ফেনীর উত্তরাঞ্চলের দুই উপজেলা ফুলগাজী ও পরশুরামের মানুষ বন্যার ব্যাপারে অভ্যস্ত থাকলেও এ বিষয়ে একেবারেই অভিজ্ঞতা ছিল না অন্য অঞ্চলের মানুষের। ফলে বন্যায় আগাম প্রস্তুতি কিংবা পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে ধারনা না থাকায় একেবারে অসহায় হয়ে পড়েছিলেন তারা। বন্যায় করণীয় সম্পর্কে পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বেড়েছে বলছেন সাধারণ মানুষ।
জানা গেছে, প্রতিবছর ১৩ অক্টোবর দুর্যোগ প্রশমন দিবস হিসেবে পালন করা হয়ে থাকে। প্রতিবার দিবসটি উপলক্ষ্যে ঘুর্ণিঝড় কিংবা অগ্নিকান্ডে করণীয় সম্পর্কে প্রশিক্ষণ কিংবা আলোচনা সভা করা হলেও বন্যা মোকাবেলায় তেমন ধারণা দেওয়া হয় না। ফলে ফেনীর বেশিরভাগ মানুষই বন্যায় পূর্বপ্রস্তুতি ও মোকাবেলায় করণীয় সম্পর্কে কোন ধারণা নেই তাদের।
চলতি বছরের আগস্টের শেষ দিকে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়ে ফেনী। আগস্ট মাসের শেষ ১০ দিন ভয়াবহ বন্যায় ফেনীতে কৃষি, ঘরবাড়িসহ ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি এখনো জনপদে স্পষ্ট।
স্থানীয় মানুষরা জানান, প্রাকৃতিক দুর্যোগ বলতে বুঝি আমরা শুধুমাত্র ঘুর্ণিঝড় বুঝি। বন্যা, খরার মতো এসব দুর্যোগের বিষয়ে তেমন কোন ধারণা নেই তাদের। বন্যার প্রস্তুতি কিংবা করণীয় সম্পর্কে মানুষের ধারনা থাকলে ক্ষয়ক্ষতি আরও কম হতো বলে মনে করছেন তারা।
ছাগলনাইয়ার নিজকুঞ্জরা এলাকার কাশেম চৌধুরী নামে বয়োবৃদ্ধ একজন জানান, আমার ৭৫ বছর বয়সে এমন বন্যা আমি দেখিনি। এলাকার মধ্যে আমাদের বাড়ি সবথেকে উঁচু তবে এখানেও পানি উঠেছে। এ এলাকার মানুষ বন্যার সাথে অভ্যস্ত না। পানি বাড়তে শুরু করলেও সবার ধারণা ছিল তা নেমে যাবে। হঠাৎ সবকিছু ডুবে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয় মানুষের।
ঘোপাল ইউনিয়নের লাঙ্গলমোড়া গ্রামের বাসিন্দা মাঈন উদ্দিন জানান, বন্যায় দোকান-ঘরবাড়িসহ তার প্রায় ৫ লাখ টাকা ক্ষতি হয়েছে। তিনি বলেন, আমাদের বাড়ির সামনে ফেনী নদী। নদীর পানি বাড়লে জোয়ারে কিছু পানি লোকালয়ে প্রবেশ করতে পারে এটা আমাদের কাছে স্বাভাবিক বিষয় ছিল। কিন্তু এভাবে পানির তীব্র স্রোতে ঘর ভাসিয়ে নেবে সেটি এলাকার কেউ ধারনা করতে পারেনি। এ ব্যাপারে আমাদের কোন অভিজ্ঞতা না থাকায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি বেশি।
ফেনী সদরের ফাজিলপুর এলাকার এমদাদুল হক নামে একজন বলেন, আমার নিজের চোখে পানির এমন ভয়াবহতা কখনও দেখিনি। ফেনী নদীর পানি বাড়লেও কখনও ফাজিলপুরে পানি ওঠেনি, যার কারনে আমরা ওভাবে চিন্তিত ও ছিলাম না।কিন্তু সকালের বৃষ্টি হলো সন্ধায় ঘরের সামনে গলা সমান পানি। না পেরেছি আসবাপত্র সরাতে না পেরেছি ঘরের ধান-চাউল সরাতে। সব পানিতে ডুবে শেষ হয়ে গেছে। বন্যা হলে কি করতে হয় জানি না, নিজেরা আটকে ছিলাম ঘরে। পরে উদ্ধারকর্মীরা এসে উদ্ধার করে।
একই কথা বলছেন দাগনভুঞার আব্দুল্লাহ আল মামুন। তিনি জানান, ঘরবাড়ি ছেড়ে পরিবারের সবাইকে নিয়ে দ্রুত আশ্রয়কেন্দ্রে গিয়েছি। তবে ঘরের রক্ষা করতে পারিনি। কেবল পরনের জামাকাপড় নিয়ে বের হয়ে গেছি। তিন দিন পর বাড়িতে গিয়ে দেখি ঘরের ফ্রীজ ভাসতেছে। পাশাপাশি আলমিরাতে থাকা কাপড়চোপড়, আসবাপত্র, টিভি সব নষ্ট হয়ে গেছে।
সোনাগাজীর বাসিন্দা নুরুল হক বলেন, সোনাগাজীর মানুষ ঘুর্ণিঝড় সম্পর্কে জানে। তখন আমাদের আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে বলা হয়, এবারের বন্যায় ছিলনা কোন সতর্কতা। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ছিল পুরো জেলা। কি থেকে কি হয়েছে নিজেরাই বুঝে উঠতে পারিনি। এসব বিষয়ে আমাদের সতর্কতা বাড়ানো উচিত। ঘুর্ণিঝড়ের করণীয় যেভাবে জানানো হয় বন্যার করণীয় সম্পর্কেও জানানো উচিত।
অন্যদিকে ফুলগাজী পরশুরামে ক্ষয়ক্ষতি হলেও সেখানকার মানুষ বলছেন তারা বন্যার পানিতে অভ্যস্ত। তবে এবারের বন্যা অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে। ফুলগাজীর দরবারপুরের বাসিন্দা মোবারক হোসেন। বন্যায় তার বসতভিটা ও বিলীন হয়ে গিয়েছিল। তিনি জানান, মুহুরী নদীর বাঁধ প্রতিনিয়তই ভাঙে। এবারের বন্যার আগেও ভেঙেছে তবে এমন দশা হতে পারে কেউ কল্পনাও করেনি। বন্যা পূর্ববর্তী অবস্থা দেখে ঘরবাড়ি থেকে জানে বেঁচে অন্যের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলাম, ঘরের কিছু জিনিস নিতে পারলেও জানের ভয়ে সব বের করতে পারিনি। তবে এ সময়ে কি করতে হয় আমরা জানি, তবে এবারের অভিজ্ঞতা একেবারেই ভিন্ন।
ফুলগাজী পরশুরামের একাধিক বাসিন্দা জানান, বাঁধ ভেঙে যাওয়ার ফলে তারা এক বছরে ৩ বার ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়েছে। তবে চব্বিশের আগস্টের বন্যা সব রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে। আগামীতে এমন ভয়াবহতা রোধে অগ্রিম পূর্বাভাস ও টেকসই বাঁধ নির্মাণের দাবি জানান তারা।
জেলা প্রশাসন হতে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা গেছে, চলতি বছরের ভয়াবহ বন্যা জেলায় ৮ হাজার ৯৫ টি কাঁচাঘর, ২৫০টি আধাপাকা ঘর বন্যায় সম্পূর্ণ ধ্বসে গিয়ে আনুমানিক ক্ষতি হয়েছে ১৬৩ কোটি ১১ লাখ ৭০ হাজার টাকা। ৫৩ হাজার ৪৩৩টি কাঁচাঘর এবং ২ হাজার ৬৩২টি আধাপাকা ঘরের আংশিক ক্ষতির আর্থিক পরিমাণ ৩৭০ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। সব মিলিয়ে ৬৪ হাজার ৪১৫টি ঘরবাড়িতে মোট ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ৫৩৩ কোটি ৮৯ লাখ ৭০ হাজার টাকা। এছাড়া ৫৪টি মসজিদ সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে মোট ৬ কোটি ৯১ লাখ ৬০ হাজার ক্ষয়ক্ষতি নিরূপন করা হয়েছে। এছাড়া ১৪৪টি মন্দিরে ৪৫ লাখ ২০ হাজার টাকা ক্ষয়ক্ষতি নির্ধারণ করা হয়েছে। এছাড়াও কৃষিখাত, প্রাণিসম্পদ, বিদুৎ ও সড়কে বিশাল অংকের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
পুনর্বাসনে ধীরগতি
ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা ঘুরে এসে এবং স্থানীয়দের মতামত অনুযায়ী বন্যা পরবর্তী পুনর্বাসনে বেসরকারি উদ্যোগ ইতোমধ্যে প্রশংসিত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত মানুষরা বলছেন, ঘর সংস্কার, পুনঃনির্মাণে সরকারি সহায়তা এখনো দৃশ্যমান হয়নি। ধীরগতিতে পুনর্বাসন হলেও বেসরকারি উদ্যোগই মূল ভরসা।
জেলা প্রশাসনের ত্রাণ ও পুনর্বাসন শাখা সূত্র জানায়, ইউএনডিপি ১০ কোটি ৩৫ লাখ টাকা ব্যয়ে ৩ হাজার পরিবারকে ঘর সংস্কারে সহায়তা করতে এগিয়ে এসেছে। একইভাবে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ইপসা ২ কোটি ৫৩ লাখ টাকা, রিক ৮৯ লাখ টাকা এবং মাস্থল ফাউন্ডেশন ১১ লাখ টাকা বসতঘর সংস্কারে সহায়তা দিচ্ছে। জেলা প্রশাসনের সাথে সমন্বয় করে সংস্কার কাজগুলো বাস্তবায়ন হবে।
বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনে ব্যক্তিগত উদ্যোগ এবং স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এগিয়ে আসার অভূতপূর্ব নজির দেখা গেছে। ঘুরে দাঁড়াবে ফেনী শীর্ষক একটি সংগঠন এপর্যন্ত ১৪টি পরিবারকে নতুন ঘর এবং ক্ষতিগ্রস্ত ঘর সংস্কার করে দিয়েছে বলে জানিয়েছেন সংগঠক শরীফুল ইসলাম অপু। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ২১ ব্যাচের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে ৩৮ পরিবারকে ২৫ হাজার টাকা করে সহায়তা দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন ব্যাচ সদস্য শামছুউদ্দৌলা। স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবীরা জানান, এমন সহায়তার তালিকা দীর্ঘ।
জেলা প্রশাসক মুছাম্মৎ শাহীনা আক্তার জানান, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর সহায়তায় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে ২০ হাজার বান্ডেল টিন এবং নগদ ৬ কোটি টাকা বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে। এছাড়া বেসরকারিভাবে যেসব প্রতিষ্ঠান এবং সংগঠন পুনর্বাসনে সহায়তায় এগিয়ে এসেছে তাদের কাজগুলো সমন্বয় করা হচ্ছে।
‘পূর্বাভাস পেলে ক্ষতির মাত্রা কমত’
বন্যায় বিপর্যস্ত হওয়া সাধারণ মানুষ বলছেন, বন্যার কোন পূর্বাভাস জানতে পারেননি তারা। বিশেষ করে ছাগলনাইয়া, ফেনী সদর, দাগনভুঞা ও সোনাগাজীর মানুষ তাদের এলাকায় বন্যা হতে পারে এমন চিন্তাও করেননি স্থানীয় মানুষ। স্থানীয়দের সাথে কথা বলে এমন তথ্য উঠে এসেছে। তারা বলছেন পূর্বাভাস ফেলে এত ক্ষয়ক্ষতি হতো না।
ছাগলনাইয়ার একরাম উদ্দিন বলেন, যেখানে আমাদের দাদারা এমন বন্যা দেখেনি আমাদের দেখার ত প্রশ্নই আসে না। বন্যার কথা শুনে ভেবেছি ফুলগাজী পরশুরামে হয়েছে। আমাদের এদিকে আসার সম্ভাবনা নেই। যার কারণে আমাদের কোন প্রস্তুতিও ছিল না। অগ্রিম পূর্বাভাস পেলে হয়ত ক্ষয়ক্ষতি কিছুটা হলেও কম হতো।
তিনি বলেন, সরকারি যে প্রতিষ্ঠানগুলো আবহাওয়ার তথ্য দেয়, অনেক সময় তা সত্যি হয় না। দেখা যায় ঘুর্ণিঝড় এর ১০ নম্বর বিপদ সংকেত কিন্তু বৃষ্টিও হয় না। বন্যা নিয়ে আরও গবেষণা প্রয়োজন। স্থায়ী সামাধান ও উদ্যোগের মাধ্যমে বন্যা নিয়ন্ত্রণ পরিস্থিতি মানুষকে অবগত করা প্রয়োজন তবেই ভবিষ্যতে মানুষ সতর্ক থাকতে হবে।
সদর উপজেলার রহিম উল্ল্যাহ বলেন, এবারের বন্যা থেকে অনেক কিছু শেখার আছে। আমাদের যদি পূর্ব প্রস্তুতি থাকত তাহলে ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হতাম না। বন্যার পূর্বাভাসের জন্য সরকারি উদ্যোগ প্রয়োজন। এবারের বন্যায় যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা আবার হলে ফেনীর মানুষ আর ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না। এমন পরিস্থিতি মোকাবেলায় সরকারভাবে প্রশিক্ষণ কিংবা সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে।