজার নিয়ন্ত্রণের কোন সুযোগ নেই, কারণ এখানে সিন্ডিকেটের বিষয় নেই। একদিন একদর থাকবে এটা স্বাভাবিক বিষয়। পচনশীল পণ্য কেউ ধরে রাখে না। সবাই ছেড়ে দেয়, কম দাম হলেও। তাছাড়া বন্যার পানিতে অনেক ফসল নষ্ট দাম বেড়েছে।

তিনি বলেন, নোয়াখালী-চট্টগ্রাম থেকে তরতাজা সবজি আসায় অনেক সময় বেশি দামে বিক্রি হয়। উত্তরবঙ্গের বরবটির কেজি ৫০ টাকা হলে, সীতাকুণ্ডের বরবটির কেজি হয় ৮০ টাকা।

সুজন নামে এক বেপারী বলেন, কাঁচামাল পণ্য পচনশীল। আমরা আনার পথে গাড়িভাড়া, লেবার খরচসহ অন্যান্য দাম নির্ধারণ করে দর ঠিক করা হয়। ফেনী নিয়ে আসতে প্রায় ২৭ হাজার টাকা গাড়ি ভাড়া দিতে হয়। আমরা ক্যারেটে করে পণ্য নিয়ে আসি, ক্যারেটও কিনতে হয়। যার কারণে প্রতি কেজিতে ক্যারেটের দাম ৬ টাকা যোগ করতে হয়। গাড়িভাড়া, ক্যারেট খরচ সবমিলিয়ে দর নির্ধারণ করা হয়।



ক্রেতাদের অসন্তোষ
এদিকে পাইকারি খুচরায় ব্যবধান নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন ভোক্তারা। তারা বলছেন, পাইকারি পর্যায়ে কত দামে কিনে নিয়ে আসে তা আমরা দেখছি না। তবে একটি পণ্য দ্বিগুণ দামে বিক্রি করা কখনই সমর্থনযোগ্য না। এ বিষয়ে প্রশাসনের তদারকি অনেক বেশি প্রয়োজন। কাঁচা পণ্যের দাম নির্ধারণ করলে মানুষ সঠিক দামে পণ্য হাতে পাবে।

অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধির বিষয়ে ফেনী বড় বাজারে একজন ক্রেতা মনির আহমেদ বলেন, বিক্রেতারা যেমন ইচ্ছা দাম আদায় করছেন। আমরা তো বাধ্য হয়ে কিনছি। কিন্তু বাজার নিয়ন্ত্রণ করার নানা কর্তৃপক্ষ থাকলেও এসব দেখার কেউ নেই।

আলমগীর হোসেন নামে আরেক ক্রেতা বলেন, বাজারে খুচরা-পাইকারিতে ব্যবধান নিয়ন্ত্রণে প্রশাসনের তদারকি বাড়ানো প্রয়োজন। শুনেছি টাস্ক ফোর্সের অভিযান শুরু হয়েছে। এসব বিষয়ে তদারকি করলে বাজার নিয়ন্ত্রণে আসবে।

এ বিষয়ে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর এর সহকারী পরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) মোঃ কাওছার মিয়া বলেন, এমন কোন অভিযোগ যদি কেউ দেয় বা প্রমাণ পেলে আইন অনুযায়ী তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।



কম দামে মেলে ভ্যানগাড়িতে
বাজার ঘুরে ব্যবসায়ী ও আড়তদারদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, পাইকারি আড়তে সকালে সবজির দাম একদর, সেটি দুপুর পর্যন্ত গড়ালে আরও কম দামে বিক্রি হয়। শহর ঘুরে দেখা গেছে, খুচরা বাজারে সবজির দামের চেয়ে ভ্যান গাড়িতে আরও কমে বিক্রি করা হচ্ছে।

এ ব্যাপারে ব্যবসায়ীরা জানান, দুপুরের দিকে সবজি কিনে থাকে তারা। তখন সবজির দাম কম থাকে। কম দামে কেনায় তারা অল্প লাভে বিক্রি করতে পারে।

এ ব্যাপারে ভ্যান গাড়িতে সবজি বিক্রি করা একাধিক ব্যবসায়ীর সাথে কথা হলে তারা জানান, তাদের দোকানভাড়া, লেবার কিংবা অন্য কোন খরচের প্রয়োজন হয় না, যার কারণে তারা খুচরা বাজার থেকে কম দামে বিক্রি করতে পারে।

নাজির রোডে ভ্যানগাড়িতে সবজি বিক্রেতা রহিমের সাথে কথা হলে তিনি বলেন, কেবল দুপুরে নয়, অনেকে সকালেও আড়ত থেকে সবজি কেনে। কিন্তু ভ্যানগাড়িতে আনুষাঙ্গিক ব্যয় কম। যার কারণে কেনা দাম থেকে অল্প লাভেই বিক্রি করা যায়।